সন্ত্রাসী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে আবাসিক এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে বেশ কিছু বাধ্যবাধকতা এসেছে। গুলশান হামলার আগেই আবাসিক এলাকা থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুটিয়ে নেয়ার জন্য নোটিশ দেয়া হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে। গত ৪ এপ্রিল মন্ত্রিসভার বৈঠকে আবাসিক এলাকা থেকে ছয় মাসের মধ্যে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণের নোটিশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে গুলশানে অনাকাঙ্খিত ঘটনায় নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য প্রায় ১৩ হাজার প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ দিয়েছে সরকার। এরপর নোটিশের জবাবের ভিত্তিতে শুরু হবে উচ্ছেদ কার্যক্রম । এছাড়া আবাসিক এলাকার এসকল প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন না করা এবং নতুন ইস্যু বন্ধ করা হবে বলে মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত হয়। সরকার ২০১৬ সালকে ট্যুরিজম বছর ঘোষণা করেছে। যদি সত্যিই আবাসিক এলাকা থেকে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান সরানো হয়, তবে সরকারকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হবে। তবে প্রশ্ন রয়েছে কি হবে এসকল প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবিষ্যৎ? এ ব্যাপারে আবাসিক এলাকার ব্যবসায়ীদের মধ্যেও রয়েছে ভিন্নমত। সরকারে উচিত এ ধরনের ইস্যুতে বিভিন্ন মহলের কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে আলাদা আলাদা বৈঠক করা। আলোচনাই হতে পারে একমাত্র সমাধান। কারণ যারা গুলশানে দীর্ঘসময় ধরে ব্যবসা চালিয়ে আসছে তাদের মধ্যে বুটিক হোটেল অন্যতম। সরকারের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৬২টি বুটিক হোটেল রয়েছে এসকল আবাসিক এলাকায়। আমরা যখন বিদেশিদের নিরাপত্তা নিয়ে অনেক বেশি শঙ্কিত হয়ে পড়লাম এবং এসকল প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদের বিষয়ে তৎপরতা বাড়তে লাগলো তখন দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে অন্যরকম আতঙ্ক। কারণ এসকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে অনেকেরই রয়েছে বিশাল ঋণের বোঝা। আর এসকল প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেযার জন্য প্রস্তুতির প্রয়োজন। তাই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের সাথে খাতভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে কীভাবে এর সমাধান করা যায় তা আবারো ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। যেসকল বিদেশিদের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা ভাবছি তাদের ঢাকার শহরে থাকার মত যথেষ্ট নিরাপত্তা সুযোগ সুবিধা আমরা দিতে পারছি কি? প্রতিদিন তের হাজারের অধিক অতিথি ঢাকায় থাকছে আর শুধু ফাইভ স্টার হোটেলে জায়গা দেয়া সম্ভব এক হাজার থেকে পনেরশ জনকে। আর যেসকল বিদেশি বাংলাদেশে আসছেন তারা আমাদের দেশের সাথে ব্যবসায়িক স্বার্থেই আসছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই ফাইভ স্টার হোটেলে থাকার মত পরিস্থিতিতে থাকেন না। অনেকেই কম ডলারের মধ্যে সস্তায় থাকতে চান। আর ফাইভ স্টার ছাড়া ৬২টি বুটিক, ৩০০ গেস্টহাউজ এই সুবিধা দিচ্ছে। আবার এরা যে এলাকায় থাকছেন সেখানেই সস্তায় ভালো পরিবেশে খেতে চান। সেজন্য তাদের প্রয়োজন ভালো পরিবেশের রেস্টুরেন্টের। আর বিদেশিদের প্রয়োজনেই দরকার ভালো স্কুল, হসপিটাল। নিরাপত্তার প্রয়োজনে যদি সব স্কুল, কলেজ, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ইউনিভার্সিটি আবাসিক এলাকা থেকে বের করে দেয়া হয়, তাহলে যেখানে এগুলো সরিয়ে নেয়া হবে সেখানে বিশেষ নিরাপত্তায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তৈরির প্রয়োজন পড়বে। বিদেশিদের চাহিদা অনুযায়ী যে ধরনের রেস্টুরেন্ট দরকার তা আমরা কতটুকু দিতে পারছি। এ কারণেই বিদেশিদের কাছে হলি আর্টিসানের মত রেস্টুরেন্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তাই সমস্যা হয়েছে বলে সব ঢালাওভাবে একই সিদ্ধান্তের মধ্যে না ফেলে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা প্রয়োজন। এজন্য বিদেশিদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে কূটনৈতিক জোনে আলাদা করে সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা করে দেয়া দরকার। যাদের সরিয়ে নেয়া হবে তাদের প্রয়োজনে আলাদা একটি জোনে জায়গা দেয়া দরকার সঠিক নিরাপত্তার মাধ্যমে। তবে এ ধরনের আত্মঘাতী হামলায় সরকার, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সকল প্রস্তুতির পরেও বোঝা সম্ভব হয় না কি হতে যাচ্ছে। তাই আমাদের দেশের ব্যবসায়ী, সাধারণ জনগণকেও সচেতনতার সাথে এগিয়ে আসতে হবে। যাতে এধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পর হঠাৎ নতুন করে আবার কেউ অনুমোদন না পায়। আর দেশের স্বার্থে নিজেদের প্রয়োজনে এসব এলাকায় যারা অবৈধভাবে ব্যবসা করে আসছিল তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবে যারা বৈধভাবে ব্যবসা করছে, তাদের সাথে আলোচনা করে প্রয়োজনে বিশেষ সুবিধা দিয়ে স্থানান্তর করতে হবে। এরই মধ্যে দেশের ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ দেখে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করেছে। প্রয়োজনে তাদের বিশেষ সুবিধার মাধ্যমে সহযোগিতা করতে হবে।ব্যবসায়ীদের উচিত দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে নিজেদেরই আবাসিক এলাকা থেকে ব্যবসা সরিয়ে নেয়া। কারণ এসকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে অনেকের পক্ষেই ঋণের বোঝা নেয়া সম্ভব হবে না। আর এই তের হাজার প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত রয়েছে হাজার হাজার কর্মী ও তাদের পরিবার। তাদের বিষয়টিও ভেবে দেখা প্রয়োজন। সরকারের উচিত ব্যবসাবান্ধব বাংলাদেশ তৈরি করতে এসকল প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে তাদের সুযোগ দেয়া। আর বাংলাদেশ যখন প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স নিয়ে গর্ববোধ করে, সেখানে নন রেসিডেন্ট বাংলাদেশিদের সঠিক পরিবেশ দিলে তারা আমাদের বাণিজ্যিক প্রসারে আরো সহযোগিতা করতে পারবে।লেখক : বিজনেস এডিটর, এটিএন বাংলা। একাধারে সাংবাদিক, লেখক, সংবাদপাঠিকা এবং অনুষ্ঠান সঞ্চালক। এছাড়াও অর্থনীতি ও পুঁজিবাজার বিষয়ে রয়েছে তার সংবাদ ও টেলিভিশন টক শো। সদস্য, এফবিসিসিআই। কো-চেয়ারম্যান এসএমই, পাট, ইয়াং এন্টারপ্রাইনার ও পুঁজিবাজার বিষয়ক স্টান্ডিং কমিটি। বর্তমানে এশিয়ান প্রোডাক্টিভিটি অর্গানাইজেশনের সার্টিফাইড প্রশিক্ষক এবং উদ্যোক্তা।এইচআর/এমএস
Advertisement