মতামত

ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্স এবং ‘ব্রিজ ব্যাংক’

ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্স এবং ‘ব্রিজ ব্যাংক’

কিছুদিন আগে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়েছে। অর্থাৎ বিগত সরকারের সময় অর্থনীতিতে কী ঘটছে তার পূর্ণ বিবরণ শ্বেতপত্রে উঠে এসেছে। সত্য যে, বিগত সরকার এর সময় অর্থনীতি এবং আর্থিক খাত সংক্রান্ত কিছু নীতি (পলিসি) সংস্কার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের সময় নীতি সংস্কার কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে সহায়তা করা। যার ফলে বাংলাদেশ থেকে বিলিয়ন ডলার পুঁজি পাচার করা হয়েছে। পাচারকৃত অর্থ দিয়ে বিদেশে বাণিজ্যিক স্থাপনা ক্রয় করা হয়েছে, শত শত বাড়ি ক্রয় করা হয়েছে। ব্যাংক খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে।

Advertisement

বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর বলেছে বিগত সরকারের সময় ব্যাংক খাত থেকে আড়াই লাখ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। এর আগে সিপিডি বলেছে, ব্যাংক খাত থেকে ৯২ হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। সত্য যে, রাষ্ট্রের সহায়তায় ব্যাংক খাত লুটপাট করা হয়েছে। আইন সংস্কার করে, নীতি সহায়তা দিয়ে বিশেষ গোষ্ঠীকে লুটপাট করার পথ সহজ করা হয়েছিল। ব্যাংক কোম্পানি আইন পরিবর্তন করে আর্থিক খাত পরিবারতন্ত্রে রূপান্তরিত করা হয়েছে।

সাতটি ব্যাংক পরিচালনার জন্য একটি পরিবারকে নির্বাচন করা হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে এখন সামগ্রিক অর্থনীতিতে। বিশ্বব্যাংক বলেছে যে, বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশের আর্থিক খাত ক্রমশ দুর্বল হয়েছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো বিগত সরকারের পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত। আইন অনুযায়ী, একটি পরিবারের হাতে একটি ব্যাংকের ১০ শতাংশ শেয়ার থাকতে পারে। সেখানে একটি পরিবারের কাছে ইসলামী ধারার এক ব্যাংকের শেয়ার ছিল ৮০ শতাংশ পর্যন্ত। শেখ হাসিনা সরকার উৎখাত হওয়ার পর একটি পরিবারের কাছে থাকা ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়ে যায়।

ব্রিজ ব্যাংক হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বারা একটি ব্যর্থ ব্যাংক পরিচালনার তৈরি করা হয়, যতক্ষণ না ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যায়। বলা প্রয়োজন যে, ব্রিজ ব্যাংক ব্যর্থ ব্যাংকগুলোর আর্থিক অস্থিতিশীলতা মোকাবেলার সময় প্রয়োজনীয় ব্যাংকিং পরিষেবা নিশ্চিত করবে।

Advertisement

দুঃখজনক যে, বিগত সরকারের সময় একটি পরিবারের কাছে থাকা সাতটি ব্যাংককে টাকা ছাপিয়ে বছরের পর বছর তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, খেলাপি ঋণ বেড়েই চলছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ, ব্যাংক খাতের ৩০ শতাংশেরও বেশি ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। খুব শীঘ্রই ৩৫ শতাংশে উন্নীত হবে।

দেড় দশক ধরে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যাংকগুলো থেকে যে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে , তার ফলাফল এখন দেখা যাচ্ছে। অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার ১১ টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করে। আমার প্রশ্ন যে, কেন মাত্র ১১ টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করা হলো? সব তফশিলি ব্যাংকে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে ঋণ নেওয়া হয়েছে। এসব ঋণ এখন খেলাপি। রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার এখন ৪০ শতাংশের ওপর। আমি বলবো যে, সব তফশিলি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করা উচিত ছিল। কারণ, এক ব্যাংকের চেয়ারম্যান বা পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে।

এভাবে পারস্পরিকভাবে লাভবান হয়েছে। কিছুদিন আগে অর্থ উপদেষ্টা বলেছে যে, মাত্র চার থেকে পাঁচটি ব্যাংক ভালো অবস্থানে আছে। অর্থ উপদেষ্টার উক্তি থেকে বলা যেতে পারে বর্তমানে ব্যাংক খাত নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে অবস্থান করছে। এ খাতকে দীর্ঘদিন ধরে পরিচর্যা করতে হবে। সংকটে থাকা ব্যাংক খাতকে নীতি সহায়তা দিয়ে স্থবিরতায় থাকা অর্থনীতিকে টেনে তুলতে হবে। ব্যাংক খাতকে টেনে উঠানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক তিনটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে। টাস্কফোর্স মূলত তিনটি কাজ প্রথমে করবে- (১) ব্যাংকগুলোর ক্ষতিগ্রস্ত সম্পদ নির্ণয় করবে (২) ব্যাংকগুলোর সম্পদ চিহ্নিত করবে (৩) ব্যাংকগুলোর সম্পদ পুনরুদ্ধার করবে।

আমরা সবাই জানি যে, মূলধনের অপর্যাপ্ততা, তারল্য সংকট, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, সুশাসনের অভাব, খেলাপি ঋণ, গ্রাহকের আস্থা নষ্ট হওয়ার মধ্যে দিয়ে সময় পার করছে ব্যাংক খাত। ব্যাংক খাতের অস্থিরতা এবং স্থবিরতার কারণে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। চলমান অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ দশমিক ৪১ শতাংশ। এর ফলে উৎপাদন বাড়ছে না, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না।

Advertisement

অর্থনীতিতে বেকারত্ব বাড়ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং কম প্রবৃদ্ধি। অর্থাৎ অর্থনীতিতে স্থবিরতা বিরাজ করছে। অর্থনীতির চাকা সচল হওয়া নির্ভর করছে ব্যাংকিং খাতের উত্তরণ। বিদ্যমান ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ অনুযায়ী, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে যে কোনো নির্দেশনা দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ। দুঃখজনক যে, বিগত ১৫ বছরে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এর ইউনিট অফিস হিসেবে কাজ করেছে। পূর্ণ স্বাধীনতার সাথে কাজ করতে ব্যর্থ হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এবারের মুদ্রানীতিতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এমনকি, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২ সংশোধনী করার প্রক্রিয়া চলছে। পাচারকৃত টাকা ফেরত আনার জন্য যৌথ অনুসন্ধানী দল গঠন করা হয়েছে। ডিসট্রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট করা হয়েছে। আরো ভালো সংবাদ যে, আমানতকারীদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এবং ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য ‘ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্স’ খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। ‘ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্স’ এর আওতায় দেশের দুর্বল ব্যাংকগুলো অবসায়ন করে ‘ব্রিজ ব্যাংক’ ধারণার প্রস্তাব করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে ‘ব্রিজ ব্যাংক’ ধারণা প্রতিষ্ঠা করা হবে।

ব্রিজ ব্যাংক হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বারা একটি ব্যর্থ ব্যাংক পরিচালনার তৈরি করা হয়, যতক্ষণ না ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যায়। বলা প্রয়োজন যে, ব্রিজ ব্যাংক ব্যর্থ ব্যাংকগুলোর আর্থিক অস্থিতিশীলতা মোকাবেলার সময় প্রয়োজনীয় ব্যাংকিং পরিষেবা নিশ্চিত করবে। ‘ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্স’ অনুযায়ী, সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা সুদৃঢ় করতে ব্যাংকের নতুন অথবা বিদ্যমান পরিচালকের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করা যাবে। এছাড়াও, আর্থিক খাতকে স্থিতিশীল, আমানতকারীদের সুরক্ষা ও সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর সুষ্ঠু পরিচালনা নিশ্চিত করা সম্ভব- ‘ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্স’ অনুযায়ী।

প্রধানত, ডিপোজিট প্রটেকশন অ্যাক্ট ২০২৫ অনুযায়ী, আমানতকারীদের সুরক্ষা দেওয়া হবে। ‘ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্স’ এর আওতায় “ব্যাংকিং সেক্টর ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কাউন্সিল” গঠন করা হয়েছে। এ থেকে বলা যায় যে, ‘ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্স’ ব্যাংকিং খাতের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে এসেছে। বিশ্বের বহু দেশে আর্থিক খাত বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত ছিল । এখনো আছে। কিন্তু বাংলাদেশে রাষ্ট্রের সহায়তায় যেভাবে ব্যাংক খাত/ আর্থিক খাত থেকে অর্থ লুটপাট এবং পাচার করা হয়েছে বিশ্বের কোনো দেশে এ ধরনের কাজ হয় নাই।

বাংলাদেশের মত একটা ব্যাংক নির্ভর অর্থনীতি এখন পুরোপুরি স্থবির। এজন্য অর্থনীতির বৃহৎ স্বার্থে “ব্যাংকিং সেক্টর ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কাউন্সিল” কে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কাজ করতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ’ কর্তৃক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা খর্ব না করে সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।

ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন না করে শুধু ‘ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্স’ দিয়ে কি ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? সামনের দিনে যেন ‘ব্রিজ ব্যাংক’ ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে না হয় সে জন্য এখন থেকেই সচেতন হতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকার এর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে এক সময়। রাজনৈতিক সরকার যদি দলীয় স্বার্থে ‘ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্স’ কে প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে ব্যাংক খাতে অস্থিরতা কাটবে না। ‘ব্রিজ ব্যাংক’ ধারণার সফলতা নির্ভর করবে “ব্যাংকিং সেক্টর ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কাউন্সিল এর উপর।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ( টিআইবি) এর সদস্য।

এইচআর/এএসএম