সাহিত্য

প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘শকুন্তলা’র শিল্পরূপ

গল্প জীবনের কথা বলে। তাই তো গল্প বলা এবং গল্প শোনায় আগ্রহ মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্য। জীবনের অভিব্যক্তি প্রকাশের আকাঙ্ক্ষা থেকেই গল্প বলা। ‘লিপি আবিষ্কার হওয়ার অনেক পূর্বে যখন মানুষ কেবল ভাব বিনিময়ের সূচক আবিষ্কার করতে পেরেছে তখন থেকেই গল্প বলে এবং গল্প শোনে; এবং শুনে ও বলে আনন্দ পায়।’ (ড. নিতাই কুমার ঘোষ, পৃষ্ঠা-১৩) সেই শোনা এবং বলার আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায় প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘শকুন্তলা’ গল্পে।

Advertisement

তিরিশের শক্তিমান গল্পকার প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-১৯৮৮) বাংলা সাহিত্যের বহু শাখায় পরিভ্রমণ করেছেন। সেই কল্লোলের সময়ে আবির্ভুত এ গল্পকারের গল্পে কালসৃষ্ট মধ্যবিত্তের জীবনের ছবি প্রতীয়মান হয়েছে। তাঁর অনুসন্ধানী দৃষ্টি অতীত ইতিহাস থেকে বর্তমান সভ্যতার নানা প্রকোষ্ঠে আলো ফেলেছে। ফলে গল্পের বিষয় ও শৈলীকে সমৃদ্ধ করেছে।

বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগে গদ্যের প্রচলন শুরু হলেও তা পরিপূর্ণ হয়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) হাতে। ‘বাংলা ছোটগল্পকে প্রকৃত আলোর পথ দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা সাহিত্যের যে শাখাটিকে আমরা এখন ছোটগল্প বলে চিহ্নিত করি তাঁর জন্ম এবং পূর্ণতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতেই।’ (ড. নিতাই কুমার ঘোষ, পৃষ্ঠা-১৮) তাই বয়সের দিক দিয়ে কনিষ্ঠতম হয়েও বাংলা ছোটগল্প লাভ করে বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আসন।

বাংলা ছোটগল্প ভুবনে কল্লোল যুগের প্রধান গল্পকার হলেন–জগদীশ গুপ্ত (১৮৮৬-১৯৫৭), অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (১৯০৩-১৯৭৬), (প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-১৯৮৮), প্রবোধকুমার সান্যাল (১৯০৫-১৯৮৩) প্রমুখ। কাল্লোল যুগের লেখকগণ তাদের লেখায় খুঁজেছেন সমাজের সব ধরনের সঙ্গতিচিত্র। ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবী দেখে এঁরা রক্তাক্ত হয়েছেন। তাই তাদের সমস্ত ছোটগল্প হয়ে উঠেছে সেই রক্তাক্ত চিত্রাখ্যান।’ (ড. নিতাই কুমার ঘোষ, পৃষ্ঠা-২৩)

Advertisement

ফলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরবর্তী যুগের সফল ও শক্তিমান গল্পকার প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পকার হয়ে ওঠার জন্য তাঁর পরিপার্শ্ব ভূমিকা রেখেছিল। তাঁর বেড়ে ওঠার জন্য তাঁর পূর্ববর্তী গল্পকারগণ যেমন অনুপেরণার বিষয়, তেমনই তাঁর দেশ-কাল-সমাজও এ ক্ষেত্রে কম ভূমিকা রাখেনি। যে কারণে তাঁর হাতে রচিত হতে পেরেছে ‘শকুন্তলা’ গল্পটি।

প্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁর বেশিরভাগ গল্পেই মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন ও যন্ত্রণার চিত্র অত্যন্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে অঙ্কন করেছেন। ‘শকুন্তলা’ গল্পটিও তার ব্যতিক্রম নয়। যা বিষয়বৈচিত্র্য, বাক্যগঠন, কাহিনি-বিন্যাস এবং নান্দনিকতায় অনন্য হয়ে আছে। শকুন্তলার কাহিনি আর দশটি মেয়ের সাধারণ জীবনের মতোই সাদামাটা। কেরানির মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়া শকুন্তলার জীবনই যেন একটা নাটক। কেরানি ও তার স্ত্রীর আকাঙ্ক্ষা ছিল, তাদের একটি ছেলে ও একটি মেয়ে হবে। কিন্তু জন্ম হলো শুধু শকুন্তলার। তা-ও অনেক বছর অপেক্ষার পর।

গ্রামের পাঠাগার থেকে বই এনে পড়তেন শকুন্তলার মা। তিনি ছেলে-মেয়ের নামও ঠিক করে রেখেছিলেন। তাই তো মেয়ের নাম রাখলেন ‘শকুন্তলা’। চঞ্চলা, শ্যামা, কৃশতনু বালিকা বড় হতে থাকে। স্কুলে পড়ে, মাকে বই পড়ে শোনায়, বিভিন্ন কাজে সাহায্য করে। এভাবে বড় হতে হতে একদিন বিয়ের পিঁড়িতে বসে। ‘‘তার পরে ‘স্নিগ্ধ সজল মেঘ-কজ্জ্বল দিবসে’ বিংশ শতাব্দীর শকুন্তলা স্বামীর উত্তরীয়ে অঞ্চল বেঁধে চক্ষুভরা অশ্রু এবং বক্ষভরা উদ্বেগ নিয়ে পেছু পেছু গাড়িতে উঠে তার চির পরিচিত গলিপথ দিয়ে প্রথম স্বামীর ঘর করতে চলে গেল।’’ (প্রেমেন্দ্র মিত্র, ১৯৯৯: ৬৪ )

গল্পটি এক নারীর জীবনের সংক্ষিপ্ত আখ্যান। জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং বিবাহের মধ্য দিয়ে স্বামীর সংসারে যাওয়াই গল্পের বিষয়বস্তু। বাঙালি কেরানি পরিবারের মেয়ে শকুন্তলা। যারা বংশ পরম্পরায় শুধু কেরানিগিরি করে এসেছেন। গল্পে কেরানির ঘরে কেবল একটি মেয়েই জন্ম নিয়েছে। গলির একটি জীর্ণ বাড়িতে তাদের বসবাস। শকুন্তলা অন্য সব মেয়ের মতোই বড় হতে থাকে। সন্ধ্যায় ইটের ভাঙা আলসের ওপর ভর দিয়ে অন্য ছাদের মেয়েদের সঙ্গে গল্প করে। বাবা তাকে আদর করে ডাকেন ‘বুড়ি’। মা তাকে ডাকেন ‘খুকি’। কখনো রেগে গেলে বলেন ‘শুকনি’। শকুন্তলার বিশেষ কোনো মহিমা লক্ষ্য করা যায় না।

Advertisement

তাই তো দেখা যায়—‘সে এখন সকাল-বিকাল মার সঙ্গে রান্নার কাজে যায়, দুপুরে শেলাই এর কলে বসে শেমিজ ব্লাউজ শেলাই করে, কখনও বা মাকে বই পড়ে শোনায়, কখনও আনমনে রান্নাঘরের ছাদের উপর গিয়ে অসীম অনাদি নীলাকাশের দিকে চেয়ে কি ভাবে সেই জানে।’ (প্রেমেন্দ্র মিত্র, ১৯৯৯: ৬৪) প্রেমেন্দ্র মিত্রের সৃষ্ট ‘শকুন্তলা’র চরিত্রে মহাকাব্যের কোনো ছোঁয়া নেই। সাধারণ কেরানির মেয়ে বলে প্রকৃতির নিয়মে বড় হয়, বিয়ে হয়, নতুন সংসারে পা রাখে। তারা আরেকটি ভুবন তৈরি করে। সেখানেও হয়তো কোনো এক কেরানির স্ত্রী হয়ে উঠতে হয়। ফলে গল্পটি সেই অর্থে বিশেষ কোনো কারুকার্য বহন করে না।

একটি বিশেষ শ্রেণিকে উপলক্ষ্য করে তখনকার সামাজিক অবস্থা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তুলে ধরেছেন। কেরানিদের বাংলার কলমের ক্রীতদাস বলেছেন। তাদের মানসিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বলয় আঁকতে চেষ্টা করেছেন। বাঙালির চিরায়ত জীবনবোধ, সংসার-ধর্ম, কর্মযজ্ঞ মূল উপাদান হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। গল্পকার রাজা দুষ্মন্তের শকুন্তলার সঙ্গে এই শকুন্তলাকে মেলাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। ‘শকুন্তলা’ আসলে মহাকাব্যের কোনো উপকরণ নয়। ‘সে শকুন্তলা কিন্তু শুধুই বুঝি নামে, কেরানী গৃহিণীর পক্ষে অশোভন একটা অকিঞ্চিৎকর নামে।’ (প্রেমেন্দ্র মিত্র, ১৯৯৯: ৬৪)

কাহিনি ছাপিয়ে গল্পটি শিল্প সফল হয়েছে অন্য কারণে। এর বর্ণনা, শিল্পরূপ আকর্ষণ করে পাঠককে। এ পর্যায়ে গল্পের কিছু উক্তি স্মরণযোগ্য। যথা:১. বাংলার কলমের ক্রীতদাস কেরানী। (পৃ-৬২)২. কেরানী জাতের তারা বনিয়াদী বংশ। (পৃ-৬৩) ৩. সাতপুরুষে কলম ছাড়া অন্য কোনো হাতিয়ার ধরেনি। (পৃ-৬৩)8. শৈশবের ইতিহাস কে কবে লিখতে পারে? (পৃ-৬৩)৫. দৈর্ঘ্যে প্রস্থে তারা অর্থনীতিবিদ ভাগ্য দেবতার মিতব্যয়িতার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। (পৃ-৬৩)৬. তাদের ছেলে মেয়েরা দেরি করা ভালোবসে না। (পৃ-৬৩)৭. মেয়ে মানুষের জোরে হাসতে নেই। (পৃ-৬৪)৮. একটি হর্ষ শঙ্কা উদ্বেলিত কিশোরীর চঞ্চল চোখ দুটি প্রথম অবগুণ্ঠনে ঢেকে গিয়েছিল। (পৃ-৬৪)এ কথাগুলো যেন চিরায়ত সত্য হয়ে ধরা দিয়েছে আমাদের সামনে। একে লেখকের দর্শনও বলা যেতে পারে।

একই সঙ্গে উপমাগুলোও শ্রুতিতে মধুর হয়ে ধরা দেয়। যেমন-১. চঞ্চলা, শ্যামা, কৃশতনু বালিকা২. লাবণ্যময়ী কিশোরী৩. অসীম অনাদি নীলাকাশ৪. শকুন্তলার সীমান্তে সিন্দুর রেখা৫. কিশোরীর চঞ্চল চোখ দুটি।পাশাপাশি শ্লেষও প্রস্ফুটিত হতে দেখা যায়। লেখক যখন বলেন-১. বাংলায় একটা জাতি আছে যার সম্বন্ধে এ পর্যন্ত কোনো নৃতত্ত্ববিদ কোনো গবেষণা করেননি। (পৃ-৬৩)২. তারা হুড়মুড় করে পৃথিবীতে আসে, তারপর যথাসময়ের যথেষ্ট আগে নিঃশেষ যৌবনের নিমেষের পেয়ালা খালি করে চটপট করে বুড়ো হয়ে সংসারের কাজ সমাপ্ত করে সরে পড়ে চক্ষু মুদে। (পৃ-৬৩)৩. তাদের সাতপুরুষের শৈশব পুষ্ট হয়েছে মায়ের স্তনের অপ্রচুর পাতলা দুধে আর জল বার্লিতে। (পৃ-৬৩)

এমনকি গল্পের নান্দনিকতা ফুটে ওঠে প্রতিটি বাক্যে। কাহিনি বিন্যাসের মাধুর্যে বাক্যগঠনে সেই শৈলী স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে পাঠকমাত্রই উপলব্ধি করবেন—১. গলি মুখরিত করে প্রভাতে পথিকের চলাচল শুরু২. নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে কাঁসারি ঘণ্টা বাজায়৩. সন্ধ্যায় মই কাঁধে বাতিওয়ালা এসে গ্যাস জ্বালায়৪. বিয়েতে ছোটখাটো ব্যান্ড বাজিয়ে বর আসে।এভাবেই গল্পের যাবতীয় শিল্পশৈলী মোহময় আবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়।

যে কারণে প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প সমকালীন গল্পকারদের থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য এবং বৈচিত্র্যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সুবোধ ঘোষ (১৯০৯-১৯৮০) যেমন সমাজ, পরিবার এবং মানুষকে উপজীব্য করে গল্প নির্মাণ করেন; প্রেমেন্দ্র মিত্রও একই বিষয়ে ভিন্ন আঙ্গিকে কাহিনি প্রতিষ্ঠিত করেন। সুবোধ ঘোষ ‘অযান্ত্রিক’ গল্পের মধ্য দিয়ে মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। ফলে তার গল্পের বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব, প্রকাশভঙ্গির বলিষ্ঠতা, শানিত দৃষ্টিভঙ্গি, চল্লিশের সূচনাতেই বিরাট সাড়া জাগিয়েছে। অপরদিকে জগদীশ গুপ্ত (১৮৮৬-১৯৫৭) গল্পের পরিবেশ রচনায় প্রাচীনপন্থি। তাঁর গল্পের মুখ্য পটভূমি গ্রাম-নির্ভর। সেখানে খুঁজে পাওয়া যায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ। এছাড়া দীনেশরঞ্জন দাশের (১৮৮৮-১৯৪১) গল্পের সার্থকতা অপ্রতুল। ফলে তাদের প্রত্যেকের বর্ণনাশৈলী ও রচনাশৈলী ভিন্ন। উপস্থাপন ভঙ্গিও আলাদা। তবে প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পে অতীত মানুষের যে হৃৎকম্পন শোনা যায়, একালের সমাজের বাস্তবতায়ও তা প্রাসঙ্গিক। সুতরাং মনে হয়, তারা একই সমাজের প্রতিনিধি।

সবশেষে বলা যায়, বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের এক অত্যুজ্জ্বল লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র। যিনি সমকালের অন্য সব গল্পকারকে ছাপিয়ে নিজস্ব বলয় তৈরি করতে পেরেছিলেন। সেই বলয়ে তিনি এখনো পরিভ্রমণ করছেন।

তথ্যসূত্র:১. ড. নিতাই কুমার ঘোষ, ২০০৯, প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পে মানবসম্পর্কের সীমানা ও সত্যতা, চিহ্ন, রাজশাহী২. প্রেমেন্দ্র মিত্রের সমস্ত গল্প, ১৯৯৯, প্রথম খণ্ড, ওরিয়েন্ট লংম্যান, ২য় মুদ্রণ, কলকাতা

এসইউ/এমএস