বিনোদন

তরুণরাও এখন আগ্রহ নিয়ে রবীন্দ্রসংগীত শুনছে : অপর্ণা খান

ছোটবেলা থেকেই সংগীতের সঙ্গে জড়িত অপর্ণা খান। কাব্যচর্চা ছাড়াও তিনি সাংস্কৃতিক নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। উৎস সাংস্কৃতিক পরিষদ ও উৎস নাট্যদল নামে তার নিজের দুটি সংগঠন রয়েছে। ভবিষ্যতে এই সংগঠনে সংগীত ও নাট্যকলার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চান তিনি।

Advertisement

এছাড়া তিনি বাংলাদেশ রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থা, পঞ্চকবির গানের সংগঠন ‘গীত শতদল’ ও সরগম সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্য। জাগো নিউজ’র সঙ্গে তিনি কথা বলেন তার সংগীত চর্চা নিয়ে। লিখেছেন মাসুম আওয়াল-

জাগো নিউজ : আপনার গান গাওয়ার শুরুটা কীভাবে?অপর্ণা খান : খুব ছোটবেলা থেকেই গান করি। তখন বাবার চাকরি সূত্রে আমরা খুলনায় থাকতাম। বাবা ফুড অফিসে চাকরি করতেন। খুলনা নজরুল একাডেমিতে প্রথম গান শিখতে শুরু করি। আমার ওস্তাদ ছিলেন রাশেদ উদ্দিন তালুকদার। উনি ক্ল্যাসিক্যাল শেখাতেন।

উনি আমাকে একদিন বললেন তোমার কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত ভালো লাগে। আমাকে সাধন সরকারের কাছে পাঠালেন রবীন্দ্রসংগীত শেখার জন্য। এভাবেই শুরু।

Advertisement

নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতা যখন শুরু হলো। আমি খুলনা থেকে ঢাকায় এসেছিলাম। এছাড়া খুলনায় যে সব প্রোগ্রাম হতো সেখানে গান করেছি। রেডিওতে ছোটদের ‘কল্লোল’ নামে একটা অনুষ্ঠান হতো। সেখানে প্রোগ্রাম করতাম। খুলনায় সুন্দরবন কলেজে নবীনবরণ অনুষ্ঠানেও গান গেয়েছি। তখন ক্লাস টু বা থ্রিতে পড়ি। বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণায়ই গান শিখি।

জাগো নিউজ : সারাজীবন গান গাইবেন। এই চিন্তা কখন থেকে এলো?অপর্ণা খান : সেটা অনেক পরে। আমি যখন কলেজে পড়ি তখন থেকে গানের প্রতি ভালোবাসাটা তৈরি হলো অন্যরকম ভাবে। মজার ব্যাপার হলো তখন আমি প্রচুর আধুনিক গান শুনতাম। রবীন্দ্রনাথের গানের পরই আধুনিক গান আমাকে ভীষণভাবে টানে।

সেই সময় একটি মাত্র টিভি চ্যানেল বিটিভি। এখানে গান গাওয়ার সুযোগ পেলে অনেক ভালো লাগতো। পরে সেটা বাস্তবায়ন হলো।

জাগো নিউজ : বিটিভিতে প্রথম গান গাওয়ার সুযোগ এলো কবে?অপর্ণা খান : ১৯৯৬ সালে। ১৯৯৪ সালে ঢাকা আসি। বিটিভিতে অডিশন দিয়ে লিস্টেড হই। আমি যখন অডিশন দিতে যাই, ‘ডাকবো না ডাকবো না’ গানটি গেয়েছিলাম। বিচারক ছিলেন। টেলিভিশনে প্রথম কোন গানটি গেয়িছিলাম মনে নেই। এরপর অনেক গেয়েছি।

Advertisement

জাগো নিউজ : আপনার গানের অ্যালবাম প্রকাশ হয়েছে কয়টা?অপর্ণা খান : আমার একক অ্যালবাম প্রকাশ হয়েছে চারটা। প্রথম অ্যালবাম প্রকাশ হয় ২০০৩ সালে; তপন মাহমুদের সংগীতে ‘উতল হাওয়া’, ২০১২ সালে সুজয় শ্যাম দার পরিচালনায় প্রকাশ হয় ‘প্রতিদিও তব গাঁথা’ আর তৃতীয় অ্যালবামটি হলো অজয় মিত্রের পরিচালনায় ‘তুমি কেবলি স্বপন করেছ বপন’।

চতুর্থ অ্যালবামের কাজ চলছে। চতুর্থ অ্যালবামে রবীন্দ্রসংগীতের পাশাপাশি আধুনিক গানও করেছি। এই অ্যালবামের সংগীত পরিচালনা করছেন বিনোদ রায়। মিশ্র অ্যালবামের জন্যও গেয়েছি। এছাড়া গানও লিখি মাঝে মধ্যে। আমার লেখা গানের সুরও করেছেন বিনোদ রায়। সেই গানটিও প্রকাশ হয়েছে।

জাগো নিউজ : রবীন্দ্রনাথের গানের প্রেমে পড়লেন কেন?অপর্ণা খান : রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী ও সুর আমাকে আকৃষ্ট করেছে। আমার গলাটিও পারফেক্ট মনে হয়েছে এ গানের জন্য। তিনি সাহিত্যে সব বিভাগেই হেঁটেছেন। আমি ছোটবেলা থেকেই অনেক বই পড়তাম। বইপোকা ছিলাম বলতে পারেন। সেই থেকেই একটু একটু করে রবীন্দ্রনাথকে জানা। তারপর গান করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের গানে বাণী ও সুরে হারিয়ে গিয়েছি।

অন্য শিল্পীদের অনেক হালকা কথার গানও কিন্তু শুধু সুরের কারণে শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গানের কথা ও সুর দুটোই অনেক গভীরে নিয়ে যায় আমাদের। একসময় পঙ্কজ মল্লিক, সাগর সেন, সুবিনয় রায় রবীন্দ্রনাথের গান গেয়েছেন।

তাদের কণ্ঠে সেই সব গান জনপ্রিয় হয়েছে। সেই চর্চা বেড়েছে ধীরে ধীরে। এখন কিন্তু প্রচুর মানুষ রবীন্দ্রসংগীত শোনেন। আমিও রবীন্দ্রসংগীতকে আপামর জনতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করে যেতে চাই।

জাগো নিউজ : এখন তো রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে ফিউশনও হচ্ছে, এটা কতটা যৌক্তিক?অপর্ণা খান : কথা ও সুর ঠিক রেখে ফিউশন করা হলে দোষের কিছু না। মিউজিকের কিছু আধুনিকায়ন হতেই পারে। এর মাধ্যমে এখনকার তরুণ সমাজও বেশ আগ্রহ নিয়ে রবীন্দ্রসংগীত শুনছে। ফিউশন করার ইচ্ছা আমারও আছে।

পশ্চিমবঙ্গে দেখা যায় ফিউশন করতে গিয়ে অনেক সময় রবীন্দ্রসংগীতের মধ্যে র‌্যাপ সংযোজন করা হচ্ছে। আমি এটার বিপক্ষে।

জাগো নিউজ : পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা হচ্ছে, আমাদের দেশে কী সেভাবে হচ্ছে?অপর্ণা খান : আমরা তো মনে হয় ওদের চেয়ে আমরাই বেশি বাঁচিয়ে রেখেছি রবীন্দ্রসংগীতকে। শুধু রবীন্দ্রনাথের গান নয়, বাংলা ভাষাকেও আমরাই বেশি বাঁচিয়ে রেখেছি। আমি কলকাতায় অনেক প্রোগ্রাম করেছি। ওখানে দেখেছি রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়, আমাদের এখানে এটা সম্ভব হয় না।

জাগো নিউজ : বাংলাদেশের কোন কোন শিল্পীর কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শুনতে ভালো লাগে আপনার?অপর্ণা খান : আমি ছোটবেলা থেকে যাদের গান শুনে বড় হয়েছি তাদের মধ্যে প্রিয় তপন মাহমুদ, সাদি মহম্মদ, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, পাপিয়া সারোয়ার। তবে মিতা হকের গান আমার অনেক বেশি ভালো লাগে। এখন আরও অনেকেই ভালো গাইছেন। অদিতি মহসীন আছেন। আরও অনেক নামই বলা যাবে যাদের গান আমার ভালো লাগে।

জাগো নিউজ : আপনিতো সংগীত নিয়ে পড়ালেখাও করেছেন।অপর্ণা খান : আমি শান্তা মারিয়াম ইউনিভার্সিটিতে রবীন্দ্রনাথের গানের ওপর মাস্টার্স করেছি। কলিম ভাই, তপন মাহমুদ তাদের কাছেও শিখেছি। এখন একটা গানের সংগঠন করেছি। নাম ‘গানের খেয়া’। এটাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চাই। গানের একাডেমি করতে চাই। আমাদের এখানে গান শিখবে শিশুরা।

গানের খেয়া নিয়ে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি। মিডিয়াটা অনেক কঠিন এখানে ভালো গাইলেই গান গাওয়ার সুযোগ পাওয়া যায় না। সেই ক্ষেত্রে প্রতিভাবান শিল্পীদের আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। গানের খেয়ার মাধ্যমে এরই মধ্যে অনেকেরই গান গাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমার সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের সংগঠনের সভাপতির নাম স্বপন দাস। উনিও অনেক সময় দেন এই সংগঠনের জন্য।

জাগো নিউজ : গান গাওয়ার পাশাপাশি আপনি লেখালেখিও করেন। সেদিকের কিছু কথা জানবো...অপর্ণা খান : হ্যাঁ। আমার একটি কবিতার বইও প্রকাশ হয়েছে। ২০১৭ সালে প্রথম কবিতার বই প্রকাশ করি। গত বই মেলায়ও একটি কবিতার বই প্রকাশ করার ইচ্ছা ছিল। সামনে হয়তো আসবে নতুন কবিতার বই। পাণ্ডুলিপি তৈরি করা আসলে কঠিন একটা কাজ। লেখা সহজ।

জাগো নিউজ : আপনার স্বামী রাহাত খান স্বনামধন্য একজন লেখক ও সম্পাদক। লেখালেখিটা কি তার অনুপ্রেরণায় হয়েছে?অপর্ণা খান : সেটা তো আছে (হাসতে হাসতে)। কথায় বলে না সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। তার লেখা আমি পড়তাম। ওর লেখা ‘এক প্রিয়দর্শিনী’ আমার প্রিয়। আরেকটা বই আছে ‘ছায়াসঙ্গী’ এই বইটাও আমার প্রিয়।

জাগো নিউজ : উনার লেখা গল্প কিংবা উপন্যাসে নিজের ছায়া কি দেখেন?অপর্ণা খান : অনেক আগে একটা গল্প পড়ে এমন মনে হয়েছিল। একটা ম্যাগাজিনে প্রকাশ হয়েছিল গল্পটা। বিচিত্রার ঈদ সংখ্যায় সম্ভবত। গল্পটার নাম মনে পড়ছে না। আমি ছাপা হওয়ার পরই পড়ি ওর লেখা। এই গল্পটা পড়ে মনে হলো এটা আমাকে নিয়ে লেখা। আমি জানতে চাইলাম, এটা কী আমাকে নিয়ে লিখেছ। ও বললো বুঝতেই তো পেরেছ।

জাগো নিউজ : তার লেখালেখিকে ঘিরে আর কোন গল্প মনে পড়ে?অপর্ণা খান : মনে পড়ে আমাদের বাসায় একটা কুকুর পুষতাম। এটা পরে কিছু কারণে ফেরত দিয়েছিলাম। অনেক খারাপ লেগেছিল আমাদের। সেটা নিয়েও একটা দারুণ গল্প লিখেছিল। গল্পটা পড়ে আমরা বাসার সবাই কেঁদেছি। লেখকরা শুধু নিজের জীবনের গল্পই বলেন না। তার আশপাশের সব কিছুর গল্প বলেন।

এসব পড়েই আমারও ইচ্ছা হলো লিখি। কবিতা লেখার চেষ্টা করলাম। কবিতা লেখা আসলে অনেক কঠিন কাজ। প্রবন্ধ কিংবা সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লিখতে চেষ্টা করি।

জাগো নিউজ : অনেকগুলো সংগঠনের সঙ্গে আছেন আপনি।অপর্ণা খান : রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থা, সারগাম সাংস্কৃতিক দল, সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংসদ, রবীন্দ্র একাডেমি এমন শিল্প সাহিত্যের সংঠনের সদস্য।

জাগো নিউজ : আপনার শৈশব-কৈশোর কোথায় কেটেছে?অপর্ণা খান : আমাদের বাড়ি বরিশাল। তবে ছোটবেলায় আমরা ঢাকায়ই ছিলাম। ঢাকায় ফুড অফিসে চাকরি করতেন বাবা। পরে বাবা খুলনায় বদলি হলেন। এরপর খুলনায় অনেক দিন ছিলাম। পরে বাবা চাকরি ছেড়ে খুলনায় ব্যবসা করতেন। একসময় নাড়ির টানে বরিশালে চলে যান। আমি ১৯৯৪ সালে ঢাকায় আসি আবারও মাস্টার্স পড়তে।

পড়ালেখা করেছি খুলনা পায়োনিয়ান গার্লস স্কুলে, এরপর ঝালকাঠি সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করি। বরিশাল বিএম কলেজ থেকে পলিটিক্যাল সাইন্সে অনার্স, ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৯৫ সালে পলিটিক্যাল সাইন্সে মাস্টার্স করেছি। এরপর ২০১২ সালে সান্তা মারিয়াম ইউনিভার্সিটি থেকে মিউজিকে মাস্টার্স করেছি।

জাগো নিউজ : আপনার গানের প্রথম অনুপ্রেরণা ছিলেন আপনার বাবা-মা। তাদের প্রসঙ্গে জানতে চাই। আপনার পরিবার...অপর্ণা খান : আমার বাবার নাম নিমাই লাল মণ্ডল, মায়ের নাম কৃষ্ণা রানী মণ্ডল। বাবা নেই, মারা গেছেন দুই বছর আগে। মা বেঁচে আছেন। বাবাকে খুব মিস করি আমি। তার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। বাবা আমাকে গানের স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। মা গানের স্কুলে নিয়ে যেত, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। আমি গান গাইতাম। বাবার হাতের লেখা খুব চমৎকার ছিল। আমার গানের খাতার সব গান বাবা হাতের লেখা।

বাবার খুব ইচ্ছা ছিল আমাকে টেলিভিশনে দেখার। আমি প্রথম যেদিন গাইলাম বিটিভিতে অনেক খুশি হয়েছিলেন বাবা। আমার অ্যালবাম প্রকাশ হলে বাবা আমার অ্যালবামের নিউজ পত্রিকা থেকে কেটে রাখতেন।

জাগো নিউজ : যা হতে চেয়েছেন, সেটা নিশ্চয়ই হতে পেরেছেন?অপর্ণা খান : হতে পেরেছি কী? আমি তো আমার কাজ নিয়ে তৃপ্ত হতে পারি না। গান গাওয়া শেষ হলে মনে হয় এটা আরো ভালো হতে পারতো। সেই গান শুনে হয়তো অনেকেই প্রশংসা করলো। তবু আরও ভালো গাওয়ার ইচ্ছাটা থেকেই যায়। এখনো অনেকের গান শুনে মনে হয় এমন ভালো যদি গাইতে পারতাম। ছোটবেলায় আশা ভোঁসলের ভক্ত ছিলাম। আশা ভোঁসলের লাইভ গান গাওয়া দেখতে গিয়েছি।

অনেক বড় বড় শিল্পীর লাইভ গান শুনেছি। তাদের গাওয়া, হাঁটাচলা, কথা বলা সব কিছুই আমাকে মুগ্ধ করে। আমারও অনেক ভালো গাইতে ইচ্ছা করে। সংগীত আসলে অনেক বড় একটা সাধনা। আমি এখনো গান শিখি কলকাতার একজন শিল্পীর কাছে। উনার নাম সুতপা ভট্টাচার্য। সংগীত সাধনা, ঈশ্বরকে পাওয়ার মতো একটা সাধনা।

এমএবি/এলএ/এমএস