আন্তর্জাতিক

নজিরবিহীন সংকট মধ্যপ্রাচ্যে, কলকাঠি নাড়ছেন ট্রাম্প!

কাতারের সঙ্গে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) ছয় রাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের জেরে মধ্যপ্রাচ্যে নজিরবিহীন সংকট দেখা দিয়েছে। সন্ত্রাসবাদে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগে সোমবার কাতারের সঙ্গে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর ও বাহরাইন সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দেয়ার পর পরই লিবিয়া ও ইয়েমেন একই পথে হাঁটা শুরু করায় মধ্যপ্রাচ্যের কূটনৈতিক এ সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। সৌদি আরব, আরব আমিরাত ইতোমধ্যে কাতারের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। দেশটির সঙ্গে স্থল ও আকাশপথসহ সব ধরনের যোগাযোগ স্থগিত করেছে।

Advertisement

মধ্যপ্রাচ্যের এ টানাপোড়েনের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দুষছে সৌদি আরবের চির-প্রতিদ্বন্দ্বী ইরান। ট্রাম্পের সাম্প্রতিক রিয়াদ সফরের সময়েই মধ্যপ্রাচ্যে সংকট তৈরির এ ঘটনার পরিকল্পনা সাজানো হয় বলে অভিযোগ করেছে তেহরান।

গালফ রাষ্ট্রগুলো ও মিসর ইতোমধ্যে ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থনের অভিযোগ এনেছে কাতারের বিরুদ্ধে। বিপজ্জনক রাজনৈতিক শত্রু মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন করে মধ্যপ্রাচ্যে কাতারের অস্থিতিশীলতা তৈরির অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

আরব বিশ্বের চার শক্তিশালী রাষ্ট্রের ওই পদক্ষেপে পরে যোগ দিয়েছে ইয়েমেন ও লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলভিত্তিক দেশটির সরকার। ফলে আরব দেশগুলোর মধ্যে নাটকীয় ফাটল তৈরি হয়েছে। সম্পর্ক ছিন্নকারী অধিকাংশ রাষ্ট্রই  বিশ্বের বিশ্বের তেল রফতানীকারক শীর্ষ সংগঠন ওপেকের সদস্য।

Advertisement

কাতারের সঙ্গে পরিবহন সম্পর্ক বন্ধের ঘোষণাসহ আরব উপসাগরীয় অঞ্চলের অন্তত তিন দেশ কাতারের পর্যটক ও বাসিন্দাদের দেশ ত্যাগে দুই সপ্তাহের সময় বেঁধে দিয়েছে। ইয়েমেনে সৌদি-নেতৃত্বাধীন জোটের লড়াই থেকে এর আগেই কাতারকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।

তেল জায়ান্ট সৌদি আরব অভিযোগ করে বলছে, আঞ্চলিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে কাতার। এই জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটিকে সৌদির আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের সমর্থন ও তাদের মতাদর্শ প্রচারে কাতারের সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে রিয়াদের।

সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা এসপিএ বলছে, এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা তৈরির লক্ষ্যে মুসলিম ব্রাদারহুডসহ জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস), আল-কায়েদা ও বেশ কিছু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে সমর্থন করছে কাতার। এছাড়া তাদের গণমাধ্যমে এই গোষ্ঠীগুলোর বার্তা ও পরিকল্পনা ধারাবাহিকভাবে প্রচার করছে।

বাহরাইনে ও সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলের কাতিফ প্রদেশে ইরান সমর্থিত শিয়া মুসলিম ও মিলিশিয়াদের সমর্থনের অভিযোগও আনা হয়েছে কাতারের বিরুদ্ধে। তবে কাতার এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলছে, কাতারকে দুর্বল করতেই সাজানো পরিকল্পনার মুখোমুখি হয়েছে তারা। একই সঙ্গে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছে দেশটি।

Advertisement

কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সম্পূর্ণ মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে উত্তেজনা ছড়ানোর এই প্রচার চালানো হচ্ছে, যা মিথ্যার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে।

কলকাঠি নাড়ছে যুক্তরাষ্ট্র

ট্রাম্পের সাম্প্রতিক রিয়াদ সফরের বরাত দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে দেয়া এক টুইটে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির ডেপুটি চিফ অব স্টাফ হামিদ আবু তালেবি বলেছেন, ‘তরবারি নৃত্যের প্রাথমিক ফল হিসেবে এসব ঘটছে।’

রিয়াদ সফরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তারা সৌদি আরবের ঐতিহ্যবাহী তরবারি নৃত্যে অংশ নেন। এই নৃত্যকে ইসলামি চরমপন্থার বিরুদ্ধে মুসলিম দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ অবস্থান বলে মন্তব্য করেছিলেন ট্রাম্প। কাতারের বিরুদ্ধে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে অর্থায়ন ও সমর্থনের অভিযোগও করেছিলেন মার্কিন এই প্রেসিডেন্ট।

সোমবার সিডনিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন সাংবাদিকদের বলেন, আরব দেশগুলোর এ সিদ্ধান্ত ইসলামি জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে চলমান লড়াইয়ে কোনো প্রভাব ফেলবে না। আরব উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর অভ্যন্তরীন এ সংকট সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র উৎসাহ দিচ্ছে।

দোহা ও এর ঘণিষ্ঠ মিত্রদের মধ্যে সৃষ্ট এই বিভাজন পুরো মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব ফেলতে পারে। কেননা গালফভূক্ত এসব দেশ তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার চর্চা লিবিয়া, মিসর, সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেনে চালিয়ে আসছে।

কূটনৈতিক যুদ্ধের পেছনে কাতার-ইরানের গ্যাসক্ষেত্র!

মধ্যপ্রাচ্যে সৃষ্ট সংকটের ফলে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গ্যাস আমদানিকারক জাপানে গ্যাস সরবরাহে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়ে দিয়েছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) সর্ববৃহৎ রফতানিকারক কাতারগ্যাস। কোনো সংকটই গ্যাস সরবরাহ বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না বলে জাপানকে আশ্বস্ত করেছে কাতারগ্যাস কর্তৃপক্ষ। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ গ্যাস আমদানি করে জাপানি কোম্পানি জেরা।

তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের সর্ববৃহৎ ক্রেতা জাপানি কোম্পানি জেরা বলছে, কাতারের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের কোনো প্রভাব গ্যাস সরবরাহে পড়বে না বলে তাদেরকে আশ্বস্ত করেছে কাতারগ্যাস।

জেরা এক বিবৃতিতে বলছে, চলমান সংকটে এলএনজি গ্যাস সরবরাহে কোনো প্রভাব পড়বে না। এটি অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু। জ্বালানি মার্কেটে এর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা এ সংকটে অব্যাহত নজর রাখবো।

চলতি বছরের এপ্রিলে কাতার বিশ্বের সর্ববৃহৎ গ্যাসক্ষেত্রের উন্নয়নে স্ব-আরোপিত স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেয়। বিশ্বের শীর্ষ এলএনজি রফতানিকারক এই দেশ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে গ্যাস উত্তোলনে রেকর্ড গড়ার প্রচেষ্টা চালায়। তেহরানের সঙ্গে অংশীদারিত্বমূলক দোহার উত্তরাঞ্চলের এই গ্যাসক্ষেত্রের উন্নয়নে ২০০৫ সালে স্থগিতাদেশ ঘোষণা করেছিল কাতার।

গ্যাস উত্তোলন বাড়ানো হলে এর প্রভাব কী ধরনের হতে পারে তা পর্যালোচনা করতে ওই স্থগিতাদেশ দেয়া হয়েছিল। এর ফলে বিশ্ব বাজারে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ২০১৬ সালে বিশ্ব বাজারে ২৬৮ মিলিয়ন টন এলএনজি গ্যাসের বাণিজ্য হলেও কাতার-ইরানের এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন হয় প্রায় ৩০০ মিলিয়ন টন।

সূত্র : রয়টার্স, আল-জাজিরা, হারেটজ।

এসআইএস/আরআইপি