ভ্রমণ

বাই রোডে ভারতের লামাহাট্টা ভ্রমণে কীভাবে যাবেন, খরচ কত?

ইসতিয়াক আহমেদ

Advertisement

ঘোরাঘুরি করতে করতে এবার বেড়িয়ে পড়লাম ইন্ডিয়া ভ্রমণে। এ যাত্রায় আমাদের গাড়ি শ্যামলী পরিবহন এসপি সেকশনের ঢাকা হতে শিলিগুড়ি বাস। আরামবাগ হতে সন্ধ্যা ৬ টায় যাত্রা শুরু করে দেশের উত্তরের চিরচেনা বর্ডার বুড়িমারীতে পৌঁছালাম সকাল ৭টায়। বুড়িমারী চেংড়াবান্ধা বর্ডারের ইমিগ্রেশন চালুই হয় সকাল ৯টায়। তাই হাতে অনেক সময়, ফ্রেস হয়েই ব্রেকফাস্ট করে নিলাম।

যারা বাই রোডে ইন্ডিয়া ভ্রমণ করতে চান, তারা ট্রাভেল ট্যাক্স ঢাকা হতেই সোনালী ব্যাংক কিংবা অনলাইনেই প্রদান করেই আসতে পারেন। বর্তমানে ট্রাভেল ট্যাক্স প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ১০০০ টাকা। ৫-১২ বছর বয়সের শিশুদের জন্য ৫০০ টাকা ও ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য ট্রাভেল ট্যাক্স প্রযোজ্য নয়।

আরও পড়ুন: দুবাই ভ্রমণে যে ভুলে হতে পারে জেল-জরিমানা

Advertisement

আপনারা যারা ট্রাভেল ট্যাক্স না দিয়েই চলে আসবেন তাদের জন্যেও ট্যাক্স দেওয়ার সুযোগ আছে পোর্টেই। যারা সরাসরি কোনো বাসে আসেন না তাদের সহায়তা করার জন্য কিছু এজেন্সি আছে। তাদের সহায়তায় সহজেই কমপ্লিট করতে পারবেন ইমিগ্রেশন।

যাওয়ার সময়, বাংলাদেশ অংশে প্রথমে ইমিগ্রেশন তারপর কাস্টমস চেক, আর ইন্ডিয়া অংশে প্রথমে কাস্টমস চেক ও তারপর ইমিগ্রেশন। যারা চাকরিজীবী তারা অবশ্যই এনওসি সঙ্গে নিতে ভুলবেন না। যাওয়া ও আসা উভয় পথেই পাসপোর্ট ও ভিসার ফটোকপি প্রয়োজন পড়বে, তাই বেশি করে এসব নথির ফটোকপি নিতে ভুলবেন না।

বর্ডারে বেশ খানিকটা চাপ থাকায় আমরা ইমিগ্রেশন শেষ করে টাকা রুপি এক্সচেঞ্জ করে চড়ে বসলাম বাসে যখন, তখন দুপুর ১২টা প্রায়। এবার পালা চেংড়াবান্ধা হতে শিলিগুড়ি যাওয়ার। চেংড়াবান্ধা হতে শিলিগুড়ি প্রায় ৭৮ কিলোমিটারের পথ। চেংড়াবান্ধা বর্ডার মূলত কোচবিহার জেলার অন্তর্ভুক্ত আর শিলিগুড়ি হলো দার্জিলিং জেলার অংশ। আর তাই শিলিগুড়ি এসেই কেউ যদি বলে দার্জিলিং চলে এসেছি তবে তার কথাটি কিন্তু ভুল নয়।

আরও পড়ুন: রাজস্থান ভ্রমণে কী কী দেখবেন? 

Advertisement

শ্যামলি পরিবহন এসপি সেকশনের লাস্ট স্টপেজ মাল্লাগুড়ি মোড়ে। এনআর সেকশনে হুন্দাই বাস হলেও বর্ডার ও কাউন্টার সার্ভিসের দিক দিয়ে এসপি সেকশন বরাবরই অসাধারণ। বাস থেকে নেমে খানিকটা রেস্ট নিতেই চলে আসলো আমাদের গাড়ি।

ভারত ভ্রমণে বেশিরভাগ বাংলাদেশিরাই যান দার্জিলিং আর নয়তো সিকিমের গ্যাংটক। আর এ কারণে মোস্ট কমন এই দুই ট্যুরিস্ট স্পটেই প্রায় সারা বছর ট্যুরিস্টদের আনাগোণা লেগেই থাকে। তার মাঝে এখন যেহেতু ভরা মৌসুম তাই কিছুটা ভিন্ন জায়গায় রিল্যাক্স করার প্লান থেকেই এ যাত্রায় ঘুরতে বের হওয়া আমাদের।

তাই তো আমরা বেছে নিয়েছি অফবিট ডেস্টিনেশন লামাহাট্টাকে। আমাদের জন্য নির্ধারিত হোম স্টে আগে থেকেই বুক করা আছে লামাহাট্টায়। একপাশে পাইন বন আরেক পাশে গ্রেট কাঞ্চনজঙ্ঘা ভিউ। আর এই দুইয়ে মিলে মিশে যে স্থান তাই লামাহাট্টা। মাল্লাগুড়ি মোড় হয়ে সেভকের রাস্তা ধরে গেলে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরত্ব লামাহাট্টার।

আজকালকার শিলিগুড়ি এখন আর আগের মতোনেই, পথে মোড়ে মোড়েই জ্যাম। দুপুর ৩টায় যাত্রা শুরু করে শহর পেড়িয়ে সেভকের ফরেস্টের মাঝ দিয়ে ছুটছিলাম যখন, তখন তপ্ত উত্তপ্ত শহর পেরিয়ে বনের শীতল ঠান্ডা বাতাসে মনের সাথে সাথে প্রাণ ও জুড়িয়ে যাচ্ছিলো।

আরও পড়ুন: এক রাস্তা ধরে হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন ১৪ দেশে 

কিছুদিন আগেই ক্লাউন্ড বাস্ট হয়ে সিকিমের লোনাক লেকের প্রায় ১০০ হেক্টর গায়েব হয়ে যায়। লেকের পানি হরকাবান হয়ে নেমে আসে তিস্তা ধরে। হাইড্রো ইলেকট্রিক পাওয়ার প্লান্টসহ নদী বাঁধ রাস্তা সব কিছুই ধ্বংস করে দিয়েছিল তিস্তা।

যার সাক্ষী এখনো তিস্তা তীরের পথ জুড়ে ভেঙে যাওয়া রাস্তা, পথ জুড়েই ল্যান্ড স্লাইডের পাথর। সেই চিরচেনা সবুজাভ তিস্তা জুড়েই এখন কেবল বালুর স্তর। মনে করিয়ে দেয় আমাদের প্রকৃতির শক্তিমত্তাকেই।

পাহাড়ে সন্ধ্যা একটু জলদিই নামে, তাইতো কিছু পথ চলতেই নেমে এলো রাত। কালিম্পং হয়ে এবার ত্রিবেনি আর পেশকের চা বাগানের পাহাড়ি চড়াই উৎরাই ধরেই আমাদের ছুটে চলা। গতকাল সন্ধ্যায় বাসা থেকে বেড়িয়ে প্রায় ২৬ ঘণ্টা জার্নি শেষে আমাদের হোম স্টেতে এসে পৌঁছালাম সন্ধ্যা ৭ টার পার হয়ে গেছে।

অফবিট ডেস্টিনেশন লামাহাট্টা অন্যতম সেরা হোম স্টে গ্রিন ভিউ হোম স্টে। এই হোম স্টেতেই আমাদের জন্য আগে থেকেই বরাদ্দ ছিল তিন তলায় দুটো রুম। এই হোম স্টেতে রয়েছে মূলত ৪ টি রুম। ২টি তিনতলায়, ২টি প্রথম তলায়। আর ২য় তলায় মূলত ডাইনিং ও কিচেন। হোম স্টে হলেও পুরো পরিবেশ পাবেন নিজের মতন। কারণ খাবারের সময় ছাড়া নিচে না আসলে দেখা পাবেন না কারোরি।

আরও পড়ুন: যে দেশে ট্রলি ব্যাগ নিয়ে গেলেই গুনতে হবে জরিমানা 

গ্রিন ভিউ হোম স্টে’র প্রতিটি রুম ও খুবই সুন্দর পরিচ্ছন্ন ও অসাধারণ ইকো ফ্রেন্ডলি ইকুইপমেন্ট দিয়ে সাজানো। রুমে আছে ডাবল সাইজের বেড। সঙ্গে দুটো ডিভাইন, ড্রেসিং টেবিল, আলমিরা। পুরো রুমের দেয়াল ও মেঝে কাঠের পরোতে মোড়ানো।

যাতে ঠান্ডা কম অনুভুত হয়। প্রতি রুমের সঙ্গে পরিচ্ছন্ন ও সুবিশাল ওয়াশরুম। আছে গরম পানির ব্যবস্থাও। লামাহাট্টার ঠান্ডা একটু বেশিই, আমরা এসে পৌঁছালাম যখন, তখন প্রায় ১১ ডিগ্রিতে নেমে গেছে তাপমাত্রা যা রাত বাড়তেই নেমে গিয়েছিল ৮ ডিগ্রিতে।

প্রতিটি রুমেই আছে পর্যাপ্ত লেপ, কম্বল, কম্ফোটার এর ব্যবস্থা। একই সঙ্গে আছে এক বেলকনি। যে বেলকনিতে বের হয়েই দেখতে পাবেন হাজার হাজার জোনাকি। উহু জোনাকি নয় আসলে, পশ্চিমে দার্জিলিং, আর পূর্বে সিকিমের শহর গুলোতে জ্বলে থাকা বিজলি বাতির আলো। আর আকাশ ভরা কোটি তারা।

আরও পড়ুন: যে দেশের পুরুষরা ঘরের দেওয়ালে স্ত্রীর ছবি টাঙিয়ে রাখতে বাধ্য 

হোম স্টে তে আসতেই চলে আসলো খাবার গরম পানি, আর একটু পরে চলে আসলো গরম ধোঁয়া তোলা চা সঙ্গে পাকোরা। চা খেয়ে ফ্রেশ হয়ে রাতের শহর দেখতে বের হবার পালা। আমাদের হোম স্টে এর পাশেই আছে এক ভিউ পয়েন্ট। যেখান থেকে একই সঙ্গে দার্জিলিং থেকে নামচি, কিংবা সাউথ সিকিম পুরোটাই দেখা যায়।

পথে পথে অর্গানিক সবজি নিয়েই বসেছে অনেকে। রাতের শহর হেটে হেটে ঘুরেই রুমে ফেরা। চেয়েছিলাম কিছুটা দুরে থাকা বেঙ্গলী ক্যাফেতে একটু হাটতে হাটতে যাব রাতের কফি খেতে। কিন্ত এলাকার দাদারা নিষেধ করে দিলো এখন নাকি বাঘ বের হওয়ার সময় হয়েছে।

এখানের পাইন ফরেস্টে চিতা বাঘের আগানোনা আছে শোনা যায়। একই সঙ্গে ভাগ্য ভালো থাকলে হোম স্টেতেই দেখা পেতে পারেন হরিণ। বেশ বড় আকৃতির ফ্লাইং ফক্স দেখা পাওয়া যায় সেখানে। সন্ধ্যা নামতেই চারদিক শুনশান নিরবতা।

রাতগুলো আরও নির্জন এই লামাহাট্টায়। কোনো শোরগোল নাই, যেন জনমানবহীন এক প্রান্তরে শুধু আপনি আর আপনাকে ঘিরে আছে প্রকৃতি। রাতে শুধু কিছু আচেনা পোকার একটানা ডাক ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না।

আরও পড়ুন: বিশ্বের যে ৬ দেশে নাগরিকত্ব পাওয়া কঠিন 

হোম স্টের একদম সামন দিয়েই চলে গেছে পেশক রোড। যা কি না দার্জিলিং থেকে সিকিম বা কালিম্পং যাবার মূল রাস্তা। রাস্তার ধার জুড়েই লাল, নীল, বেগুনি, হলুদ নানান বনফুল ফুটে থাকে সব সময়। যদি আসতে চান লামাহাট্টা তবে মনে রাখবেন এখানে আসার সেরা সময় অক্টোবর-ডিসেম্বর।

এবার রাতের ডিনার করা পালা, ডিনারের আয়োজনে ছিল গরম ভাত, পাপড়, ডাল, সবজি, আলু ভর্তা আর মুরগির মাংস। এখানে আগে থেকে বলে রাখলে হালাল মুরগির ব্যবস্থা করে দেয় আন্টি। মূলত লামাহাট্টা পুরো জায়গা জুয়েই গড়ে ওঠা সব হোম স্টেগুলো একই পরিবারের।

কল হোম স্টে দোকান পাট এর মালিক একই পরিবারের ভাই বোনদের। বেশ কিছু মুসলিম অধিবাসী ও আছেন এখানে। তাই তাদের থেকেই মূলত হালাল মাংসের জোগান পাওয়া যায়। এমন কি আমাদের হোম স্টের মালিক যে আন্টি, তাকে রান্নায় মাঝে মাঝে হেল্প করেন যে আপু তিনিও বাঙালি ও মুসলিম।

আরও পড়ুন: এই শীতে ঘুরে আসুন মহামায়া ও বাওয়াছড়ায় 

রাতের খাবার খেয়ে এবার পালা সকাল হওয়ার। হোম স্টের আংকেল প্রথমেই বলে দিয়েছেন ভোর ৫টা ৪০ এর মাঝেই উঠে পড়তে। কারণ ৫ টা ৪৬ এ সূর্যোদয়। আমাদের রুমের বেলকনি থেকে দেখা যায়। সেই সূর্যোদয় যেন মিস না করি আরকি। ভোরের প্রথম আলো কাঞ্চনজঙ্ঘায় পড়ে যখন, তখন হালকা গোলাপি থেকে কমলা হলুদ হয়ে ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলিয়ে একদম চোখের সামনে ধারা দেবে কাঞ্চনজঙ্ঘা।

যে কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখার জন্য আমাদের বাংলাদেশিদের এতই না আকুতি মিনতি। সেই কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখাই পাওয়া সম্ভব এই হোম স্টে’র একদম বেড থেকেই। এই হোম স্টে এর সিজেনে ভাড়া জন প্রতি ১৫০০ রুপি। এই ১৫০০ রুপিতে রাত থাকার সঙ্গে সঙ্গে মিলবে সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার, সন্ধ্যার নাস্তা ও রাতের ডিনার। একই সঙ্গে আনলিমিটেড কাঞ্চনজঙ্ঘা।

প্রতিদিনের ব্যস্ত জীবনের কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে ঘুরে আসতে পারেন দার্জিলিং এর চাকচিক্য থেকে অনেক দূরে শেরপাদের গ্রাম লামাহাট্টায় (স্থানীয় উচ্চারণ-এ লামাট্টা)। ৫৭০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই গ্রামে তামাং, ভুটিয়া, ডুকপা ইত্যাদি পার্বত্য উপজাতির বাস।

তিব্বতী লামাদের ভারত সরকার এইখানে বসবাসের ব্যবস্থা করায়, সেই থেকে জায়গার নাম লামাহাট্টা। এ যেন রূপ-বৈচিত্রের সম্ভার। পাইনের জঙ্গল, পাহাড়, আকাশ, নিরবতা আর গ্রামবাসীর সরলতা এখানে মিলেমিশে একাকার।

আরও পড়ুন: বরফে ঢাকা পাহাড়ি গ্রাম দেখতে ঘুরে আসুন লাচুং 

কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য

>> ঢাকা হতে শিলিগুড়ি বাস ভাড়া ২০০০ টাকা>> শ্যামলী পরিবহন শিলিগুড়ি বাস কাউন্টারের নম্বর (+৯১ ৯১৫৩০৩৭৯৭০)>> গাড়ি ড্রাইভার সঞ্জয় দা’র নম্বর ( +৯১ ৭০২৯২৮৩৪৮২)>> গ্রিন ভিউ হোম স্টে, লামাহাট্টা (+৯১ ৮৯৭২১৯৫৩১৪)

লামাহাট্টা ভ্রমণ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে ইউটিউবে দেখতে পারেন ‘Letter From North’ নামক চার পর্বের এক সিরিজ ভ্লগ। সেখানে সব খরচ, যোগাযোগের নাম্বার ও যাওয়ার উপায় বিস্তারিতভাবে দেওয়া আছে। ভ্লগগুলো দেখতে এখানে ক্লিক করুন

জেএমএস/জিকেএস