সাহিত্য

রিগনের শততম জন্মদিন আজ

আজ (৫ ফেব্রুয়ারি) ফাদার মারিনো রিগনের শততম জন্মদিন। একজন ধর্মযাজক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও সাহিত্যচর্চা, সমাজ সংস্কার, দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, চিকিৎসাসেবা ও বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখে তিনি আমাদের ঋণী করে গেছেন। শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০৯ সালে তাঁকে বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হয়।

Advertisement

জীবদ্দশায় এই ফাদারকে নিয়ে লিখেছেন দেশের প্রথিতযশা লেখক ও ব্যক্তিবর্গ। কবি আল মাহমুদ, আবদুল হাই শিকদার, অসীম সাহা, কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান, জাফর আহমেদ রাশেদ, শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার, সাংবাদিক সোহরাব হাসান, গবেষক ড. সাইমন জাকারিয়া, আবৃত্তিকার রবিশঙ্কর মৈত্রী প্রমুখ। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী, গণমাধ্যমব্যক্তিত্ব শফিক রেহমান, আলোকচিত্র শিল্পী নাসির আলী মামুন প্রমুখ।

যশোরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ফাদার মারিনো রিগন। ছবি: রিগন সেন্টারের সৌজন্যে

ফাদার মারিনো রিগন (৫ জানুয়ারি ১৯২৫-১৯ অক্টোবর ২০১৭) ছিলেন ইতালীয়-বাংলাদেশি জাভেরিয়ান ধর্মপ্রচারক। যিনি ‘বাঙালিদের বন্ধু’ নামে পরিচিত। রিগন ১৯২৫ সালে ইতালির ভিসেনজার ভিলেভারলাতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গ প্রদেশে চলে আসেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি সেখানে আশ্রয় দেন এবং আহতদের যত্ন নেন। তিনি ষাট বছর ধরে বাংলাদেশে ধর্মপ্রচারক হিসেবে বসবাস করেন। স্থানীয় ভাষা (বাংলা) ব্যবহার করে ক্যাথলিকদের মধ্যে গসপেল প্রচার করেন। বাংলাদেশের ক্যাথলিক চার্চে অসাধারণ অবদান রাখেন।

Advertisement

জসীমউদ্‌দীন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকর্ম ইতালিয় ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন ফাদার রিগন

ফাদার রিগন ১৯৯০ সালে ইতালিতে একটি রবীন্দ্র অধ্যয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বাংলা কবি এবং নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা অনুবাদের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চল্লিশটি রচনা ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ করেন। মরমী কবি লালন ফকিরের গান এবং জসীম উদ্‌দীনের নকশি কাঁথার মাঠসহ অনেক সাহিত্যকর্ম ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ করেন। অনেক বই পরে ফরাসি, স্প্যানিশ এবং পর্তুগিজ ভাষায় পুনরায় অনুবাদ করা হয়।

আরও পড়ুন গাভী বিত্তান্ত: একটি দুঃস্বপ্নের ক্যাম্পাস চিত্র  বেশি বিষণ্ন করেছে হেলাল হাফিজের ‘প্রস্থান’ 

জীবদ্দশায় তিনি বহু সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর সহায়তায় একটি বাংলাদেশি থিয়েটার দল ১৯৮৬ সালে ইতালিতে নকশি কাঁথার মাঠের গীতিনাট্য মঞ্চস্থ করে। ইতালীয় ফ্যান্টাসি ফিকশন বই ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অব পিনোচিও’ বাংলায় অনুবাদ করেন।

শিল্পকলা একাডেমিতে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল রিগনকে। ছবি: রিগন সেন্টারের সৌজন্যে

Advertisement

শিক্ষার প্রতি অনুরাগী ছিলেন। সতেরোটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানিত হোন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি গোপালগঞ্জের বানিয়ারচর চার্চে ছিলেন। অসুস্থ ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা ও চিকিৎসাসেবা দেন এবং সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশ নেন।

২০০৯ সালে ফাদার মারিনো রিগনকে সমাজে বিশেষ করে বাংলাদেশে তার অক্লান্ত ও অনুকরণীয় অবদানের জন্য বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। খুব কম বিদেশি এমন সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। ২০১২ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সমর্থন ও অবদানের জন্য তাঁকে ‘ফ্রেন্ডস অব লিবারেশন ওয়ার অনার’ পুরস্কার দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক দলকে পোপের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন রিগন। ছবি: রিগন সেন্টারের সৌজন্যে

স্বাধীনতার পর তিনি মোংলার শেলাবুনিয়াকে স্থায়ী আবাসে পরিণত করেন। ২০১৪ সালে তিনি হৃদরোগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর ভাই তাঁকে ইতালিতে নিয়ে যান। বায়ান্ন বছর বয়সে ফাদার রিগন ১৯ অক্টোবর ২০১৭ সালে ইতালির ভিসেঞ্জায় বার্ধক্যজনিত জটিলতায় মারা যান।

২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর বাংলাদেশের বাগেরহাটের মোংলার শেলাবুনিয়ায় সমাহিত করা হয়। তাঁর শেষ ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে মৃতদেহ তাঁর প্রতিষ্ঠিত গির্জার কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। এর আগে তুর্কি এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে মরদেহসহ কফিন ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়। গির্জায় তাঁকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। যেখানে মোংলা উপজেলা পরিষদ মাঠে সর্বস্তরের মানুষ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

এসইউ/জিকেএস/আরএমডি