মতামত

উচ্চশিক্ষায় ভারসাম্যহীন মূল্যায়ন পদ্ধতি : কর্তৃপক্ষ ভাববেন কি?

মিলি সাহা

Advertisement

আমাদের দেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে খুব সাধারণ ও বহুল আলোচিত একটি অভিযোগ হলো শিক্ষার মান। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে পড়াচ্ছে এমন সহকর্মী বা ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে প্রায়ই এ বিষয়ে কথা হয়, বিতর্কও হয় আমার। সবারই একই কথা, এতো এতো বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে কিন্তু পড়াশুনার মান তো নিম্নগামী। আজকালকার ছেলেমেয়েরাতো কিছুই পড়ে না বলতে গেলে।

পরীক্ষার খাতায় ভালো লিখতে পারে মোটে পাঁচ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী! কেউ কেউ আবার অবকাঠামোগত অপ্রতুলতা; প্রশাসনিক দুর্বলতা; শিক্ষকদের আন্তরিকতা, শিক্ষা দান প্রক্রিয়া বা যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। যদিও আমি কখনোই আমাদের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে খুব নিরাশাবাদী নই, তবুও কিছু কিছু অভিযোগ অবহেলা করা যায় না। আমি আশাবাদী, কেননা এতো সীমাবদ্ধতার মধ্যেও অসংখ্য ছাত্র-শিক্ষক দেশে বিদেশে পেশাগত ও গবেষণা ক্ষেত্রে সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত নতুন সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাও পাশ করেই দেশে-বিদেশে যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছে। তবে হতাশার দিকটি হয়তো প্রচারে আসে না বলেই সমস্যার গভীরে পৌঁছে সমাধানের বিষয়টিও অনেকটা অন্ধকারেই থাকে।

প্রথমত, পেশাগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারাটাই একমাত্র অসফলতা নয়। আবার যেভাবেই হোক পাস করে নিজের স্বপ্নপূরণ করে ফেলতে পারাটাই শিক্ষার উদ্দেশ্য নয়। অন্তত যে কোনো শিক্ষা পরিকল্পনার উদ্দেশ্য তাই হওয়া উচিত নয়। অথবা, আমরা শুধু ৫-১০% ছাত্র-ছাত্রীর জন্য এতো বিশাল কর্ম-যজ্ঞের আয়োজন করি না। প্রকৃত লক্ষ্য পূরণের জন্য শিক্ষায় সম-বন্টন ও সম-অধিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বলাই বাহুল্য।

Advertisement

শিক্ষায় সামাজিক এবং নৈতিক দায়িত্ববোধ ও অধিকারের দিকটি উপেক্ষা করে ব্যক্তিগত অর্জনকে বড় করে দেখতে গেলেই শিক্ষার তাৎপর্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আশার কথা হলো, আমাদের ছাত্ররাই আজকাল শিক্ষার মান নিয়ে ভাবে এবং স্বীকার করে যে তারা মান সম্মত শিক্ষা গ্রহণ বা যথোপযুক্ত জ্ঞান অর্জন করছে না।

এসব কথা শুনে আমি হতাশ না হয়ে আরেকবার আশাবাদী হই, কেননা একজন শিক্ষার্থী নিজেই যখন বলবে আমি যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করিনি, তখন সে তার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা এবং তা অর্জনের কৌশল নিজেই খুঁজে নেবে। আর, এটাই আধুনিক শিক্ষাবিদদের গবেষণার মূল বিষয়। সক্রিয়-শিক্ষণ বা "এক্টিভ লার্নিং" এরও মুখ্য আলোচ্য বিষয়। তবুও আমরা শিক্ষক, শিক্ষাবিদ বা ব্যবস্থাপকরা আমাদের দায় এড়াতে পারিনা।

হতাশার জায়গাটি ভিন্ন। অনলাইন সামাজিক মাধ্যমের কল্যানে এখন ছাত্রদের অনেক সামগ্রিক বা ব্যক্তিগত বিষয় শিক্ষকদের নজরে আসে যা হয়তো আমাদের শিক্ষকদের অজানাই থাকতো এবং তার মধ্যে অন্যতম হলো, পাঁচ থেকে দশ শতাংশ বাদে বাকি নব্বই শতাংশ ছাত্র-ছাত্রীই বলতে গেলে শুধু মাত্র পরীক্ষার আগের কয়েকটি রাত পড়ে পরীক্ষায় বসে। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, পরীক্ষা বা প্রেজেন্টেশন না থাকলে খুব কম সংখ্যক ছাত্রই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রতিদিন পড়ার টেবিলে বসে।

বিশেষ করে পরিবারকে আর্থিক সাহায্য করে ও নিজের পড়ার খরচ চালিয়ে সঠিক নিয়ম মেনে পড়াশোনা করাটা এতো কঠিন যে চাইলেই ছাত্র-ছাত্রীদের একচেটিয়া দোষারোপ করা যায় না। তবে সেজন্য মান সম্পন্ন এবং পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন নিয়ে কোনো ভাবেই আপোষ চলে না। তবুও আর্থিক সীমাবদ্ধতা নয়, বরং ত্রূটিপূর্ণ গ্রেডিং সিস্টেম, পরীক্ষা নির্ভর মূল্যায়ন, 'লেকচার বেইসড' ক্লাস, অংশগ্রহন মূলক শিক্ষার অনুপস্হিতি, যথাযথ উৎসাহের (মোটিভেশন) অভাব ছাড়াও ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের সাথে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমন্বয়হীনতা এবং ইন্টারনেটে অহেতুক ব্যস্ততাই বর্তমানে অপর্যাপ্ত পড়াশোনার কারণ বলে আমি মনে করি।

Advertisement

সমাধানের পথ কঠিন নয়! কোনো একটি বিষয় নিয়ে গবেষণা না করে শুধুই পরীক্ষা বা বই মুখস্থ করতে দেয়াই আমাদের শিক্ষার নিম্ন মানের কারণ। পঞ্চাশ জনের একটি ক্লাসে প্রত্যেকটি ছাত্রের পড়া বা শেখার কৌশল এক হয় না, আবার সময় সীমাবদ্ধতার মধ্যে সৃষ্টি করার দক্ষতা ও সবার সমান হয় না। এবং "one size does not fit all"!

অন্যদিকে, গবেষণা ভিত্তিক মূল্যায়নের পথে বড় অন্তরায় হলো শ্রেণী কক্ষে অধিক ছাত্র সংখ্যা। এ প্রেক্ষিতে সরকার একধাপ এগিয়েছে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা তুলে দিয়ে। তবে ওপরের দিকে সেটা করতে গেলে যেসব বিকল্প মূল্যায়ন পদ্ধতি উন্নতদেশ গুলিতে সাধারণত গ্রহণ করা হয়, সেক্ষেত্রে আমরা বেশ বড় বাধার সম্মুখীন হবো। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অপর্যাপ্ত প্রযুক্তি, অবকাঠামো এবং শিক্ষার উপকরণের অপ্রতুলতার কারণে। তবে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সে সমস্যা তুলনামূলকভাবে কম।

বিভিন্ন ধরনের এসেসমেন্ট বা মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় সকল ছাত্র-ছাত্রী সমভাবে উপকৃত হয় এবং যেসব শির্ক্ষাথী মানসিক বা শারীরিক কারণে পরীক্ষার চাপ নিতে পারেনা তাদের ঝরে পড়ার আশংকা কমে যায়। এতে করে নকলের সুযোগও কমে, যদিও "প্লেজারিজম" বা বিভিন্ন উৎস থেকে লেখাচুরির প্রবণতা শুরুর দিকে বড় ইস্যু হলেও ক্রমান্বয়ে এই অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার উপায় আমরা পাবোই। এছাড়াও, শিক্ষায় সততার অনুশীলনের প্রতিফলন আমরা সমাজের প্রতিস্তরেই দেখতে পাবো।

প্রতি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্তকেও আমি ইতিবাচক ভাবেই দেখতে চাই। শুধু মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেই হয়তো আমরা একটি ক্লাসে সর্বোচ্চ ২০-২৫ জন ছাত্র পেতে পারি এবং তাতেই আমরা পরীক্ষা পদ্ধতি সরিয়ে গবেষণাধর্মী 'মৌলিক এসাইনমেন্টের' মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মেধা বা জ্ঞানের মূল্যায়ন করতে সক্ষম হবো। এতে করে প্রতিটি ছাত্রের সমস্যা আলাদা করে সমাধান করা সম্ভব হবে, যেটাকে আমরা "ইন্ডিভিজ্যুয়াল কেয়ার" বলি। উচ্চশিক্ষায় এতো বিভিন্নরকম মানসিক চাপ থাকে যে প্রত্যেকটি ছাত্র-ছাত্রীর আলাদা করে পরামর্শ দরকার হয়। এইসব কিছু নিশ্চিত করার জন্য ক্লাস সাইজ ছোট হওয়াটাই কাম্য। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে এটা আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন!

তথাপিও দুটো বিষয় না বললেই নয়। আমাদের গ্রেডিং সিস্টেমে ছাত্রদের উপস্থিতির জন্য যে ১০% নম্বর রাখা হয়েছে সেটাকে আরো একটু জ্ঞান-সংশ্লিষ্ট করা দরকার। সাধারণত বিদেশের যেসব ইউনিভার্সিটি গুলোতে শুধুই উপস্থিতির জন্য ৫-১০% মার্কস রাখা হয় না, বরং উপস্থিতির সাথে হোম-ওয়ার্ক এন্ড ক্লাস-ডিসকাশন এর মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটো বিষয় জড়িত থাকে। যেমন, টিউটর হয়তো একটি বা দুটি বিষয় ভিত্তিক রিসার্চ আর্টিকেল বাড়িতে পড়তে দিলেন এবং পরের ক্লাসে ছাত্ররা কয়েকজনের একটি দলে বা দুজনের দলে ভাগ হয়ে শিক্ষকের দেয়া নির্ধারিত কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিলো এবং নিজেদের সম্পর্কিত মতামত বা অভিজ্ঞতা আদান-প্রদান করলো।

যেহেতু এরকম গ্রুপ-ওয়ার্ক প্রতি ক্লাসেই হয় এবং এটি সক্রিয়-শিক্ষার (একটিভ-লার্নিং) অন্যতম একটি ধাপ, তাই একইসাথে উপস্থিতির সংখ্যা ও গণনা করা হয়। আমার মনে হয় না শুধুই উপস্থিতির জন্য ১০% মার্কস কোথাও দেয়া হয়, যদিও শুধু নম্বরের জন্য হলেও আমাদের ছাত্ররা আগের চেয়ে বেশি ক্লাসে উপস্থিত থাকে। তবে সবাই যে খুব মনোযোগের সাথে শিক্ষকের কথা শোনে, তাও নয়! প্রায় সব শিক্ষকই ছাত্রদের অমনোযোগিতা আর ক্লাসরুমে ফোনে ব্যস্ততার কথা বলেন। আমি এই মার্ক্স্ তুলে দেয়ার পক্ষে নই , শুধু এর সাথে ছাত্র-শিক্ষক সবার জন্য সুবিধা হয় এমন কিছু হোম-ওয়ার্ক ও ক্লাস-ডিসকাশন যোগ করতে চাই, যেন ছাত্ররা শুধুই প্রায়ই নিষ্ক্রিয় বা অমনোযোগী হয়ে বসে না থেকে অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রতিদিনের পড়াটা জেনে নেয়।

আমার মনে হয় না এতটুকু করা খুব কঠিন হবে এবং করতে পারলে ছাত্রদের জানার পরিধি নিশ্চিত হবে। তবে আমার অভিজ্ঞতা হলো বর্তমান পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের মাঝে শুধু বৈষম্যই সৃষ্টি করেনি, বরং ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করছে এবং শিক্ষক-ছাত্রকে মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছাত্রের ব্যক্তিগত সমস্যা বা আচার-আচরণে প্রভাবিত হয়ে নিয়ম বহির্ভূতভাবে মূল্যায়ন করার সুযোগ যেমন রয়েছে, তেমনি ছাত্র-ছাত্রীরা প্রত্যাশিত নম্বর না পেলে শিক্ষকদের অসম্মান করার সুযোগও পেয়েছে। এছাড়াও, প্রতি কোর্সে ১০% নম্বরের বাধ্যতামূলক একটি প্রেজেন্টেশন বা বক্তৃতা থাকলে ছাত্রদের নিজেদের গবেষণা ও মতামত আদান-প্রদান (রিসার্চ কম্যুনিকেশন) ছাড়াও ভাষাগত দক্ষতা বাড়তো। কেননা, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীদের পরবর্তী কর্ম-জীবনের জন্য প্রস্তুত করার বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, নতুবা ছাত্রদের পেশাগত-ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার দায় ও আমাদেরকেই নিতে হবে।

দ্বিতীয়তঃ শুধু পরীক্ষা তুলে দিলেই শিক্ষা সার্বজনীন হবে না। শিক্ষার মূল্যায়নে ভারসাম্য আনাও খুবই জরুরি। যেমন, ছয়মাসের একটি সেমিস্টারে আমরা সাড়ে পাঁচমাস ধরে মাত্র ৩০/৪০ নম্বর মূল্যায়ন করি, অন্যদিকে একটি মাত্র সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষায় মাত্র কয়েক ঘন্টায় ৬০/৭০ নম্বরের মূল্যায়ন হয়। এই একটি মূল্যায়ন দিয়ে আমরা একজন ছাত্রের প্রায় ছয়মাসের প্রচেষ্টার প্রতিবেদন তৈরী করতে পারিনা, কারণ বিশেষ ওই ক'ঘন্টায় প্রতিটি ছাত্রের মেধা বা পুরো সেমিস্টারের অর্জিত জ্ঞান পরিমাপ করতে পারি কিনা আমি নিশ্চিত নই। রাতারাতি হয়তো 'ক্লাস সাইজ' ছোট করে এসাইনমেন্ট দেয়া যায় না, তবে ৭০% নম্বরের ধারাবাহিক মূল্যায়ন হলে শিক্ষার্থীদের সারাবছরই সমানভাবে পড়াশুনা করতে হবে এবং যতটুকু জানা দরকার ততটুক হয়তো পড়বে।

উদাহরণস্বরূপ, চারটে কোর্স মিলে যদি প্রতি মাসে চারটে পরীক্ষা বা এসাইনমেন্ট থাকে তাহলে তো ছাত্ররা প্রতিদিনই কিছু না কিছু পড়বে।৭০% এর চূড়ান্ত মূল্যায়ন মানে হলো ওদেরকে আমরা একটি মাত্র সপ্তাহ দিচ্ছি প্রায় পুরো কোর্সটি পড়বার জন্য! এভাবে আমরাই তো 'ওভার-নাইট প্রেপারেশন' এর ব্যবস্থা করে দিয়েছি। আমি এও লক্ষ্য করেছি যে আমাদের যেসব ছাত্ররা ফাইনাল পরীক্ষার খাতায় সেই গৎবাধা সামারি লিখছে, সেই ছাত্রই কিন্তু মিডটার্মে বা প্রেজেন্টেশনে একেবারে মৌলিক বিশ্লেষণাত্মক উত্তর করছে! এর অর্থ হলো ছোট পরীক্ষায় তার স্ট্রেস বা চাপ কম হয়।

সর্বোপরি, অনলাইনে অযথা ব্যস্ত প্রজন্মকে পড়ার টেবিলে ফেরাতে হলে ৭০% নম্বরের ধারাবাহিক মূল্যায়ন আর ঝুঁকিপূর্ণ শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ করতে ৩০% নম্বরের চূড়ান্ত মূল্যায়ন করার কোনো বিকল্প নেই! এতে করে "স্পেশাল নীডস স্টুডেন্টস" দের জন্য যেমন সমান সুযোগ নিশ্চিত করা যায়, তেমনি সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও পরীক্ষা-ভীতি দূর করা সম্ভব।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

এইচআর/জেআইএম