খেলাধুলা

বইয়ের কথা হেসেই উড়িয়ে দেন মাশরাফি

প্রথম পর্বযদি সেলিব্রেটিকে নিয়ে লিখলে তিনিও সেলিব্রিটি হযে যান তাহলে দেবব্রত মুখোপাধ্যয়কেও সেলিব্রিটি বলা যায়! মাশরাফি বিন মর্তুজাকেই যে তিনি একটি গ্রন্থে গ্রন্থাবদ্ধ করে একজায়গায় উপস্থাপন করে দিয়েছেন লক্ষ-কোটি ভক্ত-সমর্থকের সামনে! নাম তার ‘মাশরাফি’।মাশরাফিকে শুধু সেলিব্রিটি বলে একটা ব্র্যাকেটে বন্দী করে ফেলা যায় না। মাশরাফি একটি আইডল। কোটি মানুষের স্বপ্নের নায়ক। এমনি এমনি আর স্বপ্নের নায়কে পরিণত হননি তিনি। ক্রিকেটে নড়াইল এক্সপ্রেস নামে পরিচিত। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের রঙিন জার্সির অধিনায়ক। তবে, এসব কিছু ছাপিয়ে এখন মাশরাফির বড় পরিচয়ই যেন হয়ে উঠেছে- তিনি একজন নেতা। একজন অনুপ্রেরণাদায়ী। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাকিব, তামিম থেকে শুরু করে সবারই সরল স্বীকারোক্তি এটা।আর নিজের জীবনে যে কঠিন লড়াই সংগ্রাম করেছেন মাশরাফি, সেটাই যেন মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় এক বিষয়। মাশরাফির জীবন সংগ্রামের বিষয়টাই মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছে তাকে নিয়ে লেখা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘মাশরাফি’তে। তো ‘মাশরাফি’ লিখতে গিয়ে লেখক দেবব্রত মুখোপাধ্যয় মুখোমুখি হয়েছেন নানারকম মজার অভিজ্ঞতার। সেগুলোই উঠে এসেছে দীর্ঘ এ সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের ক্রীড়া প্রতিবেদক রামিন তালুকদার। সাজিয়েছেন জাগো নিউজের ক্রীড়া সম্পাদক ইমাম হোসাইন সোহেল।সাকিব আল হাসানকে নিয়ে বিশ্লেষণমূলক বই লিখলেও জীবনী এটাই প্রথম। তো জীবনী করার জন্য মাশরাফিকে কেন বেছে নিলেন?দেবব্রত : শুধু ক্রিকেটই নয়, আপনি যদি বাংলাদেশে সফল ব্যক্তিদের দিকে তাকান তাহলে দেখবেন, সব সফল মানুষের জীবনেই সংগ্রাম থাকে। কারো কম, কারো বা বেশি। বেশিরভাগ সফল মানুষকেই সংগ্রাম করতে হয়। তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে মাশরাফির সংগ্রামটা হচ্ছে সবচেয়ে নাটকীয়। এছাড়া আর কারো জীবনে এতো সংগ্রাম পাবেন না। সব কিছু বাদ দিয়ে তার ইনজুরিগুলোর দিকেও যদি তাকান তাহলে দেখবেন, এগারোবার অস্ত্রোপচার হয়েছে। এরমধ্যে দুই হাঁটুতেই সাতবার। অস্ত্রোপচার মানে তো আর শুধু অস্ত্রোপচার নয়। তিন-চার মাস পরপর রিহ্যাব করতে হয়। এরপর মাঠে ফিরে আবার ছন্দ ফিরে পাওয়া, আবার সেই একই জায়গায় বল করা। এই এগারোবারের মধ্যে অন্তত তিন-চারবার মনে হয়েছে আর বুঝি মাশরাফির পক্ষে ফেরা সম্ভব হবে না। তো এই যে নাটকীয়তা, দেখেন ২০১১ সালে বিশ্বকাপে মাশরাফি দলেই থাকলো না। ইনজুরি হোক কিংবা বিতর্ক- নানা কারণে থাকতে পারলেন না। সেই মাশরাফি ২০১৫ সালে এসে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিলেন। এই যে চমকপ্রদ কাহিনী এবং চমকপ্রদ সব গল্প একজন মানুষের জীবন ঘিরে। মানুষের জীবন তো এতটা গল্পময় হওয়া খুব কঠিন। সে জন্যই মাশরাফিকে বেছে নেওয়া।‘মাশরাফি’ বইয়ের লেখক দেবব্রত মুখোপাধ্যয়‘মাশরাফি’তো লেখা শেষ, উদ্বোধনও হয়ে গেলো। কেমন সাড়া পাচ্ছেন?দেবব্রত : এখনও পর্যন্ত সাড়া খুব ভালো। দুটো জায়গা নিয়ে কথা বলবো। প্রথমে বলবো ক্রিকেটারদের কথা, তারা যেভাবে এসেছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ক্রিকেটার কেউ কিন্তু আসতে বাধ্য ছিলেন না। এটা মাথায় রাখতে হবে প্রোগ্রামটা ছিল সম্পূর্ণ অনানুষ্ঠানিক। ব্যক্তি আয়োজনের প্রোগ্রাম। আমি সবাইকে দাওয়াত করেছিলাম- কেউ আসলে আসতেন, না আসলেও করার কিছু ছিল না; কিন্তু দেখলাম যে সবাই চলে এসেছেন। শুধু এসেই বসেছিলেন না, আপনারা দেখেছেন ক্রিকেটাররা কীভাবে অংশ নিয়েছে। তারা মাশরাফির সঙ্গে মজা করেছেন। এমনকি কোচ মঞ্চে উঠে মাশরাফির অনুকরণ করেছেন, মাশরাফি কেমন করে সকাল বেলা হাঁটে, কেমন করে কথা বলে এবং শেষ পর্যন্ত সে কিভাবে দুইশতভাগ ঢেলে দেয়। তারপর ক্রিকেটাররা আবেগি কথা-বার্তা বলেছেন। সব মিলিয়ে ক্রিকেটারদের সে অংশগ্রহণ, কোচদের যে অংশগ্রহণ, তা ছিল অসাধারণ।  আরেকটা অসাধারণ ব্যাপার ছিল মিডিয়ার ভূমিকা। এটা আমি সবসময় বলি, আমি যে বইগুলো লিখি তা শুধু আমি লিখি না। এটা পুরো স্পোর্টস জার্নালিস্ট কম্যুনিটি লিখে। আমার এই বইটাতে যদি আপনি চোখ বুলান তাহলে দেখবেন, এতে শত শত রেফারেন্স আছে আমাদের স্পোর্টস জার্নালিস্টদের, যারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয়ে মাশরাফি সম্পর্কে লিখেছেন। সেখান থেকে আমি কোট করেছি। তাদের থেকে আমি সহযোগিতা নিয়েছি। শুধু যে পুরনো লেখা নিয়েছি তা নয়। তারা নানাভাবে আমাকে হেল্প করেছেন, যার কাছে যে তথ্যটা ছিল, তা আমাকে দিয়ে সাহায্য করেছেন। উদ্বোধনের সময় যেটা দেখলাম বিশেষ করে তরুণ সাংবাদিকরা যেভাবে সংবাদ প্রকাশ করছেন, যেভাবে সম্পৃক্ত থেকেছেন। প্রতিনয়ত আমাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করছেন অনুষ্ঠানের কি অবস্থা, অনুষ্ঠান ঠিকঠাক মত চলবে কি না। একদম আপ্লুত, মুগ্ধ আমি। এখন বাকিটা তো পাঠকের হাতে, বই কেবল বাজারে যাওয়া শুরু হয়েছে। এখনও দুটোদিন পার হয়নি। অনলাইন বুকিংয়ে যতটুকু বুঝেছি অসাধারণ সাড়া পাচ্ছি। এখন বাকিটার জন্য আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে। আর বই নিয়ে সাধারণত বই মেলার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। সেখানে বোঝা যাবে পাঠকের সাড়া আসলে কতটুকু।মাশরাফিকে নিয়ে বই নিয়ে লেখার ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো বেশি অনুপ্রেরণা দিয়েছে?দেবব্রত : অনুপ্রেরণার কথা যদি বলেন তাহলে বলবো, মাশরাফির জীবনটাই অনেক বেশি অনুপ্রেরণাদায়ক। আর আমার জন্য একটা বড় ব্যপার ছিল মাশরাফির সঙ্গে প্রায় গত বারো বছর ধরে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে পারছি। যদিও আমি বলে থাকি ক্রিকেটারদের সঙ্গে সাংবাদিকদের বন্ধুত্ব হওয়া উচিৎ একটা দূরত্ব রেখে। সারা পৃথিবীতে তাই হয়; কিন্তু আমাদের এখানে ক্রিকেটারদের সঙ্গে সাংবাদিকদের সঙ্গে বন্ধুত্বটা হয় বেশি। তো সেরকমই একটা সম্পর্ক ছিল তার সঙ্গে আমার। বন্ধুস্থানীয় একজন মানুষকে চোখের সামনে মহানায়ক হতে দেখা, আর সেই মহানায়ককে নিয়েই লেখা- এই ব্যাপারটা খুব অনুপ্রেরণাদায়ক ছিল।কবে থেকে মনে হলো মাশরাফিকে নিয়ে লেখা যায়? আর কাজটাই বা শুরু করলেন কবে থেকে?দেবব্রত : ২০১৩। আপনারা দেখবেন ২০১৩ সালে বড় একটা সময় মাশরাফির ইনজুরিতে কেটেছে। কিংবা ইনজুরি থেকে তখন তিনি রিহ্যাব করছেন। ২০১৩ সালের ওই ইনজুরির ধকলও ছিল প্রবল। মনে হচ্ছিল তিনি আর মাঠে ফিরতে পারবেন না। ওই সময়ই হঠাৎ মাশরাফি এমন একটা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, অবাক করে দিয়েছিল সবাইকে। তিনি প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলবেন, টেস্ট খেলবেন। তখন বাংলাদেশে নিউজিল্যন্ডে সফরে আসার কথা ছিল। যদি ঠিকঠাক মনে করতে পারি, তাহলে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওই সিরিজেই একটা টেস্ট খেলার ইচ্ছা ছিল তার। এমনকি খুলনায় তিনি জাতীয় লিগের একটা ম্যাচও খেলেছিলেন। নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য। এ কথাটা তিনি আমাকে বলেননি; কিন্তু একটা প্রবাহ ছিল, আমার মনে হয়েছিল একটা টেস্ট খেলে অবসর নিয়ে নিতে পারেন তিনি। এটা একদম আমার মনের কথা বললাম। এমন একটা শঙ্কা বা গুঞ্জন ছিল। তখন মিডিয়াতে এটা নিয়ে লেখালেখিও হয়েছিল যে, একটা টেস্ট খেলে অবসর নিয়ে নিতে পারেন মাশরাফি। তখনই আসলে আমি সিদ্ধান্ত নেই যে, তিনি আসলে একটা বৃত্ত পূরণ করে ফেলেছেন। ২০০৯ সালের পর যিনি আর টেস্ট খেলেনি, তিনি যখন আর একটা টেস্ট খেলতে চাচ্ছেন, তার মানে অবসরের কাছাকাছি চলে এসেছেন। এই যে বৃত্তপূরণ, এটা তখনই বড় একটা উপন্যাসে পরিণত হয়েছে। ফলে ওই অবস্থায় আমি সিদ্ধান্ত নেই, বইটার কাজ শুরু করবো এবং মাশরাফি ইনজুরিতে থাকা অবস্থায় আমি ওর সঙ্গে এটা নিয়ে কথা-বার্তা শুরু করে দিয়েছিলাম।দেবব্রতর সঙ্গে জাগো নিউজের ক্রীড়া প্রতিবেদক রামিন তালুকদারমাশরাফির ওপর এই বইটা লেখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বিষয় ছিল কোনটা?দেবব্রত : সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ছিল- তথ্যগুলো সাজানো। ওই যে সবাই বলে, মাশরাফি একটা ওপেন বুক। সবাই সবকিছু জানে তার সম্পর্কে। তাকে নিয়ে তথ্যের পরিমাণ এতো বেশি এবং এটার ধারাবাহিকতা ধরে রাখা। সঠিক তথ্য দেয়াটাই ছিল খুব চ্যালেঞ্জিং। আমি নিজে তথ্য নিয়ে কাজ করাটা খুব একটা পছন্দ করি না। আমার পছন্দের জায়গা হচ্ছে মানুষের জীবন, মানুষের জীবন দর্শন। ফলে আমার কাছে তাকে নিয়ে তথ্যগুলো সাজানোই ছিল অনেক চ্যালেঞ্জিং। কারণ পুরো কাজটা করতে হয়েছিল এমনভাবে, যাতে একটি তারিখও ভুল না হয়। কোনো স্কোরে যাতে একটা রানও ভুল না ওঠে। একটা উদাহরণ দিয়ে বলি, আমরা সবাই জানি ২০১১ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ থেকে তিনি বাদ পড়লেন; ওই সময়ে জেমি সিডন্সের সঙ্গে তার একদিন কথা কাটাকাটি হয়েছে। এই একদিনটা কবে? এটা কী দল ঘোষণার একদিন পর, নাকি তারও একদিন পর নাকি চার পাঁচ দিন পর? তারিখটা আমরা মনে করে এখন কেউ বলতে পারবো না; কিন্তু বইয়ে তো আমি একদিন কথা কাটাকাটি হয়েছিল, তা বলতে পারবো না। আমাকে সুনির্দিষ্ট তারিখটাই বলতে হবে। এই জিনিসটা পাওয়ার উপায় কি? এটা পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে আপনাকে ওই সময়ের পত্র-পত্রিকা ঘাঁটা-ঘাঁটি করা। ফলে দিনের পর দিন এই বিরক্তিকর কাজটিই করতে হয়েছে। লাইব্রেরীতে যেতে হয়েছে। সেই ২০০০ সাল থেকে শুরু করে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রতিদিনের পত্রিকা ঘাঁটতে হয়েছে। এটা ছিল আমার জন্য খুব চ্যালেঞ্জিং।মাশরাফিকে নিয়ে লিখতে তো আপনাকে অনেক জায়গায় যেতে হয়েছে। অনেক কিছুই ভালো লেগেছে। আবার কিছু ব্যাপার হয়তো বিরক্তও লেগেছে। অভিজ্ঞতাগুলো জানাবেন?দেবব্রত : ভালো লাগাটা আগে বলি। আমাকে মাশরাফির বাড়িতে যেতে হয়েছে নড়াইলে। কারণ নড়াইল ছাড়াতো মাশরাফি অসম্পূর্ণ। তো সেই অভিজ্ঞতাটাই ছিল অসাধারণ। মাশরাফি মানুষ হিসাবে কেমন সেটা তো সবাই জানেই। খুব বন্ধুভাবাপন্ন। নড়াইলে গিয়ে ওর বাবা-মা, মামা, বন্ধুদের কাছ থেকে যে আপ্যায়ন পেলাম সেটা ছিল অবিশ্বাস্য। সবচেয়ে মজার ব্যপার যেটা, হয়তো ভাবতে পারেন একজন সাংবাদিক আসছে তাই এতকিছু; কিন্তু প্রথমদিন তারা জানতোও না যে আমি সাংবাদিক। শুধু বলেছিলাম, আমি মাশরাফির বন্ধু। তাতেই তারা খুব যত্ন-আত্তি করা শুরু করে দিল। তার মানে ওই পরিবার এবং তার বন্ধুমহল যে কাউকেই আদর-আপ্যায়ন করার জন্য প্রস্তুত থাকে। এই খাওয়ানো দাওয়ানো এবং এরপর ওখানে মজা করা- পুরো ব্যাপারটাই ছিল খুব আনন্দদায়ক। আর যদি বিরক্তিকর অভিজ্ঞতার কথা যদি বলেন, তাহলে বলবো- মাশরাফির ব্যাপারে এই বই লিখতে খুব খারাপ কোন অভিজ্ঞতা হয়নি। কারণ ও এতো জনপ্রিয় যে, যার কাছেই সাহায্য চেয়েছি সবাই একদম দুহাত ভরে দিয়েছেন। এছাড়াও অনেক মজার মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে তার বাসায়। দফায় দফায় ওর স্ত্রীকে, ওর বাচ্চাদুটোকে খুবই জ্বালিয়েছি। এমনও হয়েছে কোন একটা তথ্যের জন্য বা একটা ছবির জন্য দুপুর দু’টার সময় গিয়ে হাজির হয়েছি। ওর স্ত্রী থাইল্যান্ড থেকে এসেছে। দেখা গেছে এখনও ব্যাগও খোলেনি। ওই অবস্থায় আমি গিয়ে হাজির, ‘ভাবি একটা ছবি লাগবে’। এরপর সুমিভাবি ছবি বের করে দিয়েছেন। আর তার বাসায় তো ছবি ওভাবে গোছানোও থাকে না। এগুলো সব ঘোচাতে ওদের অনেক কষ্ট হয়েছে। হ্যাঁ, কখনো কখনো মনে হয়েছে আমি আসলে লোকজনকে একটু বেশি পীড়া দিচ্ছি; কিন্তু কখনো এমন হয়নি যে কেউ সাহায্য করেনি, বা কারো মুখ দেখে মনে হয়নি যে, তিনি সাহায্য করতে চাচ্ছেন না। একটা বিষয় চিন্তা করে খারাপ লেগেছে, যে মনে হয়েছে আমি সবাইকে একটু বেশি পীড়া দিচ্ছি। মাশরাফির এই ব্যস্ত জীবনে দফায় দফায় সাক্ষাৎকার নিয়েও তাকে বেশ বিরক্ত করেছি। এই বইয়ে তার সে সাক্ষাৎকারগুলো ছাপা হয়েছে। এর জন্য আমরা চারবার বসেছি। প্রত্যেকবারই এক ঘণ্টার বেশি সময় লেগেছে। অন রেকর্ড সিটিং সবই। এগুলোর জন্য তাকে কষ্ট করতে হয়েছে। আমার কখনো কখনো মনে হয়েছে, এ জন্য একটু বেশিই কষ্ট দিয়েছি তাকে এবং তার পরিবারকে। এই একটাই পীড়ার জায়গা ছিল।মাশরাফি নিজে যখন আপনার মুখে শুনেছিল, তাকে নিয়ে বই লিখছেন কিংবা লিখবেন। শুনে তার প্রতিক্রিয়া কী ছিল?দেবব্রত : হেসেই উড়িয়ে দিল! বলল, ধুর আমি একটা সাবজেক্ট হলাম নাকি যে আমাকে নিয়ে বই লিখতে হবে! আরও কত কিছু আছে, ওগুলো নিয়ে লেখেন। ২০১৩ সালের ঘটনা ওটা। তখন তো ইনজুরিতে মাশরাফির অবস্থা খুব খারাপ। পূনর্বাসন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এ কারণে মাশরাফি বলেছিলেন, আমাকে নিয়ে বই লেখাটা মোটেও ঠিক হবে না। তাহলে লোকে ভাববে আমি বিরাট কিছু হয়ে গেছি। আমি বিরাট কিছু হতে চাই না। সবাই বলবে আমি হিরো হয়ে গেছি। আমি আসলে হিরো সাজতে চাই না। আমি বললাম, আপনার জীবন নিয়ে লেখা মানেই যে হিরো হয়ে যাবেন তা নয়। মূল বিষয় হলো, আপনাকে তো প্রচুর মানুষ ফলো করে। আপনার জীবনের গল্প জানতে চায়। এ গল্পগুলো জানতে পারলে, তারা অনুপ্রেরণা নিতে পারবে।  আপনার উঠে আসা, জীবন সংগ্রাম এগুলো নিয়েই লিখবো। বইটা কিশোর-তরুণদের অনেক কাজে লাগবে। তারা অনুপ্রেরণা পাবে। এ বিষয়টা বোঝানোর পরই রাজি হয়েছেন, তাকে নিয়ে বই লেখার জন্য। মাশরাফির কোন বিষয়টা লিখতে গিয়ে মনে হয়েছিল, ‘বার বার লিখি এই কথাটা!’দেবব্রত : একটা বিষয় তো কমন ছিলই, তার ইনজুরির ব্যাপারটা। সে যে ফাইটগুলো করছে, তা জানতাম; কিন্তু যখন ব্যাপারগুলো আবার দেখি তখন আমাকেও বিমোহিত করছে যে এ ধরণের কষ্ট পেতে হয়েছে তাকে, এতো কিছু করতে হয়েছে। তবে আমাকে সবচেয়ে বেশি স্পর্শকাতর করেছে যেটা, সেটা হলো নড়াইলের প্রতি মাশরাফির যে ভালোবাসা, যে টান সেটা। সে যেভাবে নড়াইলকে নিজের সঙ্গে সম্পৃক্ত মনে করে, এই ব্যাপারটা আসলে আমি নতুন করে অনুভব করছি। এমনিতেই আমরা সব সময় দিল খোলা মাশরাফিকে দেখি; কিন্তু নড়াইলে মাশরাফি আরও বেশি খোলামেলা। আমি একটা গল্প বলি প্রায়ই। যখন নড়াইলে মাশরাফির সঙ্গে দেখা হলো- আমি সকালে পৌঁছলাম আর তিনি পৌঁছালেন সন্ধ্যার দিকে। যখন দেখা হলো, তখন একটা চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছি। আড্ডার পনেরো কি বিশ মিনিট হবে। এমন সময় হঠাৎ করেই তার মামার মোটর সাইকেলটা বের করে আনলেন। আমি তখন জিজ্ঞেস করতে যাব যে, কোথায় যাচ্ছেন? তার আগেই তিনি আমাকে ডাক দিলেন, আসেন। আমি বললাম কোথায়? বলল, ওঠেন না আমার পেছনে। উঠলাম, উঠার পর তিনি একটা সুপারি বাগানের মধ্যে দিয়ে ইট বিছানো রাস্তা দিয়ে খুব জোরে চালাতে শুরু করলেন। আবার বললাম, কোথায় যাচ্ছি? তিনি বললেন, চলেন। আর কোন কথা বলল না। তারপর তিনি হঠাৎ করে ব্রেক করলেন। অন্ধকার রাত, তখন দেখলাম সামনে একটা নদী। তিনি বললেন, চিত্রা নদীর পারে নিয়ে এসেছি। আপনার বাসায় যদি কেউ যায়, আপনি কি করবেন? প্রথমে আপনার বাবা-মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন, আপনার বাচ্চার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন, আপনার স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন। মাশরাফি তার পরিবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। তারপরেই প্রথম সে চিত্রা নদীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। তার মানে চিত্রা নদীকে সে তার জীবনেরই একটা অংশ মনে করে। এই যে তার চোখে আমি যে আবেগটা আমি দেখেছি, এটা আমার মনের ভেতর অনেক স্পর্শ করে গেছে।বইটা লিখা শেষ হয়ে যাওয়ার পর কী মনে হয়েছে, কোন কিছু বাদ থেকে গেছে? বাদ পড়লে সেটা কি?দেবব্রত : মনে তো হচ্ছে অনেক কিছুই বাদ দিয়ে ফেলেছি। মনে হচ্ছে, ইস ! এই বিষয়টা কিংবা ওই বিষয়টা যদি জুড়ে দিতে পারতাম, তাহলে অনেক ভালো হতো! বিশেষ করে মাশরাফির পূনর্বাসন প্রক্রিয়াটা বিস্তারিত লিখতে পারিনি। প্রতিদিন তার যে কষ্ট, কিছুদিন পর পর যেভাবে রিহ্যাব করতে হয়, সেটা বিস্তারিত লিখতে পারলে ভালো হতো। কিংবা মাশরাফির ছোটবেলার অনেক কিছুই বাদ পড়ে গেছে। তবে, তাকে নিয়ে আরও অনেক কিছু লেখার চিন্তা আছে। দেখি, যদি দু’চার বছর পর সব কিছু ঠিক-ঠাক থাকলে এই বইটারই আরেকটা সংস্করণ করতে পারি কি না। তাহলে সেখানে আরও অনেক কিছু লিখতে পারবো। কারণ, মাশরাফির জীবনটাই তো একটা চলমান প্রক্রিয়া, চলমান উপন্যাস।## আগামীকাল পড়ুন, সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্ব, ‘মাশরাফি নিজেকে নিয়ে একটু বেশিই খামখেয়ালি’আইএইচএস/পিআর

Advertisement