সাহিত্য

উপলব্ধ জীবনের প্রতিবাদলিপি

অলোক আচার্য

Advertisement

লেখার গভীরতা, গতি-প্রকৃতি একজন লেখক বা কবিই নিয়ন্ত্রণ করেন। তবে পাঠক করেন তার মূল্যায়ন। পাঠকের মূল্যায়নে সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে শফিক হাসান অন্যতম। যিনি প্রতিনিয়ত লেখার মাধ্যমে সমৃদ্ধ করছেন সাহিত্য জগৎ। পাঠক মহলে শফিক হাসানের শক্ত পরিচিতি রম্য লেখক হিসেবে। প্রায়ই তার রম্য দৈনিকের পাতায় পাঠকের নজর কাড়ে। লেখার ভিন্নতা, রম্যকথার মাধ্যমে সমস্যা উপস্থাপন এবং অন্যায়কে দেখিয়ে দেওয়া তার রম্যগল্পের বৈশিষ্ট্য। সাহিত্যের এ অংশে যেমন তার সরব উপস্থিতি; সেভাবেই অন্য শাখায়ও কম-বেশি উপস্থিতি আছে। বিশেষত ছোটগল্প, গবেষণা ও ভ্রমণেও তার উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।

এ কথা সত্য যে, তাকে কবিতার জগতে আমরা কমই দেখেছি। যেটুকু দেখেছি, সেখানেও একটু ভিন্নতার ছাপ আছে। অর্থাৎ একটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য আছে। সেই বৈশিষ্ট্য কি? তা আমরা তার কবিতা আলোচনায় ভালোভাবেই বুঝতে পারবো। সাহিত্য তার নিজস্ব গতিতে প্রবাহমান। তবে রীতিতে ভিন্নতা আনে সাহিত্যিক। হয়তো আমরা যেভাবে কবিতা বা গল্প পড়ছি, কয়েক শতাব্দি ধরে কেউ একজন সেখানে পরিবর্তন আনেন। তারপর সেভাবেই চলতে থাকে।

গল্পকার শফিক হাসান থেকে যদি আমরা কবি শফিক হাসানের দিকে চোখ ফেরাই, তাহলে দেখবো সেখানে তার ভিন্নতা স্পষ্ট। সম্প্রতি তার কাব্যগ্রন্থ ‘ঘুমের বাদ্যে রাষ্ট্র নাচে’ প্রকাশিত হয়েছে। কাব্যগ্রন্থটিতে মোট ৫৮টি কবিতা আছে। বইটির একটি বৈশিষ্ট্য প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো যে, এখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দীর্ঘ কবিতা আছে। আজকাল যেখানে অপ্রয়োজনেই কবিতা ছোট হচ্ছে। পত্রিকার পাতায়ও দীর্ঘ কবিতা বিশেষত ষোলো লাইনের বেশি কবিতা প্রায় পড়া হয় না। সেখানে এ বইয়ের দীর্ঘ কবিতাগুলো পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখতে পারবে।

Advertisement

আরও পড়ুন: যুদ্ধোত্তর ইতিহাসের জীবন্ত দলিল 

এক সময় কিন্তু দীর্ঘ কবিতাই ছিল। এখন কবিতা বাড়তে দেওয়া হয় না। বড় হলেই তা প্রকাশের অযোগ্য! অথচ কবিতাও একটি ভাষা, যার ব্যপ্তি দীর্ঘ হতে পারে। কবি শফিক হাসান কখনো ভাবুক, স্মৃতিকাতর, কখনো প্রতিবাদী আবার বাস্তববাদী। তার কবিতাগুলোর ঘটনাপ্রবাহ, শব্দের জাল বা ব্যাকরণ সবই যেন একজন কবিকে পূর্ণভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম।

তার কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা শুরু হয়েছে এভাবে, ‘অদ্বৈত এক সন্ধ্যা নামছে/ বন্ধনহীন ফটক-দেয়ালে-খেয়ালে/ মেঘ ভিজে যাচ্ছে জলের আবরণে/ কাদার প্রসাধনে, জলের আবরণে/ এর মধ্যেই কেউ হেঁটে যায়/ দরকারে কিংবা বেহুদা কাজে’। এ কবিতা দিয়েই কবির জাত চেনা যায়। কবির ভাবশক্তি বা বাস্তব উপলব্ধি অথবা কবিতা লেখার আবশ্যকীয় উপাদান উপমার ব্যবহারের দক্ষতা- সব কিছুতেই দক্ষতার ছাপ।

বড় বা দীর্ঘ কবিতাসমূহ জীবনভিত্তিক, জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, সময়-অসময় অথবা চোখে দেখা কোনো ঘটনার বর্ণচ্ছটা উঠে এসেছে। যেমন ‘মৃত্যু-ক্ষুধা’ কবিতার কথা বলা যায়। কবি লিখেছেন, ‘বাদামের ঝাঁকা বুকে বেঁধে দিনভর হাঁটে যে শৈশব-হারা/ কখনো তার নিজ বাদাম খেতে ইচ্ছে করে কি না জানিনি/ চকলেট বিক্রেতা ছেলেটিও কি চাটতে পারে একটুখানি;’। এ কবিতায় এরকম জীবনাভূত আরও অনেক শব্দ আছে। এই গভীর দেখা মানবিক অনুভূতি কবি শফিক হাসানের ভেতর দেখা যায়, একবার নয় বারবার।

Advertisement

আরও পড়ুন: শিলারি: হাওরপাড়ের জীবন্ত আখ্যান 

সব কবিই যেমন প্রকৃতি প্রেমিক হন, বর্ষাযাপন করেন, মেঘ দেখে মিশে যেতে চান। শফিক হাসান চেয়েছেন। প্রকৃতি তাকেও টেনেছে। তিনি লিখেছেন, ‘একদিন ঝুম বৃষ্টি হবে চরাচরজুড়ে/ আকাশের কার্নিশে ফুটবে কদম/ রেণুঘ্রাণ গায়ে মেখে নিতে নিতে/ মন বাড়াব ঋতুবতী মেঘসন্তানের দিকে।’ শফিক হাসানের ‘ঘুমের বাদ্যে রাষ্ট্র নাচে’ কাব্যগ্রন্থ মূলত জীবনঘনিষ্ট এক প্রতিবাদলিপি। এখানে বিদ্রোহ আছে-আত্মার, সময়ের সাথে, জীবন বা মৃত্যুর সাথে অথবা বাধ্য হয়ে মেনে নেওয়া নিয়তির কাছে। মানুষের গন্তব্য কোথায়, মানুষ তা নিজেও জানে না। নিজেও স্থির করতে পারে না। জীবনভর সে ছুটতেই থাকে।

তবু লক্ষ্য যেন দূরে সরে যায়। এই তো জীবন। কবির ‘স্টেশনে পৌঁছাতে পারি না কেন’ কবিতায় লিখেছেন, ‘স্টেশন কেন দূরে সরে যাচ্ছে দিনকে দিন/ গন্তব্য নজদিক হলেও পৌঁছানো যায় ঠিকই/ তবে স্টেশনে পৌঁছাতেই কেন দেরি-ঝক্কি/ আরও দূরে সরে যেতে থাকে ক্রমশ স্টেশন/ দেরির তালাশে বেরিয়ে আসে সূত্রনামার প্যাঁচ।’ এই ‘সূত্রনামার প্যাঁচ’ তো সবাই খুঁজে বেড়ান। কিন্তু তার দেখা পান ক’জন? একটি উল্লেখযোগ্য দীর্ঘ কবিতা ‘অতল অন্ধকারে’। কবিতাটি মূলত কবির দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তব প্রকাশ। তিনি লিখেছেন, ‘তার আগে যাওয়ার আগে পৃথিবীকে দেখে নিই আরেকবার বারংবার প্রাণপণে। রেখে যাই কিছুফুল-ফসল মানুষের ব্রতে...।’ পৃথিবী টিকবে কি, মানুষ থাকবে কি; এমন সংশয় থেকে সৃষ্টি নতুন রোদন—তবে কেন এত আয়োজন, উৎপাদনের করসত! মানুষের জীবনে টিকে থাকার এই যে এত কসরত এর মূল উদ্দেশ্য কি বেঁচে থাকা? বেঁচে থেকেও কি মানুষ মূলত বাঁচে? তাহলে বাঁচার মতো বেঁচে থাকার কথা আসতো না।

‘কেন তবে আসা-যাওয়া একদিকে যাওয়ার মিছিল, বিপরীতে আগমনের স্লোগান/ রচিত মিথস্ক্রিয়া নিত্যকার; প্রাণের সংহার কিংবা উপস্থিতি/ উন্মুখ সকালের আগেই কেন ঝপাত রবে নামে সন্ধ্যা/ বিভীষিকা ও শোকাঁধারে থরথর কাঁপে দিকভ্রান্ত চতুর্দিক/ আমাদের যাওয়ার ছিল অচিনপুরে অথচ গন্তব্য ভুলে গেছি/ পা চালাই শবের বহরমুখী; নবাগতের ক্রমাগত শোর-হর্ষ/ অস্ফুট সিম্ফনিতে হস্ত-পদের ছোড়াছুড়ি, অকারণ বিপ্লব।’ কবিতার লাইনগুলো ‘কেন তবে আসা যাওয়া’ কবিতার। সত্যি যে কেন আসা-যাওয়ার এই ব্যস্ত সময়ে মানুষের কারণ বা অকারণ ছুটে চলা, তার উদ্দেশ্যই বা কি আর গন্তব্যই বা কোথায়—এ আত্ম-উপলব্ধির কবিতাগ্রন্থই ‘ঘুমের বাদ্যে রাষ্ট্র নাচে’।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।

এসইউ/জিকেএস