মাস্টার্স পাশ করে পৈত্রিক ব্যবসা করতেন ইশাতিয়াক। স্বপ্ন ছিল চাকুরি নয়, কৃষিতে কিছু একটা করার। বাজারের ভেজাল সবজি দেখে চিন্তাটা মাথায় আসে। সিদ্ধান্ত নেন রাসায়নিক সার ও রাসায়নিক কীটনাশকমুক্ত সবজি ও ফল উৎপাদনের। বন্ধু কৃষিবিদ শাহদাতেরও স্বপ্ন ছিল ‘কৃষক মানেই ছেড়া গেঞ্জি আর লুঙ্গি পড়া রুগ্ন মানুষ’ এ ধারণা বদলে দিতে। গত ১ ফেব্রুয়ারি বাড়ির পাশের নিজেদের পতিত প্রায় দেড় বিঘা এবং সামান্য কিছু লীজ নিয়ে স্বপ্ন বাস্তায়নে হাত লাগান দুই বন্ধু।
Advertisement
রমজানের চাহিদার কথা মাথায় রেখে চাষ করেন শসা, বেগুন ও হলুদ তরমুজের। পরবর্তীতে লাগান অনান্য সবজিও। এপ্রিলের মাঝামাঝি ফলন আসা শুরু হয়। ৭ শতাংশ জমিতে লাগানো জমিতে গত সপ্তাহ পর্যন্ত শসা বিক্রি হয়েছে ৩০ হাজার টাকার। প্রতিদিন বেগুন বিক্রি হচ্ছে হাজার টাকার। এখন দুইজন শ্রমিক সার্বক্ষণিক কাজ করে। এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে তিন লাখ টাকার মত। বেড়া, পানির পাম্প, মাচা, বেড তৈরিসহ প্রাথমিক কাজের জন্য খরচ বেড়েছে। আগামীতে এসব খরচ লাগবে না। এ বছরে বিনিয়োগের শতভাগ ফেরত আসবে আশা তার। তরুণ ওই কৃষক বলেন, ‘যে জমিতে ফার্ম গড়ে তোলা হয়েছে, ফসল হতো না বলে তা বছরের পর বছর ছিল পতিত। তারা দুই বন্ধু জৈব পদ্ধতিতে চাষ শুরু করে স্থানীরা আমাদের পাগল বলত। বাঁকা চোখে দেখে হাসাহাসি করতো, টিপ্পনী কাটতো। এখন তারাই বিস্ময় নিয়ে ফার্ম দেখতে আসেন। উৎসাহ দেয়। নিজেরাও এভাবে ফার্ম করার আগ্রহ দেখায়। শুরুতে বাবা-মা-ও অসন্তুষ্ট ছিলেন। বলেতেন,- এত লেখাপড়া করালাম কৃষি করার জন্য! ফলন আসার পর তারাও অনেক খুশি। আনন্দে পরিণত হয়েছে আমাদের পরিশ্রম।
সবজি বাগানটি ঘুরে দেখা গেছে, শুধু শসা বা বেগুন নয়, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, ঢেঁড়শ, করলা, চিচিংগা, ঝিংগা, ডাটাসহ সব সবজিতেই ঠাসা ইশতিয়াকদের ফার্মে মাচা। তবে সবচেয়ে তাক লাগানো সাফল্য এসেছে হলুদ তরমুজে। প্রতিটি মাচায় ঝুলছে ‘তৃপ্তি’ জাতের শত শত হলুদ তরমুজ। দেখে মনে হবে হলুদের রাজ্য। সারি সারি মাচা। কোনটায় দুলছে হলুদ তরমুজ। কোনটায় লাউ, মিষ্টি কুমড়া, শষা, চিচিংগা, করলা, উস্তা, কিংবা ঝিংগা। মাচার ফাঁকে ফাঁকে থরে থরে বেগুন, ঢেঁড়স, ডাটা, পেঁপে, পুই শাকের প্লট। চোখ জুড়ানো এ দৃশ্য দেখা মিলবে গাজীপুর শহর থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে নগরীর ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের ছোট দেওড়া এলাকার কৃষিবিদ শাহাদাত হোসেন ও ইশতিয়াক মুনীমের কৃষি খামারে। ‘বিষমুক্ত সবজি ও ফল’ উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে প্রায় দুই একর জমিতে ওই দুই তরুণ উদ্যোক্তা গড়ে তুলেন ফার্মটি। নাম দিয়েছেন ‘বায়ো গ্রিন এগ্রো ফার্ম’। মাত্র আড়াই মাসেই পেয়েছেন তাক লাগানো সাফল্য। এতে উৎসাহিত হচ্ছেন অনেক বেকার ও সাধারণ চাষি।
অপর উদ্যোক্তা শাহাদাত বলেন, তাদের সাফল্যের পেছনে রয়েছে আধুনিক ‘মালচিং’ পদ্ধতির চাষাবাদ। এ পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য বেড় তৈরি করে মাটি এক ধরনের বিশেষ প্লাস্টিক কাগজ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। নির্দিষ্ট দূরত্বে কাগজ ফুটো করে চারা লাগানো হয়। বিশেষ এ কাগজ মাটির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও গুণগত মান ঠিক রাখে। সেচ কম লাগে। আগাছা জন্মাতে পারে না।
Advertisement
জৈব সারের সক্ষমতা ধরে রাখে এক বছর। ফার্মে রাসয়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার হয় না। সার কীটনাশক সব জৈব। পোকামাকড় মারতে ব্যবহার করেন ফেরোমিন ফাঁদ প্রযুক্তি। শাহাদতের মতে, তাদের সাফল্যের পেছনে আরেকটি কারণ হল বীজ নির্বাচন। পারপল কিং ও স্থানীয় চুমকি জাতের বেগুন, সামার শট জাতের ঝিংগা, সুপ্রীম প্লাস জাতের শসা, বারমাসী লাউ ময়না, ডায়না ও বারী-৪ জাতের বীজ বপণ করেন। লাউ বীজ মার্চের ১৫ তারিখে বপণ করার পর ২৮ দিনেই ফলন আসতে শুরু করে।
আর ফার্মের যে হলুদ তরমুজ নিয়ে চারদিকে এত হৈচৈ, সেটি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত তৃপ্তি জাতের। মার্চের ১০ তারিখে বীজ রোপণ করার পর এপ্রিলের মাঝামাঝি ফল আসতে শুরু করে। মে’র প্রথম সপ্তাহে কাটা হবে ফল। হলুদ তরমুজের জন্য প্রতিদিনই বুকিং হচ্ছে।
তিনি জানান, ‘তাদের সব সবজি ও ফল ফার্ম থেকেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। তারপরও কৃষিতে বড় ‘প্রতিবন্ধকতা পণ্যের বাজার মূল্য’ ও ‘সামাজিক প্রতিবন্ধকতা’। লেখাপড়া জানা মানুষ কৃষিতে আসবে না এ ধারণা পাল্টাতে হবে।
ভবিষ্যতে একটি ‘কৃষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন’ এবং ‘চাকুরির পিছনে না ঘুরে শিক্ষিত কৃষক সমাজ তৈরির স্বপ্ন রয়েছে এই দুই যুবকের।
Advertisement
মো. আমিনুল ইসলাম/এমএমএফ/এএসএম