স্বাস্থ্য

প্রতি বছর নতুন করে ক্যানসার আক্রান্ত হয় ৫৩ জন

দেশে প্রতিবছর ক্যানসারে নতুন করে আক্রান্ত হয় ৫৩ জন। এছাড়াও প্রতি লাখে ক্যানসারের আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১০৬ জন। শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের কনফারেন্স রুমে বাংলাদেশে ক্যানসারের বোঝা: জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার রেজিস্ট্রি শীর্ষক এক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য দেওয়া হয়।

Advertisement

প্রাথমিকভাবে ২ লাখ ১ হাজার ৬৬৮ জন অংশগ্রহণকারী ৪৬ হাজার ৬৩১টি পরিবারের মধ্যে থেকে গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত হয়। যার মধ্যে ৪৮ দশমিক ৪ শতাংশ পুরুষ এবং ৫১ দশমিক ৬ শতাংশ নারী। মোট ক্যানসার রোগীর সংখ্যা ছিল ২১৪ এবং ক্যানসারের প্রাদুর্ভাব ছিল প্রতি ১ লাখে ১০৬ জন। আর পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রতি লাখে ১১৮ জন এবং নারীদের জন্য, প্রতি এক লাখে ৯৬ জন।

অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা) অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, নিত্যনতুন জ্ঞান তৈরিতে গবেষণার বিকল্প নেই। বিএসএমএমইউ থেকে সেই গবেষণায় পরিচালনা করা উচিত যা রোগীদের কল্যাণে কাজে আসে। যেসব গবেষণা দেশের মানুষের, দেশের রোগীদের উপকার হবে সে ক্ষেত্রে সরকারের সহায়তা অব্যাহত থাকবে।

বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক শাহিনুল আলম বলেন, গণআকাঙ্খা পূরণ করে এমন গবেষণার জন্য ফান্ডের কোনো সমস্যা হবে না। বিএসএমএমইউর উদ্যোগে পরিচালিত বাংলাদেশে জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার রেজিস্ট্রি থেকে যে পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে তা দেশের মানুষের ক্যানসার প্রতিরোধ, প্রতিকার ও ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসায় বিরাট ভূমিকা রাখবে। একই সঙ্গে এই পরিসংখ্যান বাংলাদেশে ক্যানসার নিয়ে গবেষণার বহুমুখী দ্বার উন্মোচন করেছে।

Advertisement

প্রধান গবেষক পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. খালেকুজ্জামান জানান, ক্যানসার বিশ্বে মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর একটি। বাংলাদেশে জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার রেজিস্ট্রি বা নিবন্ধন (পিবিসিআর) না থাকায় প্রতিবেশী দেশগুলোর তথ্য ব্যবহার করে ক্যানসারের পরিস্থিতি অনুমান করতে হয়। এর ফলে বাংলাদেশে ক্যানসারের সঠিক পরিস্থিতি জানার ব্যাপারে সীমাবদ্ধতা আছে। তাই জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার রেজিস্ট্রি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বা বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার নিবন্ধন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ক্যানসারের পরিস্থিতি নির্ণয় করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। এজন্যই এ গবেষণা পরিচালনা করা হয়।

তিনি জানান, কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলায় ২০২৩ সালের জুলাই মাস থেকে গবেষণাটি পরিচালিত হয়ে আসছে। এই গবেষণায় প্রত্যেক বাড়িতে বিশেষভাবে তৈরি করা ইন্টারনেট ভিত্তিক ক্যানসার নিবন্ধন সফটওয়্যার করে সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহণ করা হয়েছে। এক বছর পূর্তিতে একই পরিবারের ফলোআপ পরিদর্শন ২০২৪ সালের জুলাই মাসে শুরু হয়েছে।

ড. মো. খালেকুজ্জামান জানান, ২ লাখ মানুষের ওপর এই গবেষণা পরিচালন করা হয়। বাংলাদেশে ৩৮ ধরনের ক্যানসারের রোগী পাওয়া গেছে। প্রতি লাখে ১০৬ জন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। ৯৩ শতাংশ রোগীর বয়স ১৮ থেকে ৭৫ বছর। ক্যানসার রোগীদের মধ্যে ২.৪ শতাংশ শিশুরা রয়েছে। ৫.১ শতাংশ রোগীর বয়স ৭৫ বছরের বেশি। ৫টি প্রধান ক্যানসার হলো-স্তন, মুখ, পাকস্থলী, শ্বাসনালি এবং জরায়ু মুখের ক্যানসার। পুরুষদের ৫টি প্রধান ক্যানসার হলো শ্বাসনালি, পাকস্থলী, ফুসফুস, মুখ ও খাদ্যনালির ক্যানসার।

তিনি আরও বলেন, নারীদের ৫টি প্রধান ক্যানসার হলো স্তন, জরায়ুমুখ, মুখ, থাইরয়েড এবং ওভারি। পুরুষ ক্যানসার রোগীদের ৭৫.৮ শতাংশ ধুমপায়ী এবং ধোঁয়াহীন পান, জর্দা, তামাক সেবনকারী ৪০.৫ শতাংশ। ক্যানসার রোগীদের মধ্যে ৬০.৬ শতাংশ নারী ধোঁয়াহীন পান, জর্দা, তামাক সেবনকারী।

Advertisement

৪৬ শতাংশ রোগীর ক্যানসারের সঙ্গে তামাক সেবনের সম্পর্ক রয়েছে। ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৬০ শতাংশ কম্বাইন্ড চিকিৎসা নিয়েছে এবং ৭.৪ শতাংশ রোগী কোনো চিকিৎসাই নেয়নি। দেশে মোট মৃত্যুর ১২ শতাংশ ক্যানসারে আক্রান্ত রোগী। মৃত রোগীদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ফুসফুস, শ্বাসনালি ও পাকস্থলীর ক্যানসার। প্রতি বছর নতুন করে প্রতি লাখে ৫৩ জন রোগী ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ফুসফুস, লিভার ও শ্বাসনালির ক্যানসারের রোগীর সংখ্যা বেশি।

গবেষণায় জনসংখ্যা ৩৮টি বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত চিহ্নিত হয়েছে। এদের ৯২ দশমিক ৫ শতাংশ ক্যানসার রোগী ১৮ থেকে ৭৫ বছর বয়সী। ১৮ বছরের নিচে ২ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ৭৫ বছরের ঊর্ধ্বে ৫ দশমিক ১ শতাংশ ছিলেন।

ক্যানসার আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫টি ক্যানসার হলো- স্তন ক্যানসার মোট আক্রান্তর ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ, ঠোঁট/ মৌখিক গহ্বর ৮ দশমিক ৪ শতাংশ, পেট ৭ শতাংশ, গলা ৭ শতাংশ এবং জরায়ু ৫ দশমিক ১ শতাংশ।

পুরুষদের মধ্যে, গলার ক্যানসার আক্রান্ত সবচেয়ে বেশি ছিল ১৩ শতাংশ। অন্যান্য প্রধান ক্যানসার ছিল পেট ১০ দশমিক ৪ শতাংশ, ফুসফুস ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। ঠোঁট ও মৌখিক গহ্বর ৭ শতাংশ এবং খাদ্যনালি ৬ দশমিক ১ শতাংশ।

নারীদের মধ্যে, স্তন ক্যানসার ছিল সবচেয়ে সাধারণ ক্যানসার ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ। এছাড়া জরায়ুর ক্যানসার ১১ দশমিক ১ শতাংশ। ঠোঁট ও মৌখিক গহ্বরের ক্যানসার ১০ দশমিক ১ শতাংশ, থাইরয়েড ৭ দশমিক ১ শতাংশ এবং ডিম্বাশয় ৫ দশমিক ১ শতাংশ অন্যান্য প্রধান ক্যানসার ছিল।

নারীদের ক্যানসারে ১৯ শতাংশই নারী প্রজননতন্ত্রে ক্যানসারে আক্রান্ত। যেমন জরায়ু ক্যানসার ১১ শতাংশ, ডিম্বাশয় ৫ শতাংশ, এবং জরায়ু ৩ শতাংশ। ক্যানসার রোগের সঙ্গে রোগীদের ১৭ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপে, ডায়াবেটিসে ১১ শতাংশ, হৃদ্রোগ ৬ শতাংশ, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ ৩ শতাংশ, এবং স্ট্রোক ২ শতাংশ।

পুরুষ ক্যানসারে আক্রান্তদের ৭৫ দশমিক ৮ শতাংশ রোগী ছিলেন ধূমপায়ী। সর্বমোট ক্যানসারের ৪৬ শতাংশ তামাক (ধূমপান ও তামাকবিহীন) সেবনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। ৬০ শতাংশ ক্যানসার রোগী সার্জারি, কেমোথেরাপি এবং রেডিওথেরাপির সংমিশ্রণ চিকিৎসা পেয়েছিলেন। ৭ দশমিক ৪ শতাংশ রোগীকে কোনো চিকিৎসা দেওয়া হয়নি।

এছাড়া ফলোআপে গত ১ জুলাই ২০২৪ থেকে এ বছর ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৩ হাজার ৪১১টি পরিবারের ৫৮ হাজার ৫৩৯ জন অংশগ্রহণকারীর ফলোআপ করা হয়েছিল। এক বছরে নতুন ক্যানসার রোগীর সংখ্যা যুক্ত হয়েছে প্রতি ১ লাখে ৫২ দশমিক ৯ জন। নতুন সংযোজিত ৩টি প্রধান ক্যানসার হলো: ফুসফুস ১৬ দশমিক ১ শতাংশ, যকৃৎ ১২ দশমিক ৯ শতাংশ এবং গলা ১২ দশমিক ৯ শতাংশ।

পুরুষদের জন্য, নতুন সংযোজিত ক্যানসারের মধ্যে ৩টি প্রধান ক্যানসার হলো ফুসফুস ১৬ দশমিক ১ শতাংশ, যকৃৎ ১২ দশমিক ৯ শতাংশ এবং স্বরযন্ত্রের ক্যানসার ১২ দশমিক ৯ শতাংশ।

নারীদের নতুন সংযোজিত ক্যানসার হলো লিভার (যকৃৎ) ২৩ দশমিক ১ শতাংশ, জরায়ুর ক্যানসার ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ এবং খাদ্যনালির ক্যানসার ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ। মোট মৃত্যুর মধ্যে ক্যানসারে মৃত্যুর কারণ হলো ১১ দশমিক ৯ শতাংশ বা প্রায় ১২ শতাংশ। ক্যানসারে মৃত রোগীদের মধ্যে ছিল ফুসফুসে ক্যানসার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ, স্বরযন্ত্র (গলা) ক্যানসার ৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং পেট ক্যানসার ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। পুরুষদের মধ্যে মৃত্যুর প্রধান ২টি ক্যানসার হলো ফুসফুস ১৯ শতাংশ এবং স্বরযন্ত্র ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে মৃত্যুর প্রধান কারণ স্তন ক্যানসার ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ এবং পেট ক্যানসার ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ।

অনুষ্ঠানে বর্তমান জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার রেজিস্ট্রি স্থায়ী করার জন্য এই জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার নিবন্ধনটি সচল রাখতে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা, গবেষকদের বর্তমান রেজিস্ট্রি ব্যবহার করে ভবিষ্যতে ক্যানসার গবেষণা পরিচালনা করতে উৎসাহিত করার সুপারিশ করা হয়। এই গবেষণায় অর্থায়ন করে এনসিডিসি, ডিজিএইচএস এবং বিএসএমএমইউ।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শাহিনুল আলম। বিশেষ অতিথি ছিলেন উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ, উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক মুজিবুর রহমান হাওলাদার, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নাহরীন আখতার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. সৈয়দ জাকির হোসেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আতিকুল হক।

এএএম/এমআইএইচএস/জেআইএম