সাহিত্য

আল মাহমুদের কবিতা: প্রেমের নতুন রূপ

ভালোবাসা, যৌনতা এবং নস্টালজিয়া ইত্যাদি গুণ আল মাহমুদের প্রেমের কবিতার নান্দনিকতায় অনন্য রূপ নিয়ে বিশ্বপাঠকের হৃদয় দখল করেছে। তিনি কবিতায় প্রেম এবং স্মৃতি, আবেগ এবং নস্টালজিয়ার কাহিনি নিয়ে পাঠককে সঙ্গ দেন। প্রিয় নারী, প্রকৃতির গান, স্বর্গীয় গতিবিধি, প্রতিটি উপাদানের মধ্যে জীবনকে স্পন্দিত ও উদ্ভাসিত করে। কবির কাছে নারী হলো অত্যাবশ্যকীয় নীতি, অঢেলতার স্মৃতি। নারীর শক্তি, প্রেমের শক্তির বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে মাহমুদের কবিতা পেয়েছে ক্ল্যাসিক মর্যাদা।

Advertisement

আল মাহমুদের অমর কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালি কাবিন’ সমকালীন বাংলা কবিতার একটি বাঁকের নাম। এ কাব্যগ্রন্থে মোট ৪১টি কবিতা রয়েছে। এরমধ্যে ১৪টি সনেটের সমন্বয়ে ‘সোনালি কাবিন’ কবিতা। তিনি যদি এই একটি কাব্যগ্রন্থ রেখে যেতেন, তাতেও বাংলা কবিতাজগতে আলোচিত হয়ে থাকতেন। ‘সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী/ যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দুটি’-এক নম্বর সনেটটি। ‘সোনালি কাবিন’ কবিতাটির শুরুই হয়েছে কী সুন্দর শব্দাবলির পঙক্তি দিয়ে। মানুষ যেমন গল্প শুনতে আগ্রহী; তেমনই ঐতিহ্য অনুসন্ধানেও আগ্রহী। মানুষের ঐতিহ্যসন্ধান মূলত অস্তিত্ব অনুসন্ধান করা। মানুষ স্বভাবতই সামাজিক জীব। সমাজের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ নিয়েই গড়ে ওঠে তার সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতির সাথে মিশে আছে তার লৌকিক, সামাজিক, রাজনৈতিক জীবনাচরণ। কবি আল মাহমুদও ব্যতিক্রম নন। সাহিত্যিকরা এমনই।

কবি আহসান হাবীব আধুনিক বাংলা সাহিত্যে লোকজ উপাদান ব্যবহারের সূচনা করেন। তবে তাতে ব্যাপকতা দান করে পূর্ণতা দিয়েছেন শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ। শহরনির্ভর কবিতা থেকে বের হয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন আধুনিক পল্লিনির্ভর কবিতা। ‘সোনালি কাবিন’ থেকে কিছু অংশ— ১. এ-তীর্থে আসবে যদি ধীরে অতি পা ফেলো সুন্দরী,/ মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে এ-মাটির গায়,/ ছিন্ন তালপত্র ধরে এসো সেই গ্রন্থ পাঠ করি/ কত অশ্রু লেগে আছে এই জীর্ণ তালের পাতায়। (সোনালি কাবিন-৪)২. আমার ঘরের পাশে ফেটেছে কি কার্পাশের ফল?/ গলায় গুঞ্জার মালা পরো বালা, প্রাণের শবরী,/ কোথায় রেখেছো বলো মহুয়ার মাটির বোতল’ (সোনালি কাবিন-৫)৩. অঘোর ঘুমের মধ্যে ছুঁয়ে গেছে মনসার কাল/ লোহার বাসরে সতী কোন ফাঁকে ঢুকেছে নাগিনী,/ আর কোনদিন বলো, দেখবো কি নতুন সকাল?/ উষ্ণতার অধীশ্বর যে গোলক ওঠে প্রতিদিনই। (সোনালি কাবিন-৮)৪. শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতেরা উঠিয়েছে হাত/ হিয়েনসাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা,/ এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত/ তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকোমা। (সোনালি কাবিন-১০)৫. বৃষ্টির দোহাই বিবি, তিলবর্ণ ধানের দোহাই/ দোহাই মাছ-মাংস দুগ্ধবতী হালাল পশুর,/ লাঙল জোয়াল কাস্তে বায়ুভরা পালের দোহাই/ হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোন কবি করে না কসুর। (সোনালি কাবিন-১৪)

নারী প্রেমিকা; নারী শক্তির উৎস। কিন্তু নারীর অসহায়ত্ব নিয়ে কবি আল মাহমুদ লিখলেন, ‘দীর্ঘ পাতাগুলো না না করে কাঁপছে। বৈঠকখানা থেকে আব্বা/ একবার আমাকে দেখে নিয়ে মুখ নিচু করে পড়তে থাকবেন,/ ফাবি আইয়ে আলা ই-রাব্বিকুমা তুকাজ্বিবান...’ (প্রত্যাবর্তনের লজ্জা: সোনালি কাবিন)। আল মাহমুদের কবিতায় প্রেম এসেছে নর-নারীর জীবনযাত্রার আলোকে, কখনো শরীরী প্রেমের খোলামেলা প্রকাশে। প্রথম পর্যায়ে আল মাহমুদের কবিতায় লোকঐতিহ্যের প্রয়োগ হয়েছে বিচিত্রভাবে এবং পরিমাণের দিক থেকেও তা অসামান্য।

Advertisement

আল মাহমুদের কবিতার বিষয়বস্তুতে প্রথমদিকে গ্রামের জীবন, বামপন্থি চিন্তাধারা এবং নারী মুখ্য হয়ে ওঠে। নদীনির্ভর জনপদ ও প্রকৃতির যে চালচিত্র কবি এঁকেছেন, তা বাংলাদেশের লোকজীবনের এক মৌল অংশ। সোনালি কাবিনের চৌদ্দটি সনেটে নারীকে উদ্দেশ্য করে উচ্চারিত কবির নিজস্ব প্রেমানুভূতির প্রাধান্য রয়েছে। আবহমান বাঙালি-সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ, মিথ, সাহিত্য ও সমাজের নানা বিষয়াদি রয়েছে। তাঁর প্রেম, বিপ্লব, ইতিহাস এবং সময়ের ধারণাগুলো সোনালি কাবিনে সবচেয়ে শৈল্পিক, পরিণত এবং ভারসাম্যপূর্ণ অভিব্যক্তি খুঁজে পায়। তিনি শেক্সপিয়রীয় মডেল অনুসরণ করে অসংখ্য শক্তিশালী সনেট লিখেছেন।

প্রেম গভীরভাবে নিহিত আছে আল মাহমুদের কবিতায়। ১৯৭৪ সালের পর আল মাহমুদ কৌশলে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। পূর্বে হিন্দু এবং ইসলামি উভয় লোকজ এবং ধর্মীয় উপাদানের রেফারেন্সের একটি নিখুঁত সংমিশ্রণ ছিল কিন্তু ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ বখতিয়ারের ঘোড়ায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, একটি ধর্মীয় ভিত্তি দ্বারা এবং মার্কসবাদী মতাদর্শের দ্বারা প্রাথমিকভাবে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। প্রেম, নারীর সৌন্দর্য বা এসব নিয়ে দারুণ চিত্রকল্পের কিছু কবিতার অংশবিশেষ তুলে ধরছি—

১. সর্প বিতানের কোনো ফলবান বৃক্ষের শিকড়েখুলে দিয়ে দুটি উষ্ণ উরুর সোপানঢেকে আছে নগ্নযোনি গহরফলক (শিল্পের ফলক, লোক লোকান্তর)

২. তবুও তো চাঁদ ওঠে জনপদে। ব্রাকেরআপার মতো ঠাটচান্দেরী শাড়ির নিচে জোছনা দেখানো গুঢ় রাত।(খরা সনেট-৪, দোয়েল ও দয়িতা)

Advertisement

৩. জলজ তুনের মতো ফেরজন্ম নেবে ধরত্রীর মুত্রভেজা যোনীর দেয়ালে।(ভারতবর্ষ, বখতিয়ারের ঘোড়া)

৪. শরমিন্দা হলে তুমি ক্ষান্তিহীন সজল চুম্বনেমুছে দেবো আদ্যক্ষর রক্তবর্ণ অনার্য প্রাচীন।বাঙালী কৌমের কেলি কল্লোলিত কর কলাবতীজানতো না যা বাৎসায়ন, আর যত আর্যের যুবতী।(সনেট-০২, সোনালি কাবিন)

আল মাহমুদের কিছু সেরা এবং সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা প্রেম এবং কামুকতা সম্পর্কে। অপূর্ব শব্দ বা শব্দশ্রেণি প্রয়োগে আল মাহমুদ অভিজ্ঞতাকে মহিমান্বিত করেছেন। তাঁর আবেগের এ স্বতঃস্ফুর্ততা এবং প্রত্যক্ষতা সম্পর্ক তাকে অন্য কবিদের থেকে আলাদা করে। আল মাহমুদ তাঁর জিহ্বা, আঙুলের ডগা, নাসিকা, চোখ, কানের সূক্ষ্ম দৃষ্টিকোণ থেকে অভিজ্ঞতার রূপান্তর ঘটিয়েছেন কবিতায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনিন্দ্য নন্দনতত্ত্ব, প্রেমের প্রতি অসহায় আত্মসমর্পণ তাঁর কবিতায় লক্ষ্য করা যায়। আমাদের মনের কথা বলে দিয়েছেন আল মাহমুদ। অপূর্ব ও অসাধারণ উপস্থাপন কৌশল প্রেমের কবিতাগুলো অনন্য মাত্রা দিয়েছে। মনে হয়, আমরা এগুলো জানি। কিন্তু আল মাহমুদ বলে দিলেন শুধু। এমনভাবে আগে কোনো কবি উপস্থাপন করেননি। সাধারণ মানুষের জীবনের উপাদানগুলো ব্যবহার করেছেন আল মাহমুদ। দেশজ ও লোকজ উপাদানে কবিতা হয়েছে অনন্য, পাঠকের রুচিতে নতুনত্ব দিতে সক্ষম হয়েছে। তিনি তাঁর পাশের পরিবেশ নষ্ট হোক তা চাননি, অসহিষ্ণু হননি। এমন চিন্তার অপূর্ব উপস্থাপন কবিকে তাদের পূর্বসুরি থেকে আলাদা করেছে।

আল মাহমুদ যা ভেবেছেন, তা-ই রাখঢাক না করে অকপটে বলেছেন কবিতায়। অনেকে অশ্লীলতার অভিযোগ আনতে পারেন। এমন সাহসী ভূমিকা তার আগে বাংলায় কেউ রাখতে পারেননি। অডিসি অব স্পিচ তাকে তার পূর্বসুরি থেকে প্রভেদ করে নতুন এক স্থানে বসিয়েছে। প্রেমের কবিতার ঐতিহ্য ভেঙে নতুন এক রূপ উপস্থাপন করলেন, বাকরীতির পরিবর্তন করে নতুন ভাষার প্রয়োগ করলেন। জীবনের বিভাজন ও মানসিক স্থিরতা প্রেমের কবিতাতেও দেখালেন। কবিতা হয়ে উঠল আরও আধুনিক। সমাজের হতাশা, দুর্বল শ্রেণি-পেশার প্রতি অবহেলা-বঞ্চনা, কুসংস্কারে আবদ্ধ থেকে জ্ঞ্যানের ঘাটতি বা দুর্বলতা ইত্যাদি আবরণ হয়েছে তাঁর কবিতায়। এটি এলিটিয় আধুনিক কবিতার মতো বৈশিষ্ট্যও। আল মাহমুদ যা মনে করেন, তারই বহিঃপ্রকাশ করেছেন কবিতায়, নিয়ন্ত্রিত আবেগ দিয়ে। তাঁর কবিতার একটা গুণ হচ্ছে স্ট্রিম অব কনসাসনেস। একাকিত্ব, হতাশা ইত্যাদি নেতিবাচক গুণ আধুনিক যুগের প্রতিনিধি। আল মাহমুদের কবিতায় তার বিস্তৃতি ঘটেছে। চরিত্রের বহুমুখিনতা আধুনিক কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নস্টালজিয়া একটি প্রবণতা তাঁর কবিতায় অনেক দেখা যায়। প্রেমের কবিতার বা অন্য কবিতার শব্দগুলো শক্তি পেয়েছে, অজেয় হয়েছে খণ্ডিত চিত্র দিয়ে অখণ্ড চিত্র নির্মাণ, চেতনাস্রোতে প্রবহ কবিতায় অনন্য গুণ হিসেবে আলোচিত হচ্ছে।

আল মাহমুদের প্রথম জীবনের কবিতাগুলো কমিউনিজমের প্রতি আন্তরিকতার অঙ্গীকার থেকে আলাদা করা কঠিন। আল মাহমুদের কবিতা অনূদিত হলে বিশ্বসাহিত্যের বড় একটা পাঠকগোষ্ঠী পাবেন বলে মনে হয়। তবে একটা কথা বলে রাখি, তাঁর কবিতা অনুবাদ করা কঠিন। মূলপাঠের কাছাকাছি যাওয়া কঠিন। সমাজের নারীর বিভিন্ন সমস্যার মানবিক দিক তুলে ধরেছেন কবি। সমাজের সমসাময়িক অবস্থান তুলে ধরা গেছে। সৃজনশীলতার সঙ্গে ধারাবাহিক উদ্ভাবনক্ষমতার প্রয়োগ একটি সমন্বয়কে চিত্রিত করে। আমরা শিল্প ও সমাজ, কবিতা ও রাজনীতি, নারী ও প্রেম ইত্যাদির দ্বৈত দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করব। মানসিক যন্ত্রণা এবং অপরাধবোধ কিছু একটা অন্বেষণ করে, যা সাধারণত বর্বর কামোত্তেজনা, বিচ্ছিন্নতা এবং আত্মপরিচয় হারানোর চিত্রে আবদ্ধ থাকে। এ ক্ষেত্রে আল মাহমুদের মৌলিকতা কৃতিত্বের স্বাক্ষর বহন করে।

আল মাহমুদ মানুষের কাছাকাছি লোকজ কবি। তবে আধুনিক ফর্মে রূপান্তর করার ক্ষমতা অনেক বেশি। এমন কবিতা পেতে বাংলা ভাষাকে আল মাহমুদ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। জসীম উদদীন কিংবা তিরিশের কবির দ্বৈতগুণ নিয়ে নিজস্ব একটি স্টাইল, ভাষারীতি বা কাব্যরীতি সৃষ্টি করাই আল মাহমুদের উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য। এ কারণেই তিনি অধিক পঠিত হচ্ছেন। শেষ জীবনে বিতর্কিত হয়েও তিনি দিন দিন পাঠকপ্রিয়তার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমার মনে হয়, বর্তমান সময়ে জীবনানন্দ দাশের পর বাংলা ভাষায় পাঠকপ্রিয়তা বৃদ্ধির হার তারই সবচেয়ে বেশি।

এসইউ/এমএস