দেশজুড়ে

আফিলের আসনে টিকিট চান লিটন, তৃপ্তিতে দুশ্চিন্তা বিএনপির

আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত যশোর-১ (শার্শা) আসন নৌকার হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। শক্ত হাতে বৈঠা ধরে সেই আসনে নৌকাকে মজবুত করেছিলেন বিশিষ্ট শিল্পপতি শেখ আফিল উদ্দিন। নৌকার টিকিট পেয়ে তাই ২০০৮ ও ২০১৪ সালে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন তিনি। কিন্তু এমপির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে এখন আওয়ামী লীগের ‘ঘরের মধ্যেই ঘর’ হয়ে গেছে।

Advertisement

এবারের সংসদ নির্বাচনে তাই তিন জন নৌকার মাঝি হতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। আফিল উদ্দিনের নৌকার টিকিট এবার ছিনিয়ে নিতে সচেষ্ট বেনাপোলের মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফুল আলম লিটন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আবদুল মাবুদ। পাশাপাশি বিএনপির ৫ প্রার্থীও ধানের শীষ মার্কা পেতে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেখানেও রয়েছে দলের মধ্যে বিবাদ। সংস্কারপন্থী খ্যাত বহিষ্কৃত সাবেক কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক মফিকুল হাসান তৃপ্তিকে ঠেকাতে মরিয়া একটি পক্ষ। আবার জামায়াতের অস্তিত্ব নিয়েও রয়েছে বিএনপিতে ভয়। এসব কারণে যশোর-১ আসনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দু’দলেই রয়েছে নানা আলোচনা-গুঞ্জন। যশোরের শার্শা উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে যশোর-১ আসন গঠিত। দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল এই আসনে অবস্থিত। সব দলের জন্য এই আসনটি মর্যাদার। বিগত ১০টি সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ৫ বার, বিএনপি ৩ বার, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত একবার করে বিজয়ী হয়েছে। এই আসনে দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের তবিবর রহমান সরদার, ১৯৭৯ সালে বিএনপির আলী তারেক, ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির নজরুল ইসলাম, ১৯৮৮ সালে জামায়াতের নূর হোসেন, ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের তবিবর রহমান সরদার, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপির মফিকুল হাসান তৃপ্তি, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন আওয়ামী লীগের তবিবর রহমান সরদার, ২০০১ সালে বিএনপির আলী কদর, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের শেখ আফিল উদ্দিন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৪ সালে শেখ আফিল উদ্দিন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।

আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শার্শার তৃণমূলের রাজনীতিতে শেখ আফিল উদ্দিনের অবস্থান অত্যন্ত সুসংসহ। ২০০১ সালে রাজনীতিতে এসে শার্শা আওয়ামী লীগের ভাঙা সংসার নতুন করে সাজিয়ে দলকে মজবুত করে গড়ে তোলেন। এ কারণে বেনাপোল পৌরসভা নির্বাচন, ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় হয়।

২০০১ সালে নৌকা মার্কা নিয়ে রাজনীতির মাঠে আসা বিশিষ্ট শিল্পপতি শেখ আফিল উদ্দিন প্রথম নির্বাচনে পরাজিত হলেও দল পুনর্গঠন ও সুসংহত করেন। এ জন্য প্রথম দিকের এক দশক ধরে শার্শা ও বেনাপোলে আওয়ামী লীগের একক নেতৃত্ব দেন। ২০০৮ সালে তাই ঝামেলা ছাড়াই তিনি নৌকার মাঝি হয়েছিলেন।

Advertisement

কিন্তু এরপরই দলে বিভক্তি শুরু হয়। দলের একাংশ আফিলের বিপক্ষে চলে গিয়ে বেনাপোলের মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফুল আলম লিটনের অনুসারী হন। প্রথম দিকে এটা তীব্র ছিল না। তাই ১০ম সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়াই নৌকার টিকিট পেয়ে এমপি হয়েছিলেন আফিল উদ্দিন।

কিন্তু বেনাপোল পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম লিটনের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব দিনে দিনে প্রকট হয়েছে। লিটন তাই জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের আসনে বসে আফিল উদ্দিনের সঙ্গে টক্কর দিতে শুরু করেন। মাঠের কর্মীদের একটি অংশও তিনি টানতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমান এই দুই নেতাকে ঘিরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে চলছে ঠাণ্ডা লড়াই।

এ বিষয়ে আফিল উদ্দিনের দিকে ইঙ্গিত করে আশরাফুল আলম লিটনের দাবি, শার্শার বিশেষ এক ব্যক্তি দলের গঠনতন্ত্র মানেন না। জেলা কমিটি উপজেলা সংগঠনের ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের কমিটি দিয়েছে। উনি বিপক্ষে পাল্টা কমিটি দিয়ে দলে বিভাজন সৃষ্টি করেছেন। তিনি ইউপি নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভানেত্রীর নৌকা প্রতীকের বিপক্ষে প্রার্থী দিয়েছেন। দলের বিপক্ষে ধারাবাহিক কর্মকাণ্ডের কারণে শার্শার মানুষ পরিবর্তন চায়। তৃণমূলের কর্মীরা চায় নতুন মুখ।

তবে আফিল উদ্দিনের বিকল্প নেই উল্লেখ করে শার্শা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুর রহিম সরদার দাবি করেন, উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে এমপি শেখ আফিল উদ্দিন নজিরবিহীন উন্নয়ন করেছেন। রাস্তা, স্কুল-কলেজ নির্মাণ করেছেন। শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে খাতা-কলম দিচ্ছেন। জুটমিল স্থাপন করে প্রায় ১০ হাজার নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে একটি বিপ্লব ঘটেছে। আর কর্মীরা চাকরি, চিকিৎসা, অনুদান যখন যা বলেছেন এমপি তাই করেছেন। ফলে এমন নেতাকে মনোনয়ন না দেয়ার কোনো কারণ নেই।

Advertisement

এ দিকে আফিল ও লিটনের দ্বন্দ্বের অবসান না হলে এই আসনে নৌকা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা তৃণমূল আওয়ামী লীগের।

স্থানীয় কয়েকজন নেতা জানান, আফিলের লোকজন লিটনের লোকজনকে সহ্য করতে পারেন না। ঠিক লিটনের সমর্থক নেতাকর্মীরাও আফিলের নেতাদের দেখতে পারেন না। দু’নেতার সমর্থকদের বিবাদে এই আসন হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা তাদের।

এদিকে, দল নির্বাচনে গেলে ধানের শীষ প্রতীকের জন্য বিএনপির ৫ প্রার্থী আশায় বুক বেঁধেছেন। বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মহসীন কবীর, শার্শা উপজেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুজ্জামান মধু ও সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসান জহির, যুবদলের কেন্দ্রীয় সদস্য নুরুজ্জামান লিটনের নাম শোনা যাচ্ছে। আর এই প্রার্থীরা আতঙ্কে আছেন বিএনপির বহিষ্কৃত সাবেক কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক মফিকুল হাসান তৃপ্তিকে নিয়ে। তাকে আবারও দলে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে এমন গুঞ্জনে শার্শা বিএনপির রাজনীতিতে বেশ কয়েকবার ঝড় উঠেছে।

তৃপ্তির পক্ষে-বিপক্ষে কয়েক বার সংবাদ সম্মেলনও হয়েছে। তৃপ্তিকে দলে ফিরিয়ে নেয়া হলে তার মনোনয়নপ্রাপ্তির সম্ভাবনা রয়েছে। তবে মনোনয়নপ্রত্যাশী শার্শা উপজেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুজ্জামান মধুর ঘনিষ্টজনরা বলছেন, মধু নিবেদিত নেতা। দলের দুর্দিনে হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন। আগামী দিনে দল তাকেই মূল্যায়ন করবে। আর সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসান জহিরের লোকজনের ভাষ্য, শার্শা বিএনপি টিকিয়ে রেখেছেন হাসান জহির। তাই তার বাইরে দলের মনোনয়ন যাওয়ার কারণ নেই।

আর স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মহসীন কবীর বললেন, তিনি শার্শাবাসীর সেবা করতে চান। এজন্য তিনি ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনের মাঠে নামতে চান।

এদিকে, জোটগত নির্বাচন হলে বিএনপির অবস্থান কি হবে তা নিয়েও তৃণমূলে নানা প্রশ্ন ঘুরছে। কারণ ইতোপূর্বে এখানে জোটগতভাবে জামায়াত বিজয়ী হয়েছে। তবে এবার জামায়াতের নিজের ব্যানারে ভোট করার সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় জামায়াত বিএনপির ঘাড়ে ভর করে মনোনয়ন চাইতে পারে। সাধারণ ভোটারদের ধারণা সর্বশেষ জোটগত নির্বাচনে এ আসনে প্রার্থী ছিলেন জামায়াতের মাওলানা আজিজুর রহমান। ফলে জোটের প্রার্থী হিসেবে আজিজুর রহমানকে ভাবছেন তৃণমূলের অনেকে। এছাড়াও জাতীয় পার্টির প্রার্থী শার্শা উপজেলা কমিটির সভাপতি আক্তারুজ্জামান আক্তারও নির্বাচনী মাঠে সরব রয়েছেন।

মিলন রহমান/এমএএস/এমএস