মতামত

আত্মশুদ্ধি মব ও নতুন পোশাক

 

কিছুদিন পূর্বে আইনশৃঙ্খলায় সেবাদানকারী বাহিনীগুলোর জন্য নতুন ধরনের পোশাক দেয়া হবে মর্মে দৈনিক পত্রিকাগুলোতে শিরোনাম প্রকাশের সাথে সাথে পাঠকদের প্রতিক্রিয়া ছিল দেখার মতো। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা, কড়া সমালোচনা-পাল্টা সমালোচনা, পরামর্শের ঢেউ যেন উথলে উঠতে শুরু করেছিল। এর একমাস গত হলেও এখনও নতুন পোশাক দৃষ্টিগোচর হয়নি। জনমতের সারকথা হচ্ছে- রঙিন কাপড়ের পোশাক দিয়ে কারো বৈশিষ্ট্য বদলানো যাবে না। চলমান মব সহিংসতা ঠেকাতে নতুন পোশাক কোনো দাওয়াই বা ওষুধ নয়। মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নতি না হলে ছিনতাই ও মব বাড়তেই থাকবে এবং সেবাদানকারী বাহিনীগুলোর আত্মশুদ্ধি ও নৈতিকতার উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে যেই লাউ, সেই কদু দৃষ্টিগোচর হতেই থাকবে।

Advertisement

শরীরে দামি কাপড়ের পরিষ্কার পোশাক না থাকলে অনেক জায়গায় মর‌্যাদা পাওয়া যায় না। শেখ সাদীর দাওয়াত খাবার সেই গল্পের কথা সবাই জানেন। একদিন মলিন পোশাক পড়ে দাওয়াত খেতে গেলে তাঁকে ভাল খাবার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। সেজন্য পরবর্তীতে তিনি দামী পোশাক পড়ে খেতে গেলে উন্নত খাবার পরিবেশন করা হয়। সেটা অবলোকন করে তিনি তিনি না খেয়ে নিজের পরিধান করা দামী পোশাকের পকেটে খাবারগুলো ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। তার এক বন্ধু এদৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে বিজ্ঞ শেখ সাদী উত্তরে বলেছিলেন- আজ দামী খাবার আমাকে দেয়া হয়েছে পোশাকের গুণে। তাই ওগুলো আমার রসনা তৃপ্তির জন্য নয়- এই পোশাকেরই প্রাপ্য।

প্রায় দু’বছর পূর্বে আমাদের এক বিমানবন্দরের মালামাল সেকশনের কর্মীদের পকেটবিহীন পোশাকের জন্য নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল। কর্মকর্তাদের পোশাকের মধ্যে পকেট থাকবে অঅথচ কর্মচারী তথা শ্রমিকদের পোশাকে পকেট থাকবে না, সে কেমন সন্দেহ ও অবিচার? এটা একটা বড় বৈষম্য ও অনৈতিক কাজ। তাহলে কর্মীরা কি সবাই চোর? তখন আমি পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। তার শিরোনাম ছিল-‘মন পকেটের কি হবে?’ তবে আমি এখনও জানিনা তারপর কি ঘটেছে বিমানবন্দরের লাগেজ হ্যান্ডলিং কর্মচারীদের ক্ষেত্রে।

আত্মশুদ্ধি না থাকলে কলুষিত মনের মানুষের নিকট দামী পোশাকের পকেট কীভাবে পরিশুদ্ধ অর্থকে স্থান দেবে? কোন মানুষের অবৈধ আয়ে কেনা খাদ্যসামগ্রী দিয়ে দেহে যে রক্ত-মাংস তৈরি হয় সেই দেহে একটি শুদ্ধ আত্মা থাকার ব্যাপারটা কল্পনাতীত। দেহ কলুষিত হলে তার আত্মা বদলানো বেশ কঠিন।

Advertisement

আমাদের দেশে বয়স্ক ব্যক্তি তথা ত্রিশ-চল্লিশোর্ধ চাকুরিজীবী মানুষের আত্মশুদ্ধি ঘটানোর জন্য অফিশিয়াল নির্দেশনা জারি করা হয়। বাঁশের কঞ্চি পেকে গেলে সেটা বাঁকা করতে পেলে ভেঙ্গে যায়। তাই শিশুকাল থেকে যে কোন মানুষের মধ্যে আত্মশুদ্ধির শিক্ষা দেয়া উচিত। প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি থেকে কাজে কর্মে, আচার-ব্যবহারে, পড়াশুনায় শিশুদেরকে নৈতিকতা শিক্ষা দিতে হবে।

আমাদের সমাজে চলমান যে ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য শিশুদের চোখে অবলোকন করার পর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে সেদিকে নজর দিয়ে শিশুশিক্ষা ও মোটিভেশনাল কর্মসূচির দিকে নজর দিয়ে শৈশব থেকে শিশুদের মন-মানসিকতাকে শুদ্ধ রাখার ব্যবস্থা করা জরুরি।

একাজে যেসব পরিবার অপারগ তাদেরকে সরকারী ব্যবস্থাপনায় নৈতিকতা উন্নয়নের কর্মসূচিতে আনার নীতি গ্রহণ করতে হবে। এরা বড় হয়ে পুলিশ, র‌্যাব, আনসার, ফায়ার ফাইটার, ডাক্তার তথা সামাজিক সেবায় সাহায্যকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে।

সম্প্রতি পুলিশ, র‌্যাব ও আনসার সদস্যদের পরিবর্তিত পোশাক চূড়ান্ত করা হলেও একদিনে সবার পোশাক পরিবর্তন করা যাবে না তাই ধীরে ধীরে তা কার্যকর হবে। গত ২০ জানুয়ারি ২০২৫ আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সম্মেলনে এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে এই পোশাক পরিবর্তনের কারণ হিসেবে বলা হয়, ‘এসব সদস্যদের মানসিকতার পরিবর্তন করতেই পোশাকের পরিবর্তন করা হচ্ছে। মনোবল বৃদ্ধি ও দুর্নীতিরোধসহ নানান বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।’

Advertisement

নতুন পোশাকে বড় ধরনের অর্থ সংকুলান হবে কিনা- প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে, ‘এ ধরনের কিছু হবে না। নিয়মিত এসব বাহিনীর সদস্যদের নতুন পোশাক তৈরি হচ্ছে। সে ধারাবাহিকতায় ধীরে ধীরে পরিবর্তিত পোশাক তৈরি হবে। এটার জন্য বাড়তি অর্থের খুব একটা দরকার হবে না।’

বলা হয়েছে, ’ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশের চরিত্র পাল্টে যাচ্ছে। গুলিতে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ নিহত হওয়ায় বেকায়দায় পড়েছে শীর্ষ অপরাধ নিয়ন্ত্রণকারী এ বাহিনী। অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশের ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক তথা আইজিপি থেকে শুরু করে কনস্টেবল- সব সদস্যের রদবদল হয়েছে। সম্পূর্ণ সংস্কারের জন্য গঠন করা হয়েছে কমিশন। কমিশন তাদের কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছে।’

আরো বলা হয়েছে, বিভিন্ন মহল থেকে পুলিশের পোশাক, মনোগ্রাম ও ক্যাপ থেকে নৌকার ছাপ পরিবর্তন করার দাবি উঠেছে। সংস্কার কমিশনও এ দাবির প্রতি একাত্মতা পোষণ করে পুলিশের পোশাক পরিবর্তনের প্রাথমিক সুপারিশ করেছে। পুলিশ কর্তৃপক্ষও চাচ্ছে পোশাক পরিবর্তন করতে। আইজিপি থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত একই ধরনের পোশাক পরিধান এবং মনোগ্রাম ও ক্যাপ (টুপি) থেকে নৌকা চিহ্ন পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

পুলিশ-সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্রিটিশ আমল থেকে পুলিশের পোশাক ছিল খাকি। অনেক আগেই পোশাকের রঙ বদলেছে। মহানগর ও জেলা পর‌্যায়ে দুই রঙের পোশাক দেওয়া হয়। তবে, পুলিশের ইউনিট ও ব্যাটালিয়নভেদে পোশাকের ভিন্নতাও রয়েছে।

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও স্পেশাল সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রোটেকশন ব্যাটালিয়নের (এসপিবিএন) পোশাক সম্পূর্ণ ভিন্ন রঙের। ২০০৪ সালে পুলিশের পোশাক পরিবর্তন করে মহানগরগুলোয় হালকা জলপাই রঙের করা হয়। জেলা পুলিশকে দেওয়া হয় গাঢ় নীল রঙের পোশাক। র‌্যাবের কালো ও এপিবিএনের পোশাক তৈরি করা হয় খাকি, বেগুনি আর নীল রঙের মিশ্রণে। এসপিবিএনের পোশাকের জামার রঙ করা হয় ধূসর রঙের। প্যান্টও ভিন্ন ভিন্ন রঙের। বর্তমানে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা এসব পোশাক পরেই দায়িত্ব পালন করছেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশসহ সারা দেশের পুলিশ সদস্যদের জন্য একই রকমের পোশাকের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পোশাকের হাতের অংশে রেঞ্জ, জেলা, ইউনিট ও মেট্রোপলিটন পুলিশের মনোগ্রাম থাকবে। নিজস্ব ফ্যাক্টরি থেকে কাপড় কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিগত ২০০৪, ২০১৬ ও ২০২১ সালে পুলিশের কয়েকটি ইউনিটের পোশাকের রঙ পরিবর্তন করা হয়েছিল।

মাঠ পর‌্যায়ের পুলিশ সদস্যদের অভিযোগ, পোশাকের কাপড় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিম্নমানের। এসব পোশাক সারাদিন পরে থাকা যায় না, গরম লাগে। অনেকে নিজের টাকায় ভালো মানের কাপড় কিনে পোশাক তৈরি করে থাকেন। আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতনদের পোশাকের কাপড়ের মান উন্নত। আর এসআই, এএসআই ও কনস্টেবলদের কাপড়ের মান নিম্ন। রঙেও ভিন্নতা রয়েছে।

সারা দেশের পুলিশ সদস্যরা একই ধরনের পোশাক যাতে ব্যবহার করতে পারেন সেজন্য ‘মেট্রোপলিটন, রেঞ্জ, জেলাসহ বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যদের পোশাক একই ধরনের হবে। পোশাকের ডান-বাম হাতের ওপরের অংশে শুধু ইউনিট, রেঞ্জ, জেলা ও মেট্রোপলিটন পুলিশের লোগো থাকবে। পুলিশের মনোগ্রাম থেকে নৌকা; ক্যাপ, ব্যাজ ও বেল্ট থেকে নৌকার সঙ্গে বইঠা বাদ দেওয়া হবে।’

বলা হয়েছে, ‘পরিদর্শক থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পুলিশের সরবরাহ করা পোশাক পান না; তারা পান পোশাক-ভাতা। পুলিশের পোশাক বিক্রির জন্য ঢাকাসহ সারা দেশে কিছু অনুমোদিত দোকান রয়েছে। কনস্টেবল থেকে উপ-পরিদর্শক পদবির কর্মকর্তারা বছরে দুটি করে হাফ-শার্ট ও প্যান্ট এবং একটি ফুল-শার্ট পেয়ে থাকেন। আইজিপি স্যার পুলিশের সব পোশাক একই ধরনের করার কথা বলেছেন। আমরা আশা করবো কাপড়ের মান যাতে উন্নত হয়। কোনো অভিযোগ যাতে না থাকে। পোশাকগুলো যেন একস্থান থেকেই আমরা সরবরাহ করতে পারি। তাহলে অপরাধীরা পুলিশের পোশাক পরে অপকর্ম করতে পারবে না।’

যত সংস্কার ও রঙের পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন পোশাক সরবরাহ হোক না কেন সেই পোশাক দিয়ে দেহের আবরণ হলেও মনের আবরণ হয় না। মনের আবরণ না থাকলে অপরাধ নির্মূল করা সহজ কাজ নয়। অপরাধ ঠিকভাবে নির্মূল করতে না পারলে গণ অনৈতিকতায় সমাজ ছেয়ে যায়। ঘুস-দুর্নীতির মহামারিতে জনজীবনে নেমে আনে দারুণ দুর্ভোগ যা সামাজিক বৈষম্যের গভীরতা সৃষ্টি করে। এ অবস্থায় অনৈতিকতার মহামারিতে চাকচিক্যময় ইউনিফর্ম বা বাহ্যিক পোশাক কোনো ওষুধ নয়। এগুলো দিয়ে চুরি ডাকাতি, অনিয়ম বৈষম্যকে আরো প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয় মাত্র।

যেমন ভোটচুরির জন্য বিগত দিনের অভিজ্ঞতা স্মরণ হলে ভোটারদের অন্তরাত্মা এখনও শুকিয়ে যায়! টাকা পাচারের ঘটনা অবাক করে দেয়। মাদক, কিশোর অপরাধ প্রবণতা, তার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর পড়ে।

সুতরাং, ক্রমাগত কূটতর্ক ভুলে দেশ ও সমাজকে অপরাধের অতল গহ্বর থেকে টেনে তোলার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে ঢেলে সাজানোর তাগিদে শুধু পোশাকের পরিবর্তন নয়- বরং চুলচেরা বিশ্লেষণ করার পর অতি জরুরি সংস্কার করার জন্য আগে একটি গণতান্ত্রিক সরকার ও শক্ত কমিটমেন্ট প্রয়োজন। এজন্য হঠকারিতামূলক তর্ক না করে অচিরেই জাতীয় নির্বাচনী ঐক্য গড়ে তোলা ও সিভিল ও আইনশৃঙ্খলায় সেবাদানকারী বাহিনীগুলোর আত্মশুদ্ধি ও নৈতিকতার উন্নয়নমূলক মোটিভেশনাল প্রোগাম দিয়ে নতুনভাবে প্রস্তত করা খুব জরুরি। কারণ একটি নিষ্কণ্টক ও ক্রেডিবেল নির্বাচনের সকল কাজে সকল পর‌্যায়ে পুলিশ, র‌্যাব ও আনসার সদস্যদের আন্তরিক ও কার্যকরী ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। fakrul@ru.ac.bd

এইচআর/এমএস