নদীমাতৃক বাংলাদেশে জারি, সারি বাউল ভাটিয়ালির সুর চিরচেনা। যে কোনো মানুষকেই তা আবেগে উদ্বেল করে। হৃদয়ের একূল ও কূল দুকূল ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু নদীর দেশে এখন কূল নাই কিনার নাই- এই ধরনের নদীর দেখা মেলা ভার। পলি ও বালু পড়ে নদীর নাব্য কমে যাওয়া এবং দখল দূষণে দেশের অধিকাংশ নদী এখন মৃতপ্রায়। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে নৌপথও। পাল্টে যাচ্ছে মানুষের জীবনধারাও। এক সময় ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য পণ্য পরিবহন থেকে শুরু করে যাতায়াতের অন্যমত মাধ্যম ছিল এই নৌপথ। ঝুঁকিমুক্ত এবং যাতায়াত ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত সহজ এবং সস্তা হওয়ায় নদী পথেই যাতায়াত করতো অধিকাংশ মানুষ। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কাছে নদী পথই ছিল অন্যতম ভরসা। কিন্তু কালক্রমে রেল ও বাস যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসায় নদীপথ নিদারুণ অবহেলার শিকার হয়। অথচ উন্নত বিশ্বে অপচনশীল দ্রব্য পরিবহনে নৌপথ বিশেষ গুরুত্ব পায়।
Advertisement
নৌপথে মালামাল পরিবহনের খরচ তুলনামূলক কম। এ কারণে আমাদের দেশেও এখনো নৌপথে যাতায়াত এবং পণ্য পরিবহন করা হয়। কিন্তু নদী পথের অবস্থা আজ অত্যন্ত শোচনীয়। নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) তথ্য মতে দেশে ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তীসময়ে দেশে এই পরিমাণ নৌপথ থাকলেও এরই মধ্যে প্রায় ১৮ হাজার কিলোমিটার নৌপথ বন্ধ বা প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এর মধ্যে বিগত দুই বছরে ৪০৭ কিলোমিটার নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে। শুকনো মৌসুমে নদীপথ কমে গিয়ে দাঁড়ায় মাত্র ৩৮০০ কিলোমিটারে।
নৌপথ বাঁচাতে হলে নদী ও খালগুলো রক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি জনপদের প্রাণ হচ্ছে নদী বা খাল। মানবদেহের শিরা-উপশিরার মতো এই নদী-খালবিলগুলো আমাদের বেঁচে থাকতে সহায়তা করে। সে কারণেই অবৈধ দখলদারদের হাতে এগুলোর অপমৃত্যু হলে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না।
বর্তমানে দেশে পাঁচ হাজার ৯৯৫ কিলোমিটার নৌপথের মধ্যে ১২-১৩ ফুট গভীরতার প্রথম শ্রেণির নৌপথ আছে মাত্র ৬৮৩ কিলোমিটার। সাত-আট ফুট গভীরতার দ্বিতীয় শ্রেণির নৌপথ আছে প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার। এবং পাঁচ ছয় ফুট গভীরতার তৃতীয় শ্রেণির নৌপথ আছে মাত্র এক হাজার ৮৮৫ কিলোমিটার।
Advertisement
যে টুকু নৌপথ আছে নাব্য সংকট থাকায় এর সেই পথ টুকুতেও নির্বিঘ্ন চলাচলের কোনো উপায় নেই। নদ-নদীতে অপরিকল্পিত সেতুও নৌযান চলাচলের অন্তরায়। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু কপোতাক্ষ নদে এখন পর্যন্ত ছোট-বড় ২১টি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০টি সেতুর উচ্চতাই কম। নৌযান চলাচলের মতো উচ্চতা রেখে এসব সেতু নির্মাণ করা হয়নি। একই অবস্থা অন্য নদীর ক্ষেত্রেও।
নাব্য সংকটের কারণে শুষ্ক মৌসুমে ফেরি চলাচলেও বিঘ্ন ঘটে। এ অবস্থায় ড্রেজিং যে কোনো মূল্যে নদীর নাব্য সংকট দূর করতে হবে। ড্রেজিং করে নাব্য সংকট দূর করার কথা বলা হলেও বিআইডব্লিউটিএ সেই দায়িত্ব কতটা পালন করছে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নৌপথ সচল রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত এই প্রতিষ্ঠানটি প্রয়াজনীয় ড্রেজারের অভাবের কথা বলে তাদের দায়িত্ব সারতে চায়।
নাব্য সংকট নতুন কোনো বিষয় নয়। প্রতি বছরই নদীতে পলি জমে নাব্য সংকট সৃষ্টি হয়। চর জেগে ওঠায় ফেরি ও নৌ-চলাচল বিঘ্নিত হয়। কিন্তু চিরকালীন এই সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার ঘাটতি রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, দুর্নীতি ও অনিয়মেরও। এ খাতে যে বাজেট বরাদ্দ থাকে সেটির সঠিক ব্যবহার হয় না। নামে মাত্র ড্রেজিং করেই কর্তৃপক্ষ দায় সারে। এতে টাকা খরচ হয় ঠিকই কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। আসলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া নদীর নাব্য সংকট দূর ও চ্যানেল চালু রাখা সম্ভব নয়।
দখল দূষণের কারণেও নদীপথ আজ বিলীন হওয়ার পথে। এমনকি খোদ রাজধানীর চারপাশের নদী খালগুলোও এই দখল দূষণ থেকে মুক্ত নয়। দখল দূষণ বন্ধে মাঝেমধ্যে অভিযান চালানো হলেও কিছুদিন পরই অবস্থা তথৈবচ। শিল্পকারখানার দূষিত বর্জ্য পানিতে মিশেও নদী দূষণ করছে। বিশেষ করে ট্যানারি বর্জ্যরে দূষণ নগরবাসীর জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার যেন কেউ নেই।
Advertisement
বুড়িগঙ্গাকে বলা হয় ঢাকার প্রাণ। কিন্তু দখল দূষণে এই নদীর অবস্থা এখন বড়ই করুণ। বিশেষ করে ট্যানারির বর্জ্য নদীর পানিতে মিশে নদীর পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হয়েছে। পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেছে। যে পরিমাণ অক্সিজেন আছে তাতে জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। বুড়িগঙ্গা নদীকে বাঁচাতে হলে ট্যানারি শিল্পের বর্জ্য যাতে নদীতে আর না পড়তে পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
নৌপথ বাঁচাতে হলে নদীখালগুলো রক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি জনপদের প্রাণ হচ্ছে নদী বা খাল। মানবদেহের শিরা-উপশিরার মতো এই নদী-খালবিলগুলো আমাদের বেঁচে থাকতে সহায়তা করে। সে কারণেই অবৈধ দখলদারদের হাতে এগুলোর অপমৃত্যু হলে এরচেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না।
অতীতে দেখা গেছে অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়। কিন্তু শুরু না হতেই অদৃশ্য হাতের ইশারায় তা বন্ধ হয়ে যায়। অনেক সময় স্বার্থান্বেষী মহল আদালতের রায় নিয়ে এসেও উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ রাখতে বাধ্য করে। আসলে নদী-খাল দখল করার জন্য একটি স্বার্থান্বেষী মহল সব সময় ওঁত পেতে থাকে। এদের হাত অনেক লম্বা। সব কিছু ম্যানেজ করে তারা অনায়াসেই দখল প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে।
কিছুদিন আগেও কল্যাণপুরের খালের বুকে নৌকা চলত। অথচ দখল-দূষণে এখন সেটি মৃতপ্রায়। খাল দখল করে গড়ে উঠেছে হাসপাতাল, সিএনজি স্টেশনসহ হাইরাইজ বিল্ডিং। এভাবেই রাজধানীর ৪৩টি খালের অধিকাংশই চলে গেছে দখলদারদের আয়ত্বে। অথচ পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখতে হলে নদী-খাল পুনরুদ্ধারের কোনো বিকল্প নেই।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সেই কবেই লিখেছেন ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ নামের কালজয়ী উপন্যাস। আমাদের নদীগুলো মানুষের অবিমৃষ্যকারিতার শিকার হয়ে যেন আজ ডুকরে ডুকরে সত্যি কাঁদছে। বালু ব্যবসায়ী, বিভিন্ন কোম্পানিসহ স্বার্থান্বেষী মহল দেশের নদীগুলোকে গলাটিপে হত্যা করছে। শুধু নদী পথ নয়, আমাদের সামগ্রিক জীবনধারাকে রক্ষা করতে হলে নদী বাঁচাতে হবে। আর নদী বাঁচলেই বাঁচবে নদীপথও। এই শুভবোধ যত তাড়াতাড়ি আমাদের মধ্যে জেগে উঠবে দেশ ও জাতির জন্য তা ততই মঙ্গল।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। ডেপুটি এডিটর, জাগো নিউজ।drharun.press@gmail.com
এইচআর/এএসএম/ফারুক