যেন আসলেন, দেখলেন আর জয় করলেন। বলছি ক্রোয়েশিয়া জাতীয় ফুটবল দলের কোচ জ্লাতকো দালিচের কথা। মাত্র ৯টি মাস! বিশ্বকাপের আগে দালিচ নিজেও হয়তো কল্পনা করেননি যে, ফাইনালে থাকবে তার দল। কারণ, দলে তার কোচ হয়ে আসাটাই ছিল বড় এক ধাক্কা দিয়ে। যদিও সব প্রতিকূলতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিলেন ৫১ বছর বয়সী এই কোচ। কেননা তার দল যে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ জয়ের একেবারে দ্বারপ্রান্তে!
Advertisement
১৯৬৬ সালে বসনিয়া-হার্জেগোভিনাতে জন্ম নেন জ্লাতকো দালিচ। তবে ব্যক্তিগত কাজে ক্রোয়েশিয়া এসে নিয়েছেন ক্রোয়েশিয়ার নাগরিকত্ব। খেলেছেন ক্রোয়েশিয়া জাতীয় দলের হয়েও। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে ১৭ বছরের খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ারের ইতি টানেন ক্রোয়েশিয়ান ক্লাব ভারটেক্সের হয়ে।
খেলোয়াড়ি জীবনের সেরা সময়টা দালিচ কাটিয়েছিলেন এই ক্লাবেই। তবে যেখানে শেষ সেখান থেকেই যেন নতুনভাবে নিজের জীবন শুরু করলেন দালিচ। ভারটেক্সেই রয়ে গেলেন দলের সহকারী কোচ হিসেবে। সেখান থেকেই কোচিং জীবনের হাতেখড়ি দালিচের।
তার পরের গল্পটা তো পুরোপুরিই রূপকথার। কেননা, বিশ্বকাপের মত আসরে বিশ্বসেরা হিসেবে অনেকেই তো এসেছিলেন; কিন্তু সবাই তো আর নিজের দলকে ফাইনাল পর্যন্ত টেনে তুলতে পারেননি। সেখানে আগে বড় কোন ক্লাব বা দেশকে কোচিং না করিয়েই, মোটামুটি মানের একটা দল নিয়ে যে আজ বিশ্ব মঞ্চের ফাইনালে দালিচের ক্রোয়েশিয়া!
Advertisement
তবে ভারটেক্সের থাকতেই যেন সৌভাগ্য সওয়ার হয়েছিল তার কাঁধে। দুই বছর সহকারী কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর বনে গেলেন সরাসরি ক্লাবের স্পোর্টস ডিরেক্টর। ২০০২ থেকে ২০০৫- এই তিন বছর দায়িত্ব পালন করেছেন ক্লাবের স্পোর্টিং ডিরেক্টর হিসেবে।
তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, কোচিংকে যেন মাথা থেকে নামাতেই পারছিলেন না। স্পোর্টিং ডিরেক্টর থাকা অবস্থাই ২০০৩-০৪ এবং ২০০৪-০৫ দলের প্রয়োজনে কাজ করেছেন ক্লাবের সহকারী কোচ হিসেবেও। তখনকার ভারটেক্সের প্রধান কোচ ছিলেন মিরোস্লাভ ব্লাজেভিচ। তিনিও ছিলেন বসনিয়ায় জন্ম নেওয়া ক্রোয়েট নাগরিক।
তবে সহকারী কোচ হিসেবে আর কত দিন? পাকাপোক্তভাবে দালিচ নিয়ে নিলেন প্রিয় ক্লাব ভারটেক্সের দায়িত্ব। ২০০৫ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত- দুই বছর প্রধান কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দালিচ। সেখানে তার সাফল্য নেহায়েত কম ছিল না। দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম মৌসুমেই ভারটেক্সকে লিগে সেরা তিনের মধ্যে নিয়ে আসেন দালিচ।
ওই মৌসুমে নিজের ক্লাবকে ক্রোয়েশিয়া ফুটবল কাপের ফাইনালে তুলে তখনকার ক্রোয়েশিয়াতে কোচ হিসেবে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেন দালিচ। তবে শেষ রক্ষা হয়নি, জেতা হয়নি ক্রোয়েশিয়ার কাপের ফাইনাল। ফাইনালের প্রথম লেগে রাইজেকার কাছে ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত হলেও, দ্বিতীয় লেগে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ায় দালিচে শিষ্যরা। অবিশ্বাস্যভাবে ৫-১ এ ম্যাচ জিতে নেয় ভারটেক্স। তবে অ্যাওয়ে গোলের কারণে আর শিরোপা জেতা হয়নি তার দলের।
Advertisement
২০০৭ এ প্রিয় ক্লাব থেকে অব্যাহতি নিয়ে সেই রাইজেকার দায়িত্বই কাঁধে তুলে নেন দালিচ। তবে এখানে থিতু হতে পারলেন না। ওই মৌসুমে লিগে তার দল রাইজেকা চতুর্থ হয়ে মৌসুম শেষ করে। ফলে মাত্র এক মৌসুম কোচিং করিয়েই রাইজেকা ছাড়েন দালিচ।
এরপর কোচিং করাতে চলে আসেন আলবেনিয়ায়। আলবেনিয়ান ক্লাব ডাইনামো তিরানাতে যোগ দেন দালিচ। তিরানাকে জেতান আলবেনিয়ান সুপার কাপ। তবে যার মন ক্রোয়েশিয়ায়, সে কি করে অন্য কোথাও কোচিং করিয়ে যাবে! তিরানাতে সাফল্য পেলেও মাত্র এক মৌসুমই তাদের দায়িত্বে থাকেন ক্রোয়েশিয়ান এই কোচ।
পরের মৌসুমে আবারও ফেরেন ক্রোয়েশিয়াতে। দায়িত্ব নেন স্লাভেন বেলুপুতে। সেখানে দু’মৌসুম কোচিং করিয়ে নিজে উপলব্ধি করেন, দেশের বাইরেও চ্যালেঞ্জ নেওয়া উচিত। যেই ভাবা সেই কাজ, ২০১০-১১ মৌসুমে চলে আসলেন সৌদি আরবের ক্লাব আল-ফাইসালির কোচ হয়ে।
আল-ফাইসালির কোচ হয়ে এসেই পাল্টে দিলেন পুরো ক্লাবকে। প্রথম মৌসুমেই দলকে এনে দিলেন ক্লাব ইতিহাসের সেরা সাফল্য। সৌদি পেশাদার লিগের টিকিট পাইয়ে দেন এই ক্রোয়েট। পুরস্কার হিসেবে জোটে সে বছরের সৌদি পেশাদার লিগের সেরা কোচের স্বীকৃতি।
তবে কোথাও যেন এক মৌসুমের বেশি মন টেকে না দালিচের। দলকে নিয়ে সেরা খেলা উপহার দিলেও ২০১২ সালেই দালিচ যোগ দেন আরেক সৌদি ক্লাব আল-হিলালে। সৌদি আরবের খুব নামিদামি ক্লাব বিধায় আল-হিলাল ‘বি’ দলের হয়েই নিজের যাত্রা শুরু করেন দালিচ।
তবে ওই মৌসুমেই দলের প্রধান কোচ অ্যান্তোনি কম্বুয়ারে বরখাস্ত হলে আল-হিলাল কর্তৃপক্ষ দালিচের হাতেই তুলে দেন মূল দলের দায়িত্ব। নিজের সাফল্য যাত্রায় এবারও ভাটা পড়তে দিলেন না দালিচ। আল-হিলালকে জেতালেন টানা ষষ্ঠ সৌদি ক্রাউন প্রিন্স কাপ। সে বছর বিশ্বসেরা কোচদের তালিকায় ১৩তম স্থান অধিকার করেন ক্রোয়েশিয়ান এই মাস্টারমাইন্ড।
তার সাফল্যে মুগ্ধ হয়ে ক্রোয়েশিয়ার সেরা ক্লাব হাজদুক স্প্লিট তাদের স্পোর্টিং ডিরেক্টর হওয়ার প্রস্তাব দেয় দালিচকে। তবে এতো বড় ক্লাব পরিচালনার সুযোগ পেয়েও সে সুযোগ ছেড়ে দেন দালিচ। থাকেননি সৌদিতেও। চলে আসেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্লাব আল-আইনের কোচ হয়ে।
ক্যারিয়ারে কোথাও থিতু হতে না পারলেও এখানে এসে অবশেষে মন বসলো দালিচের। ২০১৪-তে আল-আইনের তৎকালীন কোচ কুইকে ফ্লোরেস চলে যাওয়ার পর দায়িত্ব পান তিনি। এখানে এসেও নিজের জাত চিনিয়েছেন দালিচ। ২০০৬-এর পর প্রথমবারের মত আল-আইনকে জেতান লিগ শিরোপা। এই ক্লাবে এসে নিজেকে আরও তুলে ধরেন। আল-আইনের হয়ে ঘরে তোলেন ইউএইএ প্রেসিডেন্ট’কাপ, এরাবিয়ান গালফ লিগ, এরাবিয়ান গালফ সুপার কাপ।
আল-আইনকে নিয়ে যান সাফল্যের চূড়ায়। ২০১৪ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত যেন একের পর এক সাফল্য হাতে ধরে নিয়ে আসছিলেন দালিচ। যখন দালিচ আল-আইনের দায়িত্ব নেন তখন বিশ্ব ক্লাব র্যাংকিংয়ে আল-আইনের অবস্থান ছিল ৩৩৫তম। তবে তিনি যেদিন আল-আইনের দায়িত্ব ছাড়বেন, সেদিন এই ক্লাবের অবস্থান এসে দাঁড়িয়েছিল ১২২-এ।
তবে কথায় আছে, উপরওয়ালা যাকে দেন তাকে যেন দু’হাত ভরে দেন। সে খাতায় নাম লিখিয়েই যেন পৃথিবীতে এসেছিলেন দালিচ। কোথাও কোচ বরখাস্ত হলে যেন সবার আগে দালিচের নামটিই আগে মনে পরে সবার।
২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের টিকিট পাওয়ার লড়াই। বাছাই পর্বে বেশ দুর্দান্তভাবেই শুরু করে ক্রোয়েশিয়া। তবে আইসল্যান্ড আর তুরস্কের কাছে হেরে যেন ধীরে ধীরে ফিকে হতে শুরু করে ক্রোয়েশিয়ার বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনাকে আরও ফিকে করে দেয় ফিনল্যান্ডের সাথে ড্র।
সাথে সাথেই দলের কোচ আনতে চাচিসকে বরখাস্ত করে ক্রোয়েশিয়া ফুটবল ফেডারেশন। জাতীয় দলের এই কঠিন সময়ে কে দায়িত্ব নিবে? চিন্তায় পড়ে যায় ক্রোয়েশিয়া ফুটবল ফেডারেশন। যেই কোচ হয়ে আসুক না কেন, শর্ত হচ্ছে দলকে পাইয়ে দিতে হবে বিশ্বকাপের সেই অমূল্য টিকিট। না হয় বিদায় নিতে হবে তাকে।
জীবনে যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখানেই সাফল্য পেয়েছেন দালিচ। সুতরাং, তার তো ভয় নেই মনে। আল-আইন ছেড়ে কাঁধে তুলে নিলেন দেশের দায়িত্ব। সমস্ত দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনাকে দূরে ঠেলে ক্রোয়েশিয়াকে পাইয়ে দিলেন রাশিয়া বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ। শর্ত অনুযায়ী তাই পেয়ে গেলেন কোচ হিসেবে স্থায়ী দায়িত্ব।
বাকিটা তো ইতিহাস। বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে তিন ম্যাচের তিনটিতেই জিতে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই নকআউট পর্বে পা দেয় ক্রোয়েশিয়া। যেখানে কিনা মেসির আর্জেন্টিনাকে ৩-০ গোলে নাস্তানাবুদ করার মত রেকর্ডও গড়ে ফেলেছে ক্রোয়েটরা। শেষ ষোলোয় ডেনমার্ক, কোয়ার্টার ফাইনালে স্বাগতিক রাশিয়াকে টাইব্রেকারে হারিয়ে সেমিতে ওঠে ক্রোয়েশিয়া।
এখানে দালিচের ভূমিকা কতটুকু, যিনি খেলা দেখেছেন তিনিই ভালো বলতে পারবেন। টানা দুটো ম্যাচ টাইব্রেকার। কে কে পেনাল্টি নেবে, সে সবসহ অসংখ্যা চিন্তা-ভাবনা বাধা-বিপত্তিকে দূরে ঠেলে দুটো টাইব্রেকেই জয় পায় ক্রোয়েশিয়া। এরপর সেমিতে শক্তিশালী ইংল্যান্ডকে বিদায় করে দিয়ে তো এখন ফাইনালে দালিচের ক্রোয়েশিয়া।
নকআউট পর্বে খেলা এখন পর্যন্ত তিন ম্যাচের তিনটিতেই শুরুতেই গোল খেয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে দালিচ এবং তার শিষ্যরা। কখনও হাল ছেড়ো না, এই যেন পুরো দলের মূল-মন্ত্র।
বেশি না মাত্র ৯ মাস! হ্যাঁ, এই নয় মাসে পাল্টে দিলেন পুরো একটি দলের চেহারা। একজন মানুষের জীবন একটি দেশের ইতিহাস। ২০১৭ অক্টোবর থেকে ২০১৮ জুলাই। ২০১৭ এর ৭ অক্টোবরে যখন ক্রোয়েশিয়ার দায়িত্ব নেন তখন হয়তো মনে মনে স্বপ্নে কল্পনা করছিলেন-ইস, যদি দেশকে আমি বিশ্বকাপ জেতাতে পারি!
এখন বিশ্বকাপ জয়ের আর একটি মাত্র ম্যাচ দূরে দাঁড়িয়ে দালিচ। সাফল্য তো তার হয়েই কথা বলছে। কেননা যেখানে গেছেন ছড়িয়েছেন আলো। সমৃদ্ধ করেছেন দলের ইতিহাস। তো হবে নাকি আবার? এবার আরও বড়, ব্যাপকভাবে। যদি তাই হয় তাহলে শুধু ক্রোয়েশিয়া ফুটবলই নয়, গোটা ক্রোয়েশিয়া ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হবে জলাতকো দালিচের নাম।
যেখানে তার নাম থাকবে এক সফল ফুটবল রূপকার হিসেবে। যেই দালিচ জাদুতে গড়পড়তা মানের একটি দল নিয়েও বিশ্ব ফুটবলের সেরার মুকুট বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফি হাতে মাত্র ৪২ লক্ষ জনসংখ্যার দেশ ক্রোয়েশিয়া।
এসএস/আইএইচএস/এমএমআর/পিআর