পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। বাজারের আচরণ অনেকটা স্বাভাবিক থাকলেও অস্বাভাবিকভাবে কিছু কিছু কোম্পানির লেনদেন হচ্ছে। কিন্তু অস্বাভাবিক লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা ভয় রযেছে। বৃহস্পতিবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে মোট ৩২৫ টি কোম্পানির ১০ কোটি ৭৫ লাখ ৩৬ হাজার ২৩৪ টি শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের লেনদেন হয়েছে। ডিএসই’তে মোট লেনদেনের পরিমাণ ৪৪২ কোটি ৮৬ লাখ ২৩ হাজার ৮৪২ টাকা। তবে বিনিয়োগকারীরা যখনই বাজারের প্রতি আস্থা রাখতে শুরু করে তখনই কারসাজিকারকদের সক্রিয় ভূমিকার জন্য বিনিয়োগকারীরা আস্থার সাথে বিনিয়োগ করতে পারে না। গত সপ্তাহের চেয়ে এ সপ্তাহের পুঁজিবাজারের সামগ্রিক চিত্র অনেকটাই বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে আগ্রহী করছে। সপ্তাহের শেষ দিন ডিএসই ব্রড ইনডেক্স আগের কার্যদিবসের চেয়ে ১.৬০ পয়েন্ট বেড়ে ৪৫৭৭.৫৭ পয়েন্ট, ডিএস-৩০ মূল্য সূচক ১.৪৮ পয়েন্ট বেড়ে ১৭৯৫.২০ পয়েন্ট এবং ডিএসইএস শরীয়াহ্ সূচক ০.৪৪ পয়েন্ট কমে ১১২৩.০৪ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। লেনদেনকৃত ৩২৫ টি কোম্পানির মধ্যে দাম বেড়েছে ১০৯টির, কমেছে ১৬৮টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৪৮টি কোম্পানির শেয়ার। পুঁজিবাজার পরিস্থিতি উত্তরণের কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, অনেক কোম্পানির এবছরের জুনে বছর শেষ হয়েছে। আর এসকল কোম্পানির লভ্যাংশ ঘোষণা খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই আসবে। আার এমাসের শেষে অনেক কোম্পানি তাদের পারফরমেন্সের ভিত্তিতে লভ্যাংশ ঘোষণা করবে। একারণে পুঁজিবাজারও উর্ধ্বমুখি রয়েছে। এছাড়া পুঁজিবাজার ভালো থাকার অন্যতম কারণ হচ্ছে বাজেট ঘোষণা। গত অর্থবছর শেষ হওয়ার সময় বজেট ঘোষণা হয়েছে। বাজেট ঘোষণা নিয়ে জুন মাস পর্যন্ত মানুষের মধ্যে যে নেতিবাচক আশংকা ছিল তাও কেটে গেছে। যার কারণে যারা বাজেট পরবর্তী পুঁজিবাজার পর্যবেক্ষণে ছিল তারাও বাজারের প্রতি আস্থাশীল হয়েছে। আর এরপর অনেকেই বাজারে লেনদেন করছে।অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের জুলাই থেকে ডিসেম্বরের জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছেন। আর এবারের মুদ্রানীতিতে গভর্নর শেয়ারবাজারের উন্নয়নের বিষয়ে কিছু মৌলিক পরামর্শ দিয়েছেন। আর এতে বিনিযোগকারীদের মধ্যে মুদ্রানীতি ঘোষণা নিয়ে যে শঙ্কা ছিল তাও অনেকাংশে কেটে গেছে। তাই এবছরের ছয়মাসের জন্য যে মুদ্রানীতি ঘোষণা হয়েছে তার পরবর্তী সপ্তাহে এর প্রভাব লক্ষ্য করা গিয়েছে। এর এবারের ঘোষণায় পুঁজিবাজার থেকে কোম্পানির মূলধন উত্তোলন প্রক্রিয়া সহজ করার পরামর্শ দেয়ায় বিনিয়োগকারীরা ধারণা করছে পুঁজিবাজারের প্রতি নতুন গভর্নর ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতিবাচক রয়েছে। আর এটি বিনিয়োগকারীদের আরো বেশি আস্থাশীল হতে সাহায্য করছে। এদিকে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ইন্সুরেন্স কোম্পানি ছাড়া অন্য কোম্পানিগুলোকে ৩০ জুন ফাইনান্সিয়াল ইয়ার ক্লোজ করতে বলা হয়েছে। আর একারণে অনেক কোম্পানি তাদের অর্থবছরের সমাপ্তি অন্যান্য সময়ের সাথে জুন পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে। আর একারণে এবছর প্রকৃত পক্ষে কোন কোন কোম্পনির ক্ষেত্রে ১৫ থেকে ১৮ মাসে বছর হচ্ছে। আর এত লম্বা বছরের কারনে এসকল কোম্পানির এবছর প্রফিটের পরিমাণও বাড়তে পারে। আার ভালো ডিকলারেশনের আশায় কোম্পানগিুলোর প্রতি বিনিয়োগকারীদর আগ্রহ বাড়ছে। এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার লেনদেনের ভিত্তিতে তিতাস গ্যাস, বিএসসিসিএল, সিঙ্গার বিডি, লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট, প্রিমিয়ার সিমেন্ট, এমজেএল বিডি, বিএসসি, এ্যাকমি ল্যাব, স্কয়ার ফার্মা ও ব্র্যাক ব্যাংক প্রধান ১০টি স্থান দখল করে নিয়েছে। তবে ব্যাংকের ফাইনান্সিয়াল রিপোর্ট ভালো থাকার কারনে ব্যাংক খাতের শেয়ার বিনিয়োগকারীদর চাহিদার মধ্যে চলে এসেছে।তবে দর বৃদ্ধির শীর্ষে উসমানিয়া গ্লাস ফ্যাক্টরি, এক্সিম ১ম মি. ফা., স্ট্যান্ডার্ড ইন্সুঃ, রেনউইক যজ্ঞেশ্বর, গ্রীনডেল্টা মি. ফা., জিকিউ বল পেন, ডিবিএইচ ১ম মি. ফা., সিঙ্গার বিডি, রংপুর ফাউন্ড্রি ও ১ম জনতা মি. ফা. প্রধান ১০টি কোম্পানি ছিল। যেখানে এসপ্তাহে অস্বাভাবিক লেনদেন হওয়ার তালিকা ছিল অনেক বেশি।পুঁজিবাজারে অস্বাভাবিক লেনদেন হওয়ার তালিকায় ছিল রেনউইক যজ্ঞেশ্বর, জুট স্পিনার্স,জেমিনি সী ফুড লিমিটেড, ইস্টার্ন ক্যাবলস লিমিটেডের শেয়ার দর। এসকল কোম্পানি নিয়ে কারা খেলছে তা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনাস্থা তৈরি হচ্ছে। যখন বাজারের গতি স্বাভাবিক ধারায় চলে আসছে এবং বিনিয়োগকারীরাও আস্থাশীল হচ্ছে ঠিক তখন কারসাজিকারকদের সক্রিয়তা পুঁজিবাজারকে নেতিবাচক করছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে একটানা রেনউইক যজ্ঞেশ্বর কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছে। গত ১০ দিনে কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছে ৩০৬ টাকা ৮০ পয়সা। এত অল্প সময়ে অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির পর এখনো কোনো তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয়নি বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জ। গত ১০ কার্যদিবস আগে কোম্পানির শেয়ার দর ছিল ২৯৩ টাকা ৬০ পয়সা। আএর আগে কোম্পানির সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ৬০০ টাকা ৪০ পয়সায়। এর আগে অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির কারণে ২১ জুলাই কোম্পানিটিকে নোটিশ দেয়া হয়। কিন্তু কোম্পানি কর্তৃপক্ষ জানায়, শেয়ার দর বৃদ্ধির জন্য কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই। কিন্তু এরপরও দর বৃদ্ধি থেমে নেই। গত একমাসে কোম্পানিটির ২৮৯ টাকা ৯০ পয়সা থেকে ৬০০ টাকা ৪০ পয়সায় লেনদেন হয়। কিন্তু কেন এমন অস্বাভাবিক দাম বাড়ছে। কে বা কারা এগুলোর সাথে জড়িত তা নিযে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে এখনও কোন কিছুই জানানো হয়নি বিনিয়োগকারীদের। এদিকে অস্বাভাবিকহারে শেয়ার দর বাড়ার জন্য কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই বলে জানিয়েছে জুট স্পিনার্স কোম্পানি। সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ার দর বাড়ার কারণ জানতে চায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ। জবাবে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ জানায়, দর বৃদ্ধির পেছনে কোন প্রকার মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই। আবার কোন প্রকার মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ছাড়াই শেয়ার দর বাড়ছে বলে জানিয়েছে জেমিনি সী ফুড লিমিটেড। আর ইস্টার্ণ ক্যাবলস লিমিটেডের শেয়ার দর বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই বলে জানিয়েছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। শেয়ারটির অস্বাভাবিক দর বাড়ার কারণ জানতে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ নোটিশ পাঠায়। এর জবাবে কোম্পানিটি জানায়, কোনো রকম অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ছাড়াই শেয়ার দর বাড়ছে। কিন্তু প্রশ্ন হল যেখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সার্বিলেন্স সফটওয়ারের মাধ্যমে অস্বাভাবিক কোন লেনদেন হলেই তা তাদের নজরে আসার কথা সেখানে দিনের পর দিন অস্বাভাবিক লেনদেন কেন হচ্ছে সে ব্যাপারে বিএসইসি এখনও কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করে নি। আর দুটো স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে শুধু একটি মাত্র চিঠি কোম্পানির কাছে পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ হয়ে যাচ্ছে। আর কোম্পানরি পক্ষ থেকে দায়সারাভাবে জানানো হচ্ছে দর বৃদ্ধির পেছনে কোন প্রকার মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই। তবে কি বছরের পর বছর এভাবেই বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত হবে? আর এই কুচত্রী সুযোগ সন্ধানী মহলের কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আবার রাস্তায় নামতে হবে। তাই অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ঘটনা ঘটার আগেই নিয়ন্ত্রক সংস্থার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বাজারের প্রতি আস্থাশীল হবে আর কারসজিকারকরাও সতর্ক থাকবে।লেখক : বিজনেস এডিটর, এটিএন বাংলা। একাধারে সাংবাদিক, লেখক, সংবাদপাঠিকা এবং অনুষ্ঠান সঞ্চালক। এছাড়াও অর্থনীতি ও পুঁজিবাজার বিষয়ে রয়েছে তার সংবাদ ও টেলিভিশন টক শো। সদস্য, এফবিসিসিআই। কো-চেয়ারম্যান এসএমই, পাট, ইয়াং এন্টারপ্রাইনার ও পুঁজিবাজার বিষয়ক স্টান্ডিং কমিটি। বর্তমানে এশিয়ান প্রোডাক্টিভিটি অর্গানাইজেশনের সার্টিফাইড প্রশিক্ষক এবং উদ্যোক্তা।এইচআর/এবিএস
Advertisement