দেশের বাজারে মার্কিন ডলারের সঙ্কট তীব্র হয়েছে। ফলে বেড়েই চলেছে ডলারের দাম। এদিকে দুর্বল হচ্ছে টাকার মান। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে ৮৪ টাকা ২৫ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করছে, যা এক বছর আগের তুলনায় ১ টাকা ২৯ পয়সা বেশি। তবে সাধারণ মানুষ, যারা ভ্রমণ করতে বিদেশে যাচ্ছেন, তাদের ৮৬ টাকা দরের উপরে কিনতে হচ্ছে ডলার।
Advertisement
সংশ্লিষ্টরা জানান, আমদানি-রফতানির ভারসাম্য না থাকা, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ, অর্থ পাচারসহ নানা কারণে ডলারের বাজারে এ সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে রফতানি বাণিজ্য ও প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স পাঠানোর বিষয়ে কিছুটা উৎসাহিত হলেও, বেড়ে যাচ্ছে পণ্য আমদানির ব্যয়। যার ফলে খাদ্যশস্য, ভোগ্যপণ্য, জ্বালানি তেল, শিল্পের কাঁচামালসহ সব আমদানি পণ্যের ব্যয় বাড়বে। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতিতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরে কয়েক দফা ডলারের দাম বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বছর শুরুর দিন আন্তব্যাংক রেটে ডলারের দাম ছিল ৮৩ টাকা ৯০ পয়সা। দুই দিন পর ৩ জানুয়ারি ডলারের দাম ৫ পয়সা এবং ১১ ফেব্রুয়ারি ১০ পয়সা দাম বাড়ায় আর ১৪ ফেব্রুয়ারি ৭ পয়সা বাড়িয়ে ডলারের দাম ৮৪ টাকা ১২ পয়সা নির্ধারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর চলতি মাসে তিন দফা দাম বাড়ানোর ফলে এখন আন্তব্যাংক রেটে ডলারের দাম দাড়িয়েছে ৮৪ টাকা ২৫ পয়সা। যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ দর।
বাজারের বাস্তবতা অবশ্য ভিন্ন। বেশ কিছু ব্যাংক ডলার সঙ্কটের কারণে পণ্য আমদানির ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। কিছু ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের হারের চেয়ে বাড়তি মূল্য আদায় করছে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। আর সাধারণ মানুষ, যারা ভ্রমণ করতে বিদেশে যাচ্ছেন, তাদের ডলার কিনতে হচ্ছে ৮৬ টাকার উপরে।
Advertisement
ডলারের দাম বাড়ার প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ডলারের দাম বাড়ার প্রধান কারণ বাণিজ্য ঘাটতি। যে হারে আমদানি হচ্ছে সেই হারে রফতানি আয় হয়নি। বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের চলতি হিসাবে ঋণাত্মক হয়ে গেছে। আর এটি পূরণ করতে গিয়ে বাড়তি চাপে ডলারের দাম বেড়েছে।
তিনি বলেন, ডলারের দাম বাড়লে দেশের রফতানিকারকরা কিছুটা লাভবান হলেও আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। আর আমদানি ব্যয় বাড়লে তার প্রভাব পরে স্থানীয় বাজারের পণ্যমূল্যে। যার কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ে। যার প্রভাব পরে জীবনযাত্রার ব্যয়ে; কষ্ট করে সাধারণ মানুষ।
ডলারের দামের চাপ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিয়ে অর্থনীতিবিদ মির্জা আজিজুল বলেন, বাজারে ডলার বিক্রি করে চাপ সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু তাদের অন্য দিকগুলো নিয়ে চিন্তা করতে হবে। বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে রফতানি বাড়াতে হবে। কীভাবে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো যায় তার উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া অর্থ পাচার ঠেকাতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
মানি এক্সচেঞ্জের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের অক্টোবর-নভেম্বর থেকেই ডলারে সঙ্কট রয়েছে। এর প্রধান কারণ, যে পরিমাণ আমদানি এলসি খোলা হয়েছে, সে পরিমাণ ডলার ব্যাংকগুলোর কাছে নেই। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক যে পরিমাণ ডলার বিক্রি করছে, সেটি চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। আবার এখন হজের নিবন্ধনের জন্য বাড়তি ডলার লাগছে। সবমিলিয়ে চাহিদা বেশি থাকায় ডলারের দাম বেড়েছে।
Advertisement
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, অর্থবছরের সাত মাসে (জুলাই- জানুয়ারি) ইপিজেডসহ রফতানি খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে ২ হাজার ৩৮০ কোটি ২০ লাখ ডলার। এর বিপরীতে আমদানি বাবদ ব্যয় করেছে ৩ হাজার ৩৪৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার। সেই হিসেবে জানুয়ারি শেষে দেশে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ৯৬৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার যা বাংলাদেশি মুদ্রায় (বিনিময় হার ৮৫ টাকা দরে) ৮১ হাজার ৯৭৪ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
আলোচিত সময়ে বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের চলতি হিসাব (-) ঋণাত্মক রয়েছে। অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে চলতি হিসাবে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৩৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৫৪০ কোটি ২০ লাখ ডলার।
বর্তমানে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ৩ হাজার ১৪৯ কোটি ডলার। এর আগে ২০১৭ সালের জুনে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার রিজার্ভ অতিক্রম করেছিল।
এসআই/এমএসএইচ/পিআর