রশিদের বয়স মাত্র ১০ বছর। কিন্তু তার এই ছোট্ট কাঁধে চেপে বসেছে এক ভারী দায়িত্ব। ছয় বছরের ছোট বোন রশিদাকে দেখাশোনা করতে হয় তাকে।
Advertisement
রশিদ এবং রশিদা মিয়ানমার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসা পিতা-মাতাহীন ১৪ শ’ শিশুর দুজন। পশ্চিম রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্মম অভিযানে এই শিশুদের বাবা-মা হয় মারা গেছেন অথবা নিখোঁজ রয়েছেন।
বাবা জাহিদ হোসাইন ও মা রমিজা খাতুনের শোকে কাতর রশিদ। সে বলছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী তার বাবা-মাকে হত্যা করেছে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী জাতিগত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ইতিহাসের নৃশংস অভিযান চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন রোহিঙ্গারা। মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদেরকে তাড়িয়ে দিতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের সশস্ত্র একটি গ্রুপের হামলাকে কেন্দ্র করে এই অভিযান চলছে।
Advertisement
কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে শিশুদের নিয়ে কাজ করছে দ্য চাইল্ড ফ্রেন্ডলি স্পেইস (সিএফএস)। কুতুপালংয়ে এই সংস্থাটিতে আশ্রয় পাওয়া ৬০ জনের বেশি শিশু অঙ্কন ও খেলাধুলায় ব্যস্ত। রশিদ চুপচাপ এবং তার ক্ষীয় কণ্ঠ উল্লসিত শিশুদের হই-হুল্লোড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে।
গত ২৫ আগস্ট পর্যন্ত রাখাইনের মংডুর শিকদারপাড়া গ্রামে বাবা-মা ও ছয় ভাই বোনের সঙ্গে বসবাস করছিল রশিদ। ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইনের গ্রামে গ্রামে সেনাবাহিনী গণহত্যা ও জ্বালাও-পোড়াও শুরু করে; এই অভিযান থেকে বাদ যায়নি রশিদদের বাড়িও। জাতিসংঘ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই অভিযানকে ‘জাতিগত নিধনের পাঠ্য বইয়ের উদাহরণ’ হিসেবে মন্তব্য করেছে।
রশিদ বলছে, ‘সেদিন ছিল শুক্রবার। আমার বোনের হাত ধরে কাছের একটি পাহাড়ের দিকে ছুটলাম। সেনা সদস্যরা চলে যাওয়ার পর ফিরে এসে বাবা-মাকে মৃত দেখতে পাই।’
গ্রামে ফিরে শোকাহত হওয়ার মতো তা হাতে ছিল অল্প সময়। পাহাড়ের কাছেই তার প্রতিবেশিদের সন্ধান পায় রশিদ। বাকিপথ পাড়ি দেয়ার জন্য তাদের সঙ্গে ছুটে সে।
Advertisement
‘বাংলাদেশ সীমান্তে পৌঁছানোর জন্য অামি তিন রাত হেঁটেছি। ১ সেপ্টেম্বর ঈদের আগের দিন নাফ নদ পাড়ি দিয়ে আমি বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছি।’
অন্য ভাই-বোনদের কোনো খবর নেই রশিদের কাছে। ‘আমি শুনেছি আমার ভাই-বোনদের হত্যা করা হয়েছে।’ পাগলপ্রায় এই শিশু ছোট বোনসহ প্রতিবেশিদের সঙ্গে রয়েছে। ইউনিসেফের সহায়তায় সিএফএসে আশ্রয় হয়েছে অনেক শিশুর। ভয়াবহ ট্র্যাজেডির মহামারী বোঝার ক্ষমতা নেই এ শিশুদের অনেকেরই।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ফারিয়া আমিন আল-জাজিরাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে প্রথম দিন যখন সে (রশিদ) আসে, তখন বার বার সে আমার কাছে আসে এবং বলে, তার বাবা-মা মারা গেছে। তবে এখানে আসার কয়েকদিনের মধ্যে সে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।’
মিয়ানমারে স্কুল থেকে ছিটকে পড়েছে রশিদ। তবে সিএফএস’কে সে পছন্দ করে। সপ্তাহের ছয়দিনই খোলা থাকে রোহিঙ্গা শিশুদের সুরক্ষায় কাজ করা এই সংগঠন।
উখিয়া এবং টেকনাফে সিএফএসের ৪২টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে বলে জানান ফারিয়া। গত ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকেরই ঠাঁই হয়েছে সিএফএসের এসব কেন্দ্রে।
রশিদ বলেন, ‘এখানে আক্রান্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের ওপর নজর রাখারও সুযোগ নেই কারো। সকলে অবাধে সবকিছু করতে পারে এখানে।’
শিক্ষক হতে চায় রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা এই শিশু; যাতে সে ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা শিশুদেরকে শিক্ষার আলো দিতে পারে।
দিলারা বেগম (১১) ও আজিজা বেগমও (৯) তাদের বাবা-মাকে হারিয়েছে। বড় বোন এখনো আতঙ্কিত এবং কথা বলে না বললেই চলে।
আজিজা বলেন, ‘এটা ছিল দুপুরের খাবারের আগে। মা হামিদা বেগম আমাকে বাড়ির উঠানে খেলাধুলা করতে বলেন। যাতে আমার বাবা কাজের জন্য আমার বাবা (মাহমুদ হুসােইন) প্রস্তুত হতে পারেন।’
বোন দিলারা এবং মুশতাকিমের সঙ্গে যখন আজিয়া খেলতে শুরু করে; ঠিক তখনই সে গুলির শব্দ শুনতে পায়। মংডুর বারগোজিবিল গ্রামের পাশের একটি ঝোপ-ঝাড়ে দৌড়ে পালিয়ে যায় ভীত-সন্ত্রস্ত আজিজা। চোখের পানি মুছতে মুছতে আজিজা বলেন, ঝোপের আড়াল থেকে আমি দেখলাম, আমার বাবা-মাকে গুলি করছে সেনাবাহিনী। পরে তারা আমার বাবাকে জবাই করে। বড় একটি ছুরি দিয়ে আমার মায়ের পেটে আঘাত করে।
আজিজা আর ফিরে যায়নি। বিশৃঙ্খলার মধ্যে সে তার বোনকে হারিয়ে ফেলে। আমার বাবা-মার নিহত হওয়ার তথ্য জানার পর প্রতিবেশিরা আমাকে পালিয়ে আসতে সহায়তা করার প্রস্তাব দেয়। পরে কুতুপালংয়ে তার বোনের দেখা পায় আজিজা। গুলিবিদ্ধ মুশতাকিম মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। বর্তমানে চিকিৎসা নিয়ে সেরে উঠছে সে। হামলায় ৮ ভাই-বোনকে হারিয়েছে সে।
আজিজা বলেন, ‘বাংলাদেশে আসতে পেরে আমি খুশি। এখানে খুন হওয়ার কোনো ভয় নেই। আমার অনেক বন্ধু হয়েছে এখানে। ভালো সময় কাটছে আমার।’ কিছু হওয়ার জন্য সে এখন পড়াশোনা করতে চায় এবং নিজের সম্পর্কে জানতে চায়। সংক্ষেপিত।
আল-জাজিরা অবলম্বনে সাইফুজ্জামান সুমন
এসআইএস/জেআইএম