মাকসুদা আক্তার
Advertisement
‘অগ্নিপ্রভা চতুর্দশের’ বহুল প্রতীক্ষিত শিক্ষা সফরের শুরুটা জানুয়ারি মাসের ২৫ তারিখ রাত সাড়ে ১০টায় কলা ভবন থেকে বাস ছাড়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয়। ৩৮ জন শিক্ষার্থী এবং তিনজন শিক্ষকের সমন্বয়ে কক্সবাজার-সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চতুর্দশ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। যাত্রাপথে দুইবার আধা ঘণ্টা ও বিশ মিনিটের ব্রেক ছিল যথাক্রমে কুমিল্লা এবং চট্টগ্রামে।
সকাল ৭টায় হোটেল ওশেনিয়া বিডিতে কোনোমতো ব্যাগগুলো রেখে পাশেই একটা রেস্তোরাঁয় নাস্তা করে সবাই বেরিয়ে পড়লাম সমুদ্রের গভীরতা মাপতে। পানিতে লুটোপুটি, হুড়োহুড়ি করে সবার আনন্দ-আয়োজন ছিল চোখে পড়ার মতো। এরপর রুমে চেক-ইন করে পুনরায় একই রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার খেলাম। দুপুরের খাবারে কোরাল মাছের বড় বড় পিসগুলো অনেকেই শেষ করতে পারেনি। এখানে বলে নেওয়া দরকার, আমাদের ছাত্র-শিক্ষক সবারই ছোট-বড় দায়িত্ব যেহেতু ভাগ করা ছিল পূর্ব থেকেই। তাই সবকিছু সময়মতো হওয়ার পেছনে তাড়া ছিল প্রচুর। শেষ পর্যন্ত সব কিছু সময়মতোই হয়েছে।
দুপুর আড়াইটায় তারিক স্যারের নির্দেশমাফিক আগে থেকেই ঠিক করে রাখা চান্দের গাড়ি করে রওয়ানা হলাম পাটুয়ারটেকের দিকে। ৩টি গাড়িতে ছাত্র-শিক্ষক মিলিয়ে আনন্দ করতে করতে প্রথমে পৌঁছলাম দরিয়া-নগর পিকনিক স্পটে। সেখানকার পরিবেশ আমাদের মুগ্ধ করলো। বিশেষ করে ঝরনা এবং পাহাড়ের উঁচু জায়গা থেকে আশেপাশের পরিবেশ দেখার আনন্দ কখনো বলে বোঝানোর মতো নয়। হোসনে আরা ম্যাম কৃত্রিমভাবে তৈরি দেওয়াল দেখে বললেন, ‘জায়গাটা ফ্রেইলের মতো।’ পুনরায় একই গাড়ি করে গেলাম ঝাউবনে। সেখানে কিছুক্ষণ ঘুরতে না ঘুরতেই ডাক পড়লো পাটুয়ারটেক যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আমরাও চান্দের গাড়িতে করে পৌঁছে গেলাম নির্দিষ্ট গন্তব্যে। সবাই সূর্যাস্ত দেখার পাশাপাশি ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এত সুন্দর দৃশ্য যদি আর না মেলে! সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে হোটেলে ফিরে বেরিয়ে পড়লাম কেনাকাটার জন্য।
Advertisement
সেন্টমার্টিন যেহেতু আমাদের পরবর্তী গন্তব্য এবং এরপর কক্সবাজারে এসে আর থাকার সুযোগ নেই। তাই আগেই সবাই কেনাকাটা করতে গেলাম। এবার কক্সবাজারে পণ্যের দাম গতবারের তুলনায় বেশি ছিল বলেই সবাই কিছুক্ষণ মুখ ভার করে সামর্থের মধ্যে প্রিয়জনদের জন্য উপহার নিলাম। শপিং করতে গিয়ে অনেকটাই দেরি হয়ে গেল। ফলে সবার শেষে আমরা কয়েকজন রাতের খাবার খেতে গেলাম। রাতের খাবারের পরপরই শিক্ষকদের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা সবকিছু গুছিয়ে রাখলাম পরের দিনের জন্য।
সকালে আমাদের চেক-আউট শেষে আমরা সাড়ে ছয়টার দিকে জাহাজে করে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। জাহাজেই হানিকম্ব আর আপেল দিয়ে নাস্তা করলাম সবাই। গাঙচিলের পাখা ঝাপটানি যতটা দেখবো ভেবেছিলাম; ততটা দেখতে পাইনি বলে কিছুটা মন খারাপ হয়েছিল। দেড়টার দিকে রিসোর্টে পৌঁছে সে দুঃখ দমে গেল। আমাদের খাবারের জায়গাটা ছিল একদম সমুদ্রের সাথে লাগোয়া। নয়নাভিরাম প্রকৃতির মাঝে স্যামন মাছ খেয়ে আমরা সমুদ্রে নেমে গোসল করলাম। এরপর বিকেলে সূর্যাস্ত দেখার জন্য সবাই গেলেও আমি যেতে পারিনি। রাতে একটু ঘুরে আবার ফিরে এলাম রিসোর্টে। তাড়াতাড়ি ঘুমানোর একটি তাড়া ছিল। কারণ পরদিন সূর্যোদয় দেখতে হবে।
আরও পড়ুন কাপ্তাইয়ে পর্যটকদের নতুন গন্তব্য ‘গরবা গুদি’ অন্যতম দর্শনীয় স্থান মহামায়া লেকভোরে সবাই উঠতে না পারলেও আমরা কয়েকজন হোসনে আরা ম্যাম ও তারিক স্যারের সাথে সেন্টমার্টিনের পূর্বদিকে গেলাম সূর্যোদয় দেখতে। এত সুন্দর দৃশ্য আমাদের আবেগকে নাড়া দেবে স্বাভাবিক। কয়েকজন মিলে কিছু শামুক কুড়ানোর চেষ্টা করলাম। তবে সেখানে গিয়েও দেখলাম প্রকৃতির দিকে না তাকিয়ে মানুষ ভ্লগ বানাচ্ছে। যেন যান্ত্রিকতা প্রাকৃতিক দৃশ্যকেও বন্দি করে রাখছে। সূর্যোদয় দেখে এসে ডিম ভাজা ও খিচুড়ি দিয়ে নাস্তা করলাম সবাই। এরপর কিছুটা গোছগাছ করে প্রকৃতির মাঝে নিজেকে ধরে রাখার প্রয়াসে সবাই ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।
এর মধ্যে ছেলেদের দুই দল ‘টিম কোপায়া দে’ ও ‘টিম কাপায়া দে’র মধ্যে দারুণ উত্তেজনাকর ফুটবল খেলা অনুষ্ঠিত হলো। এ খেলার রেফারি ছিলেন আমাদের নাজমুল হোসেন স্যার। এরপর ছাত্র-ছাত্রী সবার জন্য ছিল বালতিতে বল নিক্ষেপ খেলা। দুপুরের খাবার খেতে খেতেই আমাদের সময় হয়ে গেল শাড়ি পরে সূর্যাস্ত দেখতে যাওয়ার। এবার ভালো করেই দেখা হলো দৃশ্যটা। এত মানুষ সমুদ্রপাড়ে ভিড় করেছে যে, মনে হলো সমুদ্রের সাথে মিশে গেছে জনতার সমুদ্র। সূর্যাস্ত দেখে কিছু শপিং করে ডিনার করলাম সবাই। এবার ডিনারে ছিল মাছের বারবিকিউ।
Advertisement
এরপরই আমাদের ঐতিহ্যবাহী বিভাগের মূল আকর্ষণ অনুযায়ী শিক্ষক-ছাত্র সবাইকে নিয়ে রিসোর্টের উঠোনে শুরু হলো সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন। সবাইকে কিছু না কিছু করতে হলো। নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি, মিমিক্রি, অভিনয়সহ নানা আয়োজনে আনন্দমুখর সন্ধ্যাটি কাটলো। সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ছিল তারিক মনজুর স্যারের সংবাদ পরিবেশনা। অনুষ্ঠান শেষে ক্রেস্টের সাথে সবাই কিছু না কিছু উপহার পেয়েছিলাম। শেষ রাত হিসেবে প্রায় সবাই জেগে কাটিয়ে দিলেন। এজন্য পরদিন সকালে অনেকেই নাস্তা করতেই বের হলেন না। সকাল ১০টার দিকে সবাই আরেকটু ঘুরতে গলাচিপা গেলাম।
১২টার দিকে আমরা সবকিছু গুছিয়ে রিসোর্ট থেকে চেক-আউট করলাম। দুপুরে শেষবারের মতো মাছ ভাজা দিয়ে ভাত খেয়ে চলে এলাম জাহাজ ঘাটে। মেইন ডেক এবং সান ডেকের সমন্বয়ে সবাই জাহাজে ঘোরাঘুরি করে সময় কেটে গেল। রাতের আকাশের অগণিত তারা গোনারও অভিজ্ঞতা হলো। সময়ের স্রোতে অগ্নিপ্রভার উচ্ছ্বাসও ঝিমিয়ে এলো। কক্সবাজারে পৌঁছলাম রাত ১১টায়। সেখানে ডলফিন মোড়ের একটি রেস্তোরাঁয় খেয়ে ১২টার দিকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। যাওয়ার সময় চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক দেখা গেলেও আসার সময় তা রূপ নিলো বিষাদে। সবাই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বিষাদের সুরে তাল মিলিয়ে পরদিন অর্থাৎ ৩০ জানুয়ারি ১০টার মধ্যে নিজ গন্তব্যে পৌঁছলাম। যদিও এ জীবনে গন্তব্যের শেষ নেই জানি।
লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এসইউ/জিকেএস