সময়ের ব্যবধান খুব বেশি নয়; মাত্র ৯ বছর। তবে এর মধ্যে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা আর ব্রহ্মপুত্র এবং ক্যারিবিয়ান সাগরের জল গড়িয়েছে অনেক। আকাশে মেঘও বদলেছে প্রচুর। সময়ের প্রবাহমানতায় বদলেছে সাকিব আল হাসানের ক্যারিয়ারও।
Advertisement
২০০৯ সালে ভাঙ্গাচোরা নাম সর্বস্ব ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তাদেরই মাটিতে যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক’ সাকিব আল হাসানের। ঠিক ৯ বছর পর সেই দেশেই পুরোদস্তুর টেস্ট অধিনায়ক হয়ে গেলেন সাকিব।
ইতিহাস জানাচ্ছে, সেই সফরটিই ছিল দেশের বাইরে প্রথম বাংলাদেশের সাফল্যের সফর। সেবারই প্রথম দেশের বাইরে প্রথম টেস্ট আর ওয়ানডে সিরিজ জয় করেছিল সাকিব বাহিনী।
সেই টেস্ট সিরিজ ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখা আছে। যা দেশের বাইরে বাংলাদেশের টেস্ট সিরিজ বিজয়ের স্মারক হয়েই রয়েছে। একই সাথে দেশের বাইরে প্রথম ওয়ানডে সিরিজ বিজয়ের মিশনও ছিল সেটা।
Advertisement
মাঝের সময়টায় বাংলাদেশ ওয়ানডে দল হিসেবে অনেক উন্নতি করেছে। র্যাঙ্কিংয়ে ওপরে উঠেছে। টেস্টেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না হলেও টাইগাররা আগের চেয়ে দীর্ঘ পরিসরের ম্যাচেও ভালো খেলতে শিখেছে।
দেশের মাটিতে পাকিস্তানের সাথে টেস্ট ড্র, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দলকে হারনোর কৃতিত্ব অর্জিত হয়েছে। শ্রীলঙ্কার মাটিতে লঙ্কানদের হারানোর মতো সাফল্যও দেখিয়েছে টিম বাংলাদেশ। তামিম, মুশফিক, সাকিবরা লম্বা সময় উইকেটে টিকে থাকার পাশাপাশি বড় ইনিংসও খেলতে শিখেছেন। বোলিংয়ে সাকিব, মিরাজের স্পিন ঘূর্ণিতে ইংলিশ এবং অজিরাও হয়েছে কুপোকাত।
কিন্তু মাঝে অল্প কিছু দিন সময়টা খারাপ যাচ্ছে। যা শুরু হয়েছে গত অক্টোবর-নভেম্বরে দক্ষিন আফ্রিকা সফরে। টেস্ট, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিতে চরম ব্যর্থ হয়ে রীতিমতো হোয়াইটওয়াশ হয়ে ফিরেছে টাইগাররা। তারপর সব ফরম্যাটেই ছন্দপতন। ঘরের মাঠে তিন জাতি ক্রিকেট এবং শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজও হেরেছে।
এরপর শ্রীলঙ্কার মাটিতে তিন জাতি টি-টোয়েন্টি আসর নিদাহাস ট্রফির ফাইনাল খেললেও, সর্বশেষ আফগানিস্তানের বিপক্ষে ভারতের দেরাদুনে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে নাকাল হতে হয়েছে সাকিবের দলকে। হয়েছে হোয়াইটওয়াশ।
Advertisement
মোট কথা, ক্রিকেটে খুব ভাল সময় কাটছে না বাংলাদেশ জাতীয় দলের। এমন এক সময় সময়ের চাকা ঘুরে চলে এসেছে বাংলাদেশ আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট সিরিজ। আজ রাতেই স্বাগতিকদের বিপক্ষে অ্যান্টিগায় প্রথম টেস্ট খেলতে নামছে সাকিব আল হাসানের দল।
এই টেস্টে কেমন খেলবে বাংলাদেশ? যদিও প্রস্তুতি ম্যাচে ওপেনার তামিম ও মিডল অর্ডারে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ সেঞ্চুরি করেছেন। তারপরও সমর্থক-ভক্ত সবাই সংশয়ে, কি করবে সাকিবের দল? যে দেশ থেকে সাফল্যের পতাকা উড়িয়েছিলেন সাকিব আল হাসান, সেই দেশে কি সেই পতাকা সমুন্নত রাখতে পারবেন তিনি?
২০০৯ সালে মাশরাফি বিন মর্তুজার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়েছিল সিরিজ খেলার জন্য; কিন্তু কি দুর্ভাগ্য, মাশরাফি সেই সিরিজের শুরুতেই পড়লেন ইনজুরিতে। ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব বর্তায় সাকিব আল হাসানের ঘাড়ে। নেতৃত্বের দায়িত্ব নিয়েই সাকিব বদলে দিয়েছিলেন দলকে। ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জেতান বাংলাদেশকে। বিদেশের মাটিতে প্রথম টেস্ট সিরিজ জয় এবং প্রতিপক্ষকে হোয়াইটওয়াশ করার স্বাদ পায় টাইগাররা।
ওয়ানডে সিরিজেও স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বাংলাদেশের সামনে দাঁড়াতে দেননি সাকিব আল হাসানকে। সিরিজ জিতে নেন ৩-০ ব্যবধানে। নিজে যেন পারফরমার ছিলেন, তেমনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন সিরিজ জয়ের। যে কারণে, দেশে ফেরার পর বীরোচিত সংবর্ধনাও পেলেন সাকিব আল হাসান এবং তার দল।
এরপর বাংলাদেশ আরও একবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর করেছিল। ২০১৪ সালে। সেবার মুশফিকুর রহীমের নেতৃত্বে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের তিনটিতেই হার। এরপর টেস্ট সিরিজেও ক্যারিবীয়দের সামনে দাঁড়াতে পারেনি টাইগাররা। হেরেছে ২-০ ব্যবধানে। যেন আগের সিরিজেরই বদলা নিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। মজার বিষয় হচ্ছে, সেবারই কোচ হিসেবে প্রথম বিদেশ সফরে গিয়েছিলেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে।
এবার বাংলাদেশের হয়ে ইংল্যান্ডের স্টিভ রোডসের কোচিং ক্যারিয়ারই শুরু হচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর দিয়ে। তার চেয়ে বড় কথা, ৯ বছর পর ঘুরে-ফিরে আবারও নেতৃত্বের বোঝা সাকিব আল হাসানের ঘাড়ে। যদিও সেটা দুই ফরম্যাটে। টি-টোয়েন্টি এবং টেস্টে। ওয়ানডে নেতৃত্ব রয়েছে মাশরাফি বিন মর্তুজার ঘাড়েই।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, ৯ বছর আগে যে পতাকা সমুন্নত করেছিলেন সাকিব আল হাসান, সেটা কি ধরে রাখতে পারবেন এবার? ৯ বছর আগের সেই ভাঙাচোরা ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিন্তু এখন আর নেই। যদিও, র্যাংকিংয়ে টেস্ট এবং ওয়ানডেতে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে ক্যারিবীয়রা; কিন্তু ঘরের মাঠে কতটা ভয়ঙ্কর সেটা সম্প্রতি শ্রীলঙ্কাকে দেখিয়ে দিয়েছে তারা। শ্যানন গ্যাব্রিয়েল কিংবা কেমার রোচরা রীতিমত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছেন ব্যাটসম্যানদের সামনে।
সুতরাং, সাকিব আল হাসানের সামনে অপেক্ষা করছে কঠিন এক পরীক্ষা। অ্যান্টিগায় সেই পরীক্ষায় আজ রাতেই ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। নেতা সাকিবের সঙ্গে ব্যক্তি পারফমার সাকিবেরও এক সঙ্গে জ্বলে ওঠা আজ জরুরি। যেমনটা হয়েছিল ৯ বছর আগে। সেই সাকিবকে দেখা গেলে, হয়তো বা সম্মানটা রক্ষা করতে পারবেন তিনি নিজের এবং বাংলাদেশের।
যদিও দলের বাকি ক্রিকেটাররা কম-বেশি সবাই জাতীয় লিগ, বিসিএল এবং টেস্ট খেলেছে। কিন্তু সাকিব গত ৯ মাস লাল বলে কোন প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলেননি। ইনজুরির কারণে দক্ষিণ আফ্রিকায় দেশের বাইরে শেষ টেস্ট সিরিজেও মাঠে নামতে পারেননি তিনি। ছিলেন বিশ্রামে।
এদিকে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে বিধ্বস্ত হওয়ার পর ‘মাঝিহীন নৌকায়’ পরিণত হয় বাংলাদেশ দল। প্রোটিয়াদের সাথে ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ করার পর কোচের পদ থেকে সরে দাঁড়ান চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। মাঝের ৬ থেকে সাড়ে ৬ মাস প্রধান কোচ শূন্যই ছিল বাংলাদেশ দল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এই সিরিজের আগে দায়িত্ব পেয়েছেন নতুন কোচ স্টিভ রোডস।
কাজেই প্রধান কোচ হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরই এ ইংলিশের প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট। বাংলাদেশের বিপক্ষে এই সিরিজ শুরুর আগে ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে নজরকাড়া ক্রিকেট খেলেছে ক্যারিবীয়রা। তাদের বিপক্ষে বাংলাদেশ কেমন করবে, সাকিব আল হাসান কেমন করবেন, সেটাই এখন সবার আগ্রহের সবচেয়ে কেন্দ্রবিন্দুতে।
এআরবি/আইএইচএস/আরআইপি