নুসরাত হত্যা নিয়ে এখন তোলপাড় সারাদেশে। সবাই হত্যাকারীদের বিচার চাইছেন, ফাঁসি চাইছেন। অনেকে আবার প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে যাওয়ার দাবি করছেন, কেউ কেউ ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে আগুনে পুড়িয়ে মারার পরামর্শ দিচ্ছেন, অনেকে তাকে প্রকাশ্যে খাঁচায় আটকে থু থু দেয়ার বুদ্ধি দিচ্ছেন।
Advertisement
অভিনব সব শাস্তি। কিন্তু বাস্তবতা হলো এসবই আমাদের আবেগ ও ক্ষোভের কথা। আইন এবং বিচার আবেগ দিয়ে চলে না। নুসরাত হত্যা মামলায় সিরাজউদ্দৌলা এক নাম্বার আসামী বটে, কিন্তু সুষ্ঠু বিচার হলেও হয়তো সিরাজউদ্দৌলার ফাঁসি হবে না। কারণ নুসরাতের গায়ে যখন আগুন দেয়া হয়, তখন সিরাজউদ্দৌলা কারাগারে ছিল। কিন্তু আইন কী বলে সেটা আসলে আমরা জানতে চাই না, চাই সিরাজউদ্দৌলার সর্বোচ্চ সাজা। কারণ নুসরাত হত্যার মূল দায় এই কুলাঙ্গারের। তবে দায় আরো অনেকেরই আছে।
যে চার দুর্বৃত্ত নুসরাতের গায়ে আগুন দিয়েছে, তাদেরকে তো দায় নিতেই হবে। দায় আছে যারা আগুন দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে তাদের, যারা সিরাজউদ্দৌলার মুক্তি চেয়ে মিছিল করেছে তাদের, দায় আছে পুলিশের, প্রশাসনের, এমনকি গণমাধ্যমের। নুসরাতের হেনস্থার শুরু কিন্তু আজ নয়, নুসরাত হত্যা মামলার অন্যতম আসামী নুরউদ্দিন ২০১৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি দাখিল পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে চুন ছুঁড়ে নুসরাতের মুখ ঝলসে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। নুসরাতের অপরাধ ছিল নুরউদ্দিনের প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়া।
সে ঘটনায় নুরউদ্দিনের সাজা হয়নি। হয়নি বলেই প্রিন্সিপাল সিরাজউদ্দৌলার সহযোগী নুরউদ্দিনকে আরো বড় প্রতিশোধ নেয়ার পথে এগিয়ে দেয়। সিরাজউদ্দৌলা যখন মাদ্রাসায় নুসরাতের গায়ে হাত দেয়, তখন তার মায়ের মামলায় প্রিন্সিপালকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই নুরউদ্দিন সিরাজউদ্দৌলার মুক্তি পরিষদ গঠন করে মানববন্ধন-মিছিল করে।
Advertisement
একবার ভাবুন, ৬ এপ্রিল নুসরাতের গায়ে আগুন না দিলে কী হতো? কিছুই হতো না। সিরাজউদ্দৌলা নুসরাতের শ্লীলতাহানী করেছে ২৭ মার্চ, আর তার অনুসারীরা নুসরাতের গায়ে আগুন দিয়েছে ৬ এপ্রিল। এই ১১ দিন আমরা কী করেছি? কিছুই করিনি। এই ১১ দিনে আমরা নুসরাতের নামও জানিনি। আর এই ১১ দিন সিরাজউদ্দৌলার চ্যালারা নুসরাতের ওপর, তার পরিবারের ওপর প্রবল চাপ দিয়েছে। নুরউদ্দিনরা যেভাবে আন্দোলন করছিল, তাতে সিরাজউদ্দৌলা হয়তো জামিন পেয়ে যেতো। জামিন পেয়ে হয়তো সিরাজ আর নুরউদ্দিন গং নুসরাতের ওপর আরো কোনো প্রতিশোধের ছক কষতো। হয়তো সিরাজউদ্দৌলা অন্য কোনো নুসরাতের গায়ে হাত দিতো।
বিচার চাইতে গেলে কী হয় সেটাও তো আমরা দেখেছি। নুসরাতসহ অনেকেই বিভিন্ন সময়ে সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে মাদ্রাসার সভাপতি ও ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এনামুল করিমের কাছে অভিযোগ করেছিলেন, ব্যস্ত প্রশাসক সেটি খুলে দেখারও সময় পাননি। সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেমের কাহিনী তো আপনারা সবাই জানেন। মোয়াজ্জেম নামের এই কুলাঙ্গার নুসরাতের অভিযোগ শোনার নামে, জিজ্ঞাসাবাদের নামে আরেকদফা শ্লীলতাহানী করেছে। বেআইনীভাবে সেটি ভিডিও করে ফেসবুকে প্রচার করেছে।
নুসরাত যখন মৃত্যুশয্যায়, তখনও এই মোয়াজ্জেম এটা আত্মহত্যার চেষ্টা কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে, সিরাজউদ্দৌলা ঘটনাস্থলে ছিল না বলে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। মোয়াজ্জেমকে নুসরাত হত্যা মামলায় আসামী তো করতে হবেই, বিনা অনুমতিতে একজন নির্যাতিতার ভিডিও করে তা ছড়িয়ে দেয়ার অপরাধে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও মামলা হতে হবে। কিন্তু ওসি মোয়াজ্জেমকে শুধু ক্লোজ করা হয়েছে। ক্লোজ করা কিন্তু কোনো শাস্তি নয়, এক ধরনের বিশ্রাম। তাকে অবশ্যই এই মামলা গ্রেপ্তার করার দাবি জানাচ্ছি।
এখন সারাদেশ নুসরাত হত্যার বিচারের দাবিতে সোচ্চার। কিন্তু একবার ভাবুন, চুন ছুঁড়ে মারার অপরাধে ২০১৭ সালেই যদি নুরউদ্দিনের বিচার হতো, তাহলে সে এত বাড়তে পারতো না। সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে আগেও যৌন হয়রানি ও চেক জালিয়াতির অভিযোগ ছিল। তখনই যদি তার বিচার হতো, তাহলে এখন তার লালসার আগুনে প্রাণ দিতে হতো না নুসরাতকে।
Advertisement
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এনামুল করিম যদি আগে সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নিতো, তাহলে হয়তো সে এতটা দানব হয়ে উঠতে পারতো না। ওসি মোয়াজ্জেম যদি নুসরাতকে হেনস্থা না করে সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে কঠোর হতো, তার মুক্তির দাবিতে মিছিলকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতো; তাহলে হয়তো তারা আগুন লাগানোর সাহস পেতো না।
এলাকার মানুষ সিরাজ-নুরউদ্দিন গংদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতো, নুসরাতের পাশে থাকতো; তাহলে হয়তো তাকে মরতে হতো না। গণমাধ্যম যদি ২০১৭ সালে চুন ছুঁড়ে মারার ঘটনার পেছনে লেগে থাকতো বা ২৭ মার্চের পর সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতো, তাহলে হয়তো এমন শোকের আবহে বর্ষবরণ করতে হতো না।
এটাই হলো সুশানের অভাব, আইনের শাসনের ঘাটতি। আইন তার স্বাভাবিক গতিতে চললেই এতকিছু ঘটতো না। তাহলে কি আমাদের কন্যাদের, বোনদের সম্ভ্রমহানীর বিচার পেতে মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে? প্রতিদিন কত নুসরাতের শ্লীলতাহানী করছে কত সিরাজউদ্দৌলা; তার খবর কি আমরা রাখি?
নুসরাতদের গায়ে আগুন না লাগলে আমাদের বিবেক জাগ্রত হয় না। আমরা নুসরাতের শ্লীলতাহানীর বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামি না, বরং যৌন নির্যাতনকারী প্রিন্সিপালের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হই। অদ্ভুত, মৃত্যুর আগে আমাদের মেয়েদের নিরাপত্তা নেই। প্রিন্সিপাল গায়ে হাত দেবে, এটা যেন কোনো অপরাধই নয়। এমনকি ওসি মোয়াজ্জেমও নুসরাতকে বলে, তোমার কান্না করার মত কিছু হয়নি। অনাকাঙ্খিত স্পর্শ একজন নারীর কাছে কতটা ভয়াবহ, বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের পুলিশ কবে বুঝবে? আমরা কবে আমাদের কন্যার জন্য একটা নিরাপদ দেশ গড়তে পারবো।
নুসরাতের জন্য এখন কাঁদছে গোটা দেশ, সোচ্চার সবাই। প্রধানমন্ত্রী শুরু থেকেই নুসরাতের খোঁজ রাখছেন। তাকে সিঙ্গাপুর পাঠানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বাঁচানো যায়নি তাকে। প্রধানমন্ত্রী এখন নুসরাতের হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন। একে একে আসামী গ্রেপ্তার হচ্ছেও।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। তিনি সব দিকে নজর রাখছেন। কিন্তু আইনের শাসন থাকলে তো প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ লাগার কথা নয়। কেউ অপরাধ করলে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে, বিচার হবে; এটাই আইনের স্বাভাবিক গতি। আইনমন্ত্রী বলছেন, এই মামলার বিচার বিশেষ ট্রাইব্যুনালে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও কঠোর ব্যবস্থার আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে এখন এখন এত সোচ্চার হতে হবে কেন।
এখন সবাই মিলে চেষ্টা করেও তো নুসরাতকে ফেরানো যাবে না। কিন্তু এরচেয়ে অনেক কম চেষ্টায় নুসরাতবে বাঁচানো যেতো, আমাদের বোনতের সম্ভ্রম রক্ষা করা সম্ভব ছিল। তাই কোনো একটা ঘটনায় ঝড় তোলা নয়, আমরা চাই আইনের শাসন, সুশাসন। যাতে দেশের সব নুসরাতরা নিরাপদ থাকতে পারে, প্রতিবাদ করতে পারে।
এইচআর/এমকেএইচ