ভ্রমণ

ফতেহপুর সিক্রিতে যা দেখবেন : শেষ পর্ব

শিউলি সেন

Advertisement

সেলিম চিস্তির দরগা: সেই সেলিম চিস্তি; যার আশীর্বাদে রাজা হওয়ার চৌদ্দ বছর পরেও আকবর-যোধাবাঈ সন্তান লাভের সৌভাগ্য লাভ করেন। তাই আজও দর্শনার্থীরা চিস্তির সমাধিতে এসে শ্রদ্ধাস্বরূপ মাথা ঢেকে ঢোকে। তাকে প্রণাম করে, প্রার্থনা করে, মনের ইচ্ছা পূরণের জন্য জালিতে লাল সুতা বাঁধে।

১৫৭১ সালে ৯২ বছর বয়সে আকবরের এই পরম শ্রদ্ধেয় ফকির সেলিম চিস্তির ইন্তেকাল হয়। আকবর তখন নির্দেশ দেন চিস্তির স্মৃতিসৌধ নির্মাণের। একতলা এ দরগা তৈরি হয় মার্বেল পাথরের চৌকাকৃত ইমারতের আকারে। এর ভেতরে শায়িত করা হয় সেলিম চিস্তির মরদেহ।

ভারতের যাবতীয় মর্মর সৌধের মধ্যে এটি অনন্য। শুভ্র মর্মর নির্মিত এ সমাধির চতুর্দিকে মর্মর গবাক্ষ এবং প্রত্যেকটি গবাক্ষ হস্তিদন্ত শোভিত। ভেতরে শুক্তিকা খচিত সমাধি এবং তাতে বিচিত্র বর্ণের কৃত্রিম পুস্পলতা সুক্ষ্ম প্রস্তর সংযোগে তৈরি করা হয়েছে। সেইসাথে ইমারতের ছাদের প্যারাপেটগুলো এমন চওড়া করে বানানো হয়েছে। যেন সিক্রির কড়া রোদ ভেতরে যেতে না পারে। আর প্যারাপেটের ভার বহন করার জন্য প্রতিটি কোণে সাপের মতো প্যাচানো স্ট্রাকচার। সেইসাথে সৌধের গম্বুজের উপরে বৃষ্টির ধারা যে পড়বে, তার যেন কোন জলনিকাশি নালি দিয়ে সমাধি চত্বরের মেঝেতে নেমে না আসে। তাই এ দলকে ভারবাহী এ ফাঁপা মর্মর স্তম্ভের ভেতর দিয়ে ভূগর্ভস্থ পয়ঃপ্রণালি বাইরের জলধারে ফেলা হয়েছে।

Advertisement

সেইসাথে মকবরাজুড়ে পাথরের জালি কাজগুলো দেখার মতো। জালিগুলো দিয়ে যখন বাইরে থেকে দেখা হয়, তখন ভেতরের কিছু দেখা যায় না। কিন্তু ভেতরের থেকে বাইরের সব কিছু ছবির মত দেখা যায়। তাই এ সমাধি দর্শন শেষে মনে হয়, আকবর যেন একটি ভক্তিমণ্ডিত শুভ্র সুকুমার ফুল গুরুর চরণে নিবেদন করেছেন। সেলিম চিস্তির দরগার ব্যাপারে এ কারণে সৈয়দ রিজভী লিখেছেন, ‘চিস্তির মকবরার কাব্যময় রূপটিকে বর্ণনা করবার উপযুক্ত বিশ্লেষণের সত্যিই বড় অভাব।’ ভারতের যাবতীয় মর্মর সৌধের মধ্যে এটি অনন্যই।

এরপর আমরা আকবরের মহল পরিদর্শন করেছি। যেখানে একাধারে আছে আকবরের বেগমদের মহল এবং আকবর মাতা হামিদা বানু বেগমের মহল। আকবর জননী হামিদা বানু বেগমের মহলের নাম সুনহারা মকান বা গোল্ডেন হাউস। ইংরেটি ‘টি’ বর্ণের আকারে নির্মিত এ মোকামের দু’দিকে দু’টো সিঁড়ি আছে দ্বোতলার চবুতরায় উঠে যাওয়ার।

এরপরে আসা যাক আকবর মহিষীদের মহল। এরমধ্যে সুনহারা মকানের লাগোয়া গুজরাট থেকে শিল্পী এনে গড়া যোধাবাঈ মহল। যোধাবাঈ যিনি ছিলেন আকবরের প্রধান মহিষী, জাহাঙ্গীরের মা এবং অম্বরকন্যা মান সিংহের বোন। যোধাবাঈয়ের এ চতুষ্কোন প্রাসাদের বাইরের দিকে অন্ধপ্রাচীর, ঘরের থেকে বাইরে বা বাইরের থেকে ভেতরে তাই কিছুই দেখা যেতো না। এ মহলের ভেতরে আছে যোধাবাঈয়ের পূজার ঘর, বসার ঘর। এসব কিছুতেই রাজস্থানি শিল্পকলা বর্তমান। যোধাবাঈ মহলের সাথে লাগোয়া গোয়া থেকে আসা আকবরের খ্রিষ্টান বেগম মারিয়ামের গোল্ডেন প্যালেস। কাশ্মিরি শৈলীর দারু খচিত সুলতানা লুকায়া বেগম বা তুরস্কের বিবি সুলতানা বেগম কোঠি।

এরপর সবার আগে বলি, বাদশাহের বিচারসভা দেওয়ান-ই-আম। কিংস গেট দিয়ে ঢুকে আয়তকার বিশাল সভা দেওয়ান-ই-আম। এর পশিচম দিকের অলিন্দের কেন্দ্রস্থলে দ্বিতলে একটি ঝোলা বারান্দায় পাশাপাশি পাঁচটি কক্ষ। কেন্দ্রস্থ অলিন্দের ঝরোকায় বসতেন বাদশাহ। বাইরের দিক থেকে অন্যান্য আমির-ওমরারা অন্য সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে সভায় বসতেন। দেওয়ান-ই-আমের উওর-পশ্চিম দিকে একটি লোহার আঙটা পাষাণ চত্বরে সুদৃঢ়ভাবে আটকানো। বলা হয়, এটিতে একটি সুশিক্ষিত হাতি বাঁধা থাকতো। কোন অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড হলে হাতির পদতলে পৃষ্ট করা হতো। যদিও সেই শাস্তি দিনে কার্যকর হতো। মাহুতের কাজ ছিল প্রতিদিন হাতিকে সভায় নিয়ে আসা।

Advertisement

বাদশাহের এ অনবদ্য কারুকার্যময় মন্ত্রণাসভা ভ্রমণার্থীদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। সমচতুষ্কোন ইমারতটি বিখ্যাত তার কেন্দ্রস্থ স্তম্ভটির কারণে। হিন্দু ও মুসলিম স্থাপত্যের মিলন হয়েছে এতে। একে আকবরের গোপন মন্ত্রণাসভা মনে করা হয়। আবার কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, এখানে বসে আকবর হীরা-জহরতগুলো পরীক্ষা করতেন। তাদের এ মতের কারণ, এর ঠিক পশ্চিমেই দৌলতখানা।

এছাড়া অসহ্য গরমের হাত থেকে বাঁচতে তৈরি করা হয়েছিল পাঁচ মহল। গরম থেকে মুক্তি পেতে প্রতিটি তলা ক্রমশ সংকীর্ণ হয়েছে। মোট ১৭৬টি স্তম্ভে তৈরি পাঁচ মহলের নিচু তলায় স্তম্ভের সংখ্যা ৮৪, তারপর কমে ৫৬, তারপর ২০, তারপর ১২ এবং সবশেষে ৪ শিরে গম্বুজ। পিলারগুলো একটি আরেকটি থেকে স্বতন্ত্র। অতীতে প্রতি তলায় বাইরের অংশ দিয়ে জালি কাজের নকশা সমন্বিত পাথরের দেয়াল ছিল, তাই থেকে ঝুলতো খসখস। সূর্যাস্তের উপক্রম দেখলেই দাসিরা সেগুলো ভিজিয়ে দিতো। যার ফলে সন্ধ্যায় স্নিগ্ধ হয়ে থাকতো এ পাঁচ মহল। গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে চলত মহিলা মহলের গুলতানি, কোথাও খাসগল্প তো, কোথাও গজলি।

লেখক: ভ্রমণ উপদেষ্টা, দিল্লি।

এসইউ/এমকেএইচ