সম্পদের সুষম বণ্টন ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে জাতির জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এই বাজেট দিতে গিয়ে বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেও বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো সুনির্দিষ্ট দিশা দেখাননি। বরং মন্দা অভিমুখী স্থিতিশীলতা রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে। এতে সামনে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
Advertisement
সোমবার (২ জুন) জাতির সামনে বাজেট তুলে ধরে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আপাতত প্রবৃদ্ধির গতি বৃদ্ধির পরিবর্তে অর্থনীতির ভিত মজবুত করার দিকে আমরা অধিকতর মনোযোগ দিচ্ছি। এ শক্তিশালী ভিতই হবে আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের সোপান। আগামীর সেই বাংলাদেশে সবার জন্য মানসম্মত জীবন ও সব স্তরে বৈষম্যহীন ব্যবস্থার নিশ্চয়তা দেওয়া হবে আমাদের মূল লক্ষ্য।
তিনি বলেন, মাত্র অল্প কয়েক মাসে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশকে স্থিতিশীল করার কাজটি প্রায় সম্পন্ন করে আনা সম্ভব হলেও পরিপূর্ণ সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে আমাদের এখনো অনেকটা পথ পেরোতে হবে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাওয়ার প্রবণতা দেখা গেলেও তা এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
গত এপ্রিল মাসে মার্কিন প্রশাসন আরোপিত অতিরিক্ত শুল্কের নেতিবাচক প্রভাবও আমাদের অর্থনীতির ওপর পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে স্বীকার করেছেন অর্থ উপদেষ্টা। এছাড়া সম্প্রতি যে বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করা হয়েছে, তার কোনো নেতিবাচক প্রভাব আপাতত বাজারের ওপর পড়ার আশঙ্কা না থাকলেও এ বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, সব ঝুঁকি মোকাবিলা করে দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বৈষম্যহীন ও টেকসই ভিত্তি নিশ্চিত করা এখন আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
Advertisement
স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষা কমানো হয়েছেঅর্থ উপদেষ্টা অর্থনীতির জন্য একটি বৈষম্যহীন ও টেকসই ভিত্তি নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের কথা বললেও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে প্রস্তাবিত বাজেটে কর অব্যাহতি প্রত্যাহারের মাধ্যমে স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষা কমানো হয়েছে। রাজস্ব আয় বাড়াতে সুতা উৎপাদনে ভ্যাট ও লোকসানি প্রতিষ্ঠানেরও কর বাড়ানো হয়েছে। আবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্থান-স্থাপনা ভাড়ার উৎসে করও বাড়ানো হয়েছে।
‘বাজেটে বিনিয়োগ বৃদ্ধি বা কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো চেষ্টা করা হয়নি’অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশের মতে, বাজেটে বিনিয়োগ বৃদ্ধি বা কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো চেষ্টা করা হয়নি। মন্দা অভিমুখী স্থিতিশীলতা রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে এই বাজেটে। বাজেটের বেশিরভাগই আইএমএফের নির্দেশ অনুযায়ী বেল্ট আরও টাই করে ব্যয় আরও কমানো, সুদের হার বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যেগুলো সবই উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বেকারত্ব বাড়বে, দারিদ্র্য বাড়বে।
আরও পড়ুন
এবারের বাজেটে মানুষকে প্রাধান্য দিয়েছি: অর্থ উপদেষ্টা শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কৃষিতে বরাদ্দ কমানো উদ্বেগজনক: সিপিডিতিনি বলেন, ‘এই বাজেটের ফলে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়বে। তবে এই চাপ করারোপের কারণে সৃষ্টি হবে না। চাপ সৃষ্টি হবে সরকারের যেসব বিনিয়োগ করার কথা ছিল, সেসব জায়গায় এখন আর বিনিয়োগ করবে না। সরকারের বিনিয়োগ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ার কোনো সুযোগ নেই। আর বৈদেশিক বিনিয়োগ আসারও কোনো সুযোগ নেই। যেহেতু বিনিয়োগ আসবে না, সে জন্য চাপ সৃষ্টি হবে এবং বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বাড়বে।’
Advertisement
‘প্রাইমারির মিড ডে মিল-বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কালো আইন বাতিল ভালো উদ্যোগ’বাজেটের ভালো দিক হিসেবে তিনি বলেন, ‘প্রাইমারি স্কুল পর্যায়ে মিড ডে মিল দেওয়া হবে, এটা একটা ভালো প্রোগ্রাম। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কালো আইন বাতিল করা হয়েছে। একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ গ্যাসের ওপর জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ গ্যাস আহরণের জন্য জোর দেওয়া হবে, এটা নীতিগতভাবে ভালো সিদ্ধান্ত।’
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘বাজেটে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য কিছু পরিকল্পনা থাকলেও নীতি পর্যায়ে কার্যকর প্রতিশ্রুতি বা বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ার রোডম্যাপ অনুপস্থিত। কর সংস্কার, অর্থনীতির আনুষ্ঠানিকীকরণ, অবকাঠামো উন্নয়ন, ও আইনগত নিশ্চয়তা—এই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে সুস্পষ্ট কৌশলের অভাব রয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা দুর্বল করতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘এই বাজেটের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো বাস্তবায়নের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় অর্থবহ সংস্কারের অনুপস্থিতি। বাজেট বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়গুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রকল্প পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সমন্বয়ের উন্নয়ন এবং ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কোনো দিকনির্দেশনা নেই। ফলে বাজেট আবারও সংখ্যাভিত্তিক একটি কাগুজে অনুশীলনে পরিণত হয়েছে, যার মাধ্যমে কাঠামোগত পরিবর্তনের সম্ভাবনা অপ্রতুল।’
সম্পদের সুষম বণ্টন ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকারসম্পদের সুষম বণ্টন ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়া কথা বলে অর্থ উপদেষ্টা ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার যে বাজেট দিয়েছেন সেখানে সামগ্রিক ঘাটতি (অনুদান ব্যতীত) ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। আর অনুদানসহ সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা। এই ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা হবে ৩৯ হাজার কোটি টাকা। এতে নিট বৈদেশিক ঋণ দাঁড়াবে ৯৬ হাজার কোটি টাকা। আর অভ্যন্তরীণ ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ নেওয়া হবে ২১ হাজার কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধের ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ১ লাখ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণের সুদ ২২ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরবহির্ভূত কর ধরা হয়েছে ১৯ হাজার কোটি টাকা। আর কর ব্যতীত প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা।
দাম বাড়ছে যেসব পণ্যেররাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে সিলিন্ডার, প্লাস্টিকসহ একাধিক নিত্যপণ্যের কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে এসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে। এ তালিকায় রয়েছে- স্টেরাইল সার্জিক্যাল ক্যাটগাট ও সার্জিক্যাল স্যাটার, লিফট, সেট-টপ-বক্স, রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার, এসি, পলিপ্রোপিলিন স্ট্যাপল ফাইবার, হাইব্রিড গাড়ির ব্যাটারি, স্ক্রু, তার কাটা, নাট, বল্টু, জয়েস্টসহ বিভিন্ন পণ্য।
অর্থ উপদেষ্টা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে আগাম করের হার ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ নির্ধারণ করার প্রস্তাব করলেও বাণিজ্যিক আমদানিকারকের ক্ষেত্রে আগাম কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করেছেন। ফলে এক্ষেত্রে ব্যয় বাড়বে এবং পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবার অনলাইনে পণ্য বিক্রয় কমিশনের ওপর ভ্যাটের হার ১০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। ফলে অনলাইন কেনাকাটায় খরচ বাড়বে। সেল্ফ কপি পেপার, ডুপ্লেক্স বোর্ড বা কোটেড পেপারের ভ্যাটের হার দ্বিগুণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
অর্থ উপদেষ্টার নজর থেকে বাদ যায়নি ব্লেডও। ব্লেডের উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে কটন সুতা, কৃত্রিম আঁশে। সিগারেট পেপার আমদানিতে শুল্কহার দ্বিগুণ করা হয়েছে। বাচ্চাদের পছন্দের বিদেশি চকলেট ও নারীর ব্যবহার্য কসমেটিকস সামগ্রীর শুল্কায়নে ন্যূনতম মূল বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে বিদেশি চকোলেটের দাম বাড়বে। এছাড়া বিদেশি খেলনা আমদানিতে ট্যারিফ মূল্য সাড়ে তিন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৪ ডলার নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে বিদেশি খেলনা আরও দামি হবে।
এছাড়া বিদেশি জুস, নিউট্রিশনাল সাপ্লিমেন্ট, বেভারেজ কনসেনট্রেট, সয়া মিল্ক, ম্যান মেইড ফাইবার, কার্বন ফিল্টার, ম্যান মেড ফাইবার, টিভির জন্য এলইডি বাল্বসহ একাধিক পণ্যের আমদানি শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে বিদেশি জুস ও দুধের দাম বাড়বে।
প্রস্তাবিত বাজেটে দেশীয় টেক্সটাইল মিলে তৈরি সুতা উৎপাদনে ভ্যাটহার বাড়ানো হয়েছে। এতে চাপে পড়বে গ্যাস সংকটে ধুঁকতে থাকা টেক্সটাইল মিলগুলোতে। প্রতি কেজি কটন সুতা ও ম্যান মেড ফাইবারে তৈরি সুতার সুনির্দিষ্ট কর ৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ টাকা করা হয়েছে।
আরও পড়ুন
যেসব পণ্যের দাম কমতে পারে বাড়তে পারে যেসব পণ্যের দামপ্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক খাতেও করের বোঝা চাপানো হয়েছে। অব্যাহতির সংস্কৃতির পরিহার করতে রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার, পলিপ্রোপাইন স্টাপল ফাইবারের ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়া মোবাইল ফোন উৎপাদনে হ্রাসকৃত ভ্যাটহার বাড়ানো হয়েছে। এতে ইলেকট্রনিক্স শিল্পের সুরক্ষা কমবে, বিদেশি ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী আমদানি বাড়বে। পাশাপাশি ক্রেতার খরচ বাড়াবে।
গ্রামাঞ্চলে ব্যবহৃত সিমেন্ট শিট উৎপাদনে ৫ শতাংশ ভ্যাট আছে, এটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। স্টিল শিল্পের কাঁচামাল ফেরো ম্যাংগানিজ ও ফেরো সিলিকা ম্যাংগানিজ অ্যালয় উৎপাদনে টনপ্রতি এক হাজার টাকা ভ্যাট আছে, এটি এক হাজার ২০০ টাকা করা হয়েছে। ফেরো সিলিকন অ্যালয়ের ভ্যাট দেড় হাজার টাকা করা হয়েছে।
উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাটহার বাড়ানো হয়েছে হোম অ্যাপ্লায়েন্স বা গৃহস্থালি সামগ্রী উৎপাদনে। ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেকট্রিক ওভেন, ব্লেন্ডার, জুসার, মিক্সচার, ইলেকট্রিক কেটলি, আয়রন, রাইস কুকার, মাল্টি কুকার ও প্রেশার কুকার উৎপাদনে ২০২৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ৫ শতাংশ, ২০২৯ সালের জুন পর্যন্ত সাড়ে ৭ শতাংশ এবং ২০৩০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ১০ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। লিফটের ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করে উৎপাদনের জন্য উপকরণ ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে বছরভিত্তিক ভ্যাটহার বাড়ানো হয়েছে।
দ্বিগুণ হারে এক শতাংশ ন্যূনতম আয়কর শিল্পের লাভ-লোকসান যাই হোক বাজেটে দ্বিগুণ হারে এক শতাংশ ন্যূনতম আয়কর দিতে হবে। অবশ্য টার্নওভারের সীমা এক কোটি টাকা বাড়িয়ে ৪ কোটি টাকা করা হয়েছে। এই পদক্ষেপের ফলে ব্যবসা-শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ব্যবসা পরিচালনার জন্য রাজধানীর প্রায় সব প্রতিষ্ঠানকে স্থান-স্থাপনা ভাড়া নিতে হয়। স্থান-স্থাপনা ভাড়ার উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়ে। সাধারণত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকেই এই খরচ বহন করতে হয়।
ব্যবসার প্রচারণামূলক কর্মকাণ্ডের জন্য সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করতে কনভেনশন হল, কনফারেন্স সেন্টার ভাড়া নিতে হয়। এ ধরনের হল ভাড়ার উৎসে কর দ্বিগুণ করে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। স্থান-স্থাপনা ভাড়া বা কনফারেন্স সেন্টার ভাড়ার ওপর উৎসে কর বাড়ানোয় ব্যবসা খরচ বাড়বে। এছাড়া শিল্পের কর অবকাশ সুবিধাও বাতিল করা হয়েছে। বর্তমানে ৩১টি শিল্প খাত ১০ বছরের জন্য অঞ্চলভেদে ক্রমহ্রাসমান হারে কর অবকাশ সুবিধা ভোগ করছে।
অবশ্য অর্থ উপদেষ্টা করপোরেট করের শর্ত শিথিল, এলএনজি আমদানিতে ভ্যাট হ্রাস, শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে আগাম কর হ্রাস এবং কাস্টমসে মিথ্যা ঘোষণা জরিমানা কমিয়ে শিল্পে করের চাপ কমানোর চেষ্টা করেছেন। শিল্পের কাঁচামালের আগাম কর ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিধিবহির্ভূত রেয়াত গ্রহণের জরিমানা কমানো হয়েছে। নির্মাণ সংস্থা, জোগানদার ও সিএন্ডএফ এজেন্টদের ভ্যাট রিটার্ন জমার নেয়া প্রতিমাসের পরিবর্তে ৬ মাস করা হয়েছে। পাশাপাশি শিল্পের আগাম কর, রিফান্ড আবেদন, রেয়াত গ্রহণের সময়সীমা ৪ মাসের পরিবর্তে ৬ মাস করা হয়েছে। কাস্টমসে এইচএড কোড ভুলবশত মিথ্যা ঘোষণা কমিয়ে অর্ধেক করা হয়েছে।
কমছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ বেশ কিছু জিনিসের দামবাজেটে চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর শুল্ক কর কমানোর প্রস্তাবও দিয়েছে অর্থ উপদেষ্টা। এলএনজির আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। স্যানিটারি ন্যাপকিন, প্যাকেটজাত তরল দুধ, বলপয়েন্ট কলমের স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতির প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে কলম, প্যাকেটজাত দুধ ও স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম কমতে পারে। শিশুদের পছন্দের আইসক্রিমের দামও কমবে। পণ্যটির ওপর আরোপিত সম্পূরক শুল্কের হার ১০ শতাংশের পরিবর্তে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
ইন্টারনেট সেবা থেকে উৎসে কর কর্তনের হার ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। নানান সমালোচনার মুখেও কালো টাকা সাদা করার বিধান রাখা হয়েছে বাজেটে। জমি বিক্রেতার হাতে অপ্রদর্শিত অর্থ সৃষ্টি পরিহারের জন্য প্রকৃত বিক্রয়মূল্যে সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশনের লক্ষ্যে জমি হস্তান্তর থেকে কর সংগ্রহের বিদ্যমান মূলধনি মুনাফা করহার কমানো হয়েছে। এলাকাভেদে বিদ্যমান করহার ৮, ৬ ও ৪ শতাংশের স্থলে যথাক্রমে ৬, ৪ ও ৩ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে।
এদিকে জন্মসূত্রে বাংলাদেশি ছিলেন অথচ পরবর্তীসময়ে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করেছেন এমন ব্যক্তির বাংলাদেশে অর্জিত আয়ের ওপর যথাযথভাবে কর পরিশোধ না করে নানা উপায়ে বিদেশে পাচার করা অর্থ-সম্পদের ওপর কর ও জরিমানা আরোপের বিধান করার কথা জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা।
নতুন অর্থবছরের বাজেটে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা। পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে আবর্তক ব্যয় ৪ লাখ ৯৮ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। আর দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। এবার মূলধন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৬ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা। বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্কিমে ব্যয় হবে ৫ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। এডিপি বহির্ভূত বিশেষ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। আর কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি (এডিপি বহির্ভূত) ও স্থানান্তরে ২ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে সুদ পরিশোধেপ্রস্তাবিত বাজেটে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে সুদ পরিশোধের জন্য। পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে এ খাতের জন্য। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে শিক্ষা ও প্রযুক্তি। এ ক্ষতের জন্য বরাদ্দ ১৪ শতাংশ। সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়ার তালিকায় রয়েছে ভুর্তিক ও প্রণোদনা, জনপ্রশাসান এবং পরিবহন ও যোগাযোগ খাতও। বাজেটে ভুর্তিক ও প্রণোদনা খাতে ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ, জনপ্রশাসনে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ এবং পরিবহন ও যোগাযোগে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণে ৪ দশমিক ৭০ শতাংশ, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায় ৪ দশমিক ১০ শতাংশ, গৃহায়নে দশমিক ৭০ শতাংশ, বিনোদন সংস্কৃতি ও ধর্মে দশমিক ৮০ শতাংশ, শিল্প ও অর্থনৈতিক সার্ভিসে দশমিক ৫০ শতাংশ, পেনশনে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ, বিবিধ ব্যয় ৪ দশমিক ১০ শতাংশ, স্থানীয় সরকার ও পল্লি উন্নয়নে ৫ দশমিক ৭০ শতাংশ, জ্বালানি ও বিদ্যুতে ২ দশমিক ৯০ শতাংশ, স্বাস্থ্যে ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ, কৃষিতে ৩ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং প্রতিরক্ষায় ৪ দশমিক ৩০ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়ে অর্থ উপদেষ্টা খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মেয়াদ আগামী অর্থবছরে ৬ মাসে উন্নীত করার প্রস্তাব করেছেন। একই সঙ্গে বর্তমানে সহায়তাপ্রাপ্ত ৫০ লাখ পরিবারের অতিরিক্ত আরও ৫ লাখ পরিবারকে এর আওতাভুক্ত করার প্রস্তাব করেছেন। একই সঙ্গে বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধীদের ভাতা ৫০ থেকে ১০০ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদদের পরিবার ও আহতদের জন্য ৪০৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গণভবনকে ‘জুলাই স্মৃতি জাদুঘর’ করার কথাও উল্লেখ করেছেন অর্থ উপদেষ্টা।
‘এসো দেশ বদলাই’ স্লোগানে ‘তারুণ্যের উৎসব’ আয়োজন এবং উদ্যোক্তা তৈরির জন্য ১০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনের ঘোষণা এসেছে। সফল যুব উদ্যোক্তাদের ঋণসীমা বাড়ানো হয়েছে ৫ লাখ টাকায়। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের দক্ষ করে তুলতে কারিগরি প্রশিক্ষণে বিশেষ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গৃহিণীদের শ্রম মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। ভবিষ্যতে তাদের অবদান জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হবে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ১২৫ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দও রাখা হয়েছে। খাদ্য মজুতের সক্ষমতা বাড়িয়ে ৩৭ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত করার কথা বলেছেন অর্থ উপদেষ্টা।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে এক প্রায়-ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনৈতিক বাস্তবতা থেকে। মাত্র ১০ মাসের মাথায় মূল্যস্ফীতি কমানো, আইনশৃঙ্খলা ফেরানো, ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো এবং কর্মসংস্থানে গতি আনা—এই চারটি বড় চ্যালেঞ্জে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির দাবি করেছেন অর্থ উপদেষ্টা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবার একটি বাজেটের আকার আগের বছরের চেয়ে ছোট করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের পেছনে প্রবৃদ্ধি নির্ভর বাজেট দর্শন থেকে বেরিয়ে এসে মানুষকেন্দ্রিক উন্নয়ন ধারণাকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলেছেন অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, এই বাজেট আর শুধু উন্নয়ন খরচের খতিয়ান নয়, এটি মানুষ, মৌলিক অধিকার, নাগরিক সুবিধা আর শূন্য বৈষম্যের পরিকল্পনা।
এমএএস/এএসএ/এমকেআর