ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়
Advertisement
গ্রিক উপকথায় অলিম্পিয়ান দেব-দেবীদের মধ্যে এথেনা দেবীর নাম পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন শুদ্ধতমা কুমারী দেবী। বিভিন্ন গ্রিক কাহিনিতে পাওয়া যায়—এথেনা দেবী জ্ঞান, ন্যায়বিচার ও পবিত্রতার দেবী। শান্তির প্রতীক হিসাবে তিনি ধারণ করতেন জলপাই গাছের ডাল।
আমি কেন দেবী এথেনার প্রসঙ্গ টেনে আনলাম? যাকে নিয়ে দুটো কথা লিখতে চলেছি—সেই রাইদাহ গালিবার সাথে কেন জানি একটা মিল খুঁজে পেয়েছি। চেহারা, অবয়বে, আচরণে, কথায়, অভিব্যক্তিত্বে—এত অল্প বয়সেই তার মধ্যে এই সমিল ও ব্যক্তিত্বের ছাপ পড়েছে। আমি তাকে কতটুকুইবা দেখেছি বা জেনেছি যে, তার সম্পর্কে এমন কথা বলছি?
বাংলাদেশ বেতারে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে কবি ও গল্পকার কানিজ পারিজাতের সাথে আলাপ ছিল। বইমেলায় তার প্রকাশিত একাধিক গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে আমি আমন্ত্রিত অতিথি ছিলাম। রাইদাহ গালিবাকে সেখানে দেখেছি মায়ের সাথে, মা কানিজ পারিজাত রাইদাহর সম্পর্কে বলতেন, তার লেখা গল্পের কথা বলতেন। তখন ‘শিশু’ পত্রিকায় প্রকাশিত রাইদাহর লেখা গল্প আমাকে পড়ার জন্য দিয়ে দেন।
Advertisement
আমি রাইদাহর গল্প পড়ে তো চমৎকৃত ও অভিভুত। এই এত অল্প বয়সে কী করে সে ধারণ করে গল্পের প্লট, কাঠামো, বুনন! কীভাবে এই কম বয়সী বালিকা রাইদাহর মাথায় এসব আসে? এ ব্যাপারে রাইদাহর মা কানিজ পারিজাত বলেছিলেন, তাকে কোনো কিছু দেখানোর চেষ্টা করেননি তিনি। রাইদাহর নিজ উদ্যোগেই শিশুদের উপযোগী চারটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। রাইদাহর লেখা শেষ গল্পটার প্রকাশিত বইটি আমি পড়ে দেখেছি—অসাধারণ তার ভাবনা ও সৃৃজন।
এই গল্পের বইটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে আমি যোগ দিয়েছিলাম এবং বইটি সম্পর্কে কথাও বলেছিলাম। কিন্তু ততদিনে রাইদাহ এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অন্য জগতে পাড়ি দিয়েছে! চিকিৎসার অবহেলায়, অব্যবস্থায় এই অকাল পরিসমাপ্তি ঘটলো! কী নিদারুণ শোকাবহ এক ঘটনা! আমি এখনো ভাবতে পারছি না, মেনে নিতে পারছি না! কাকে সান্ত্বনা দেবো—মাকে, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের? যার যায় এ কষ্ট শুধু তাদের বুকেই বাজবে! যতদিন বেঁচে থাকবেন তারা; ততদিন এই কষ্ট বহন করে চলবেন!
আরও পড়ুন
সবুজ জোনাকিটাকে খেয়ে ফেলেছে একটা দানব পাখি বেশি বিষণ্ন করেছে হেলাল হাফিজের ‘প্রস্থান’রাইদাহ তার ছাপা বইটি দেখে যেতে পারলো না। এটি ছিল তার প্রকাশিত চতুর্থ বই। এরপর তার আরও একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এ পর্যন্ত তার প্রকাশিত বইগুলো পর্যায়ক্রমে হলো—‘পটুর জাদু জুতা’, ‘এক যে ছিল মুচি’, ‘ইমা ও দৈত্য’, ‘ভয়ংকর গাছ’ এবং সবশেষটি ‘আন্ডোরে রাজ্যের কাহিনি!’
Advertisement
কানিজ পারিজাতের কাছেই শুনেছি—তিনি কখনোই রাহদাহ কী লিখবে, কোন বিষয়ে লিখবে—এ নিয়ে কোনো কথাই বলতেন না। কানিজের ও তার মেয়ের লেখালেখির জগৎ সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। কানিজের ভূমিকা ছিল রাইদাহর লেখা পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশকের কাছে পৌঁছে দেওয়া। রাইদাহর মাথার ভেতরে গল্পের প্লট সারাক্ষণই ঘুরপাক খেতো। ছোটবেলায় ছবি আঁকতো সে। তার এ বয়সেই একটি নিজস্বতা তৈরি হয়েছিল। তৈরি হয়েছিল ব্যক্তিত্ব। তার অবয়বে ছিল সহজ, সরল, সুন্দর এক স্বর্গীয় অভিব্যক্তি।
তাই তো রাইদাহকে সেই গ্রিক উপকথার শুদ্ধতমা কুমারী দেবীর সাথে তুলনা করেছি আজ। যেখানে শুদ্ধতা, পবিত্রতার প্রতিমূর্তি হলো রাইদাহ—যার জ্ঞান, বুদ্ধি ও ন্যায়বিচার তার এই ছোট্ট বুদ্ধিতে অভিব্যক্ত হতো, প্রতিলোকিত হতো।
তোমার লেখনী ও রচনার মধ্য দিয়ে শিশুসাহিত্যে তুমি জায়গা করে নিয়েছো। তুমি যেখানেই থাকো, শান্তিতে ঘুমাও। তুমি অমর, বেঁচে থাকবে আমাদের সবার মনে—চিরদিন তুমি, রাইদাহ!
লেখক: বাচিকশিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী।
এসইউ/এমএস