মালয়েশিয়ার এমপি ড. ডাটো নোরানি আহমেদ সিপিএ সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছেন। তিনি কমনওয়েলথ উইমেন পার্লামেন্টারিয়ানের চেয়ারপারসন হিসেবে নারীদের নেতৃত্ব ও ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করছেন। নারী ক্ষমতায়নের বাধা, অন্যান্য মুসলিম দেশের মতো মালয়েশিয়ায় নারীর ক্ষমতায়ন, বাংলাদেশে নারীদের স্বাধীনতা ও বিশ্ব পরিমণ্ডলে নারীদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করতে কমনওয়েলথর্ভুক্ত দেশগুলোর এমপিদের সংগঠন সিপিএর ভূমিকাসহ নানা বিষয় নিয়ে তিনি সোমবার জাগো নিউজের মুখোমুখি হন। তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সিরাজুজ্জামান।
Advertisement
জাগো নিউজ : আপনি তো দীর্ঘদিন ধরে নারীদের নিয়ে কাজ করছেন। আপাতদৃষ্টিতে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার উদারণ কিছুটা ভালো হলেও যথেষ্ঠ নয়। এর কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?
ডাটো নোরানি আহমেদ : প্রচলিত ধারণা ও মানসিকতা নারী অগ্রগতির অন্যতম বাধা। কমনওয়েথর্ভুক্ত সদস্য দেশগুলোর সংসদে সর্বনিম্ন ৩০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ অর্জন করার প্রত্যাশা এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কমনওয়েলথর্ভুক্ত ৫২টি দেশের ১৮০ সংসদ রয়েছে। কিন্তু এখনও অনেক সংসদ রয়েছে যেখানে একজনও নারী প্রতিনিধি নেই। বর্তমানে ১৪৪টি সংসদে ন্যূনতম ত্রিশ শতাংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
জাগো নিউজ : বাংলাদেশের নারী নেতৃত্ব নিয়ে আপনার মতামত কী?
Advertisement
ডাটো নোরানী আহমেদ : এদেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, স্পিকার একজন নারী, বিরোধীদলীয় নেতাও একজন নারী। এর অর্থ হলো নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সঠিক পথেই রয়েছে। এমনকি সিপিএর চেয়ারপারসনও বাংলাদেশি একজন নারী। তাই আমি মনে করি বাংলাদেশ নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ।
জাগো নিউজ : বাংলাদেশের মতো মালয়েশিয়াও একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। যদিও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া অনেক দূর এগিয়ে গেছে। কিন্তু অনেকেরই জানার আগ্রহ রয়েছে নারীরা সেখানে কীভাবে কাজ করছে। সেখানে নারীর ক্ষমতায়নের উদ্যোগটাই বা কী?
ডাটো নোরানি আহমেদ : আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত যেসব সরকারি সিদ্ধান্ত হয়েছে তা খুবই ভালো। এমনকি সর্বশেষ বাজেটেও প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন যে ২০১৮ সাল হবে নারী ক্ষমতায়নের বছর। এমনকি নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যেসব কর্মজীবী নারী আছেন তাদের বিশেষ ইনসেনটিভ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যদি কোনো কর্মজীবী নারী গর্ভবতী থাকেন তাহলে তাদের কাজের সময় কমানো ছাড়াও বিশেষভাবে ইনসেনটিভ দেয়া হচ্ছে। নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য মালয়েশিয়া ১২০ মিলিয়ন মালেশীয় কারেন্সি বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু নারীদের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এখনও ৩০ শতাংশ পূরণ করতে পারিনি আমরা। মালয়েশিয়ায় মাত্র ১১ ভাগ নারী সরকারি ও বিরোধীদলীয় এমপি হিসেবে রয়েছেন।
জাগো নিউজ : আপনি কমনওয়েলথ উইমেন পার্লামেন্টারিয়ানের চেয়ারপারসন। এ সংগঠনের উদ্দেশ্য হলো এখন কমপক্ষে ৩০ শতাংশ নারী সংসদে আনা। কিন্তু আপনার দেশের অবস্থাই তো করুণ। এ দশা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আপনি কী করছেন?
Advertisement
ডাটো নোরানি আহমেদ : আমাদের দেশে খুব শিগগিরই নির্বাচন হবে। এখন এ নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা সরকার ও বিরোধী দলের এমপিদের সঙ্গে আলোচনা করছি কীভাবে নারীদের সংখ্যা আরও বাড়ানো যায়। আমরা এ নির্বাচনে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ নারী আনার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।
জাগো নিউজ : বিশ্বে অনেক ধর্মীয় দল আছে। যারা নারীদের ক্ষমতায়নের বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশের কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনে গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কমিটিতে নারীদের জন্য সংরক্ষিত ৩০ শতাংশ পদ রাখার বিপক্ষে মত দিয়েছে। এসব বিরোধীতা মোকাবেলা করে নারী ক্ষমতায়ন সম্ভব? কারণ পৃথিবীর অনেক দেশ ও রাজনৈতিক দল আছে যারা রক্ষণশীল।
ডাটো নোরানি আহমেদ : এখন বিষয়টি উল্লেখ্যযোগ্যভাবে পরিবর্তন হচ্ছে। কারণ আমরা অনেক সংরক্ষণশীল দেশই দেখছি নারীরা এমপি হচ্ছেন। ক্ষমতায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তারাও। তবে আমি বিশ্বাস করি বিষয়টি আমরা খুব ভালোভাবেই সামাল দিতে পারছি। তবে রক্ষণশীলদের মনে রাখতে হবে নারীদের ক্ষমতায়ন ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। তবে শিক্ষা এ বিষয়ে আমূল পরিবর্তন আনতে পারে। এ শিক্ষা শুধু নারী শিক্ষা নয়, পাশাপাশি পুরুষ শিক্ষাও। কারণ একজন শিক্ষিত পুরুষ নারীদের সমস্যা যেভাবে বুঝতে পারবে একজন অশিক্ষিত পুরুষ সেভাবে বুঝতে পারবে না।
জাগো নিউজ : নারীদের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে শুধু কি নারীরাই সংগ্রাম করবে? ডাটো নোরানি আহমেদ : না তা কখনোই নয়। আমরা চাই পুরুষরাও এ বিষয়ে কথা বলুক। এ বিষয়ে এগিয়ে আসুক। এমনকি এ বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজও করছি। আর সিপিএ একটি সেশনে প্রথমবারের মতো কথা বলার জন্য পুরুষ সভাপতি ও মডারেট রেখেছিলাম। যেখানে তারা নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কথা বলেছেন।
জাগো নিউজ : নারী ক্ষমতায়নে প্রতিবন্ধকতার প্রধান কারণগুলো কী কী বলে আপনি মনে করেন?
ডাটো নোরানি আহমেদ : প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো প্রথাগত ধারণা। এছাড়া শিক্ষার অভাব। সর্বত্র নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছি, যার মধ্যে শিক্ষাকার্যক্রম একটি। এর মধ্যে দিয়ে বিশেষ করে নারীদের শিক্ষিত করে তাদের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য তৈরি করছি। সংসদে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীদের অংশগ্রহণ এখন একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সব ধরনের বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে নারীর কাঙ্ক্ষিত অংশগ্রহণ সংসদে নিশ্চিত করতে চাই। একই সঙ্গে কমনওয়েলথে যে নারীর প্রতিনিধিত্ব রয়েছে সেটারও সংখ্যা সমতা বিধানের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। নারীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এবং আইন প্রণয়নের জন্য সংসদে আনতে চাই।
কারণ গোটা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। এ বিপুল জনগোষ্ঠীকে পেছনে রেখে একটি দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নারীর সংসদে অংশগ্রহণ কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে আমরা এখনও এটা নিয়ে খুশি কিছু নই। আমরা মনে করি এ সামান্য অংগ্রহণ যথেষ্ঠ নয়। আমাদের সর্বনিম্ন যে লক্ষ্যমাত্রা তা অর্জন করতে হবে। এতো কিছুর পরও তারা অনেক ভালোও করছে। মা, মেয়ে এবং স্ত্রী হিসেবে তারা যেমন কাজ করছে ঠিক তেমনি সংসদেও তারা নিজেদের অবস্থান করে নিয়েছেন। মানুষ চাইলে সবকিছু করতে পারেন, যেমন আমরা নারীও করছি। আমি বলছি না, পুরুষরা তাদের কাজ ঠিকমতো করছে না। যদি আমাদের সুযোগ দেয়া হয় তাহলে আমরাও এগিয়ে যাব।
জাগো নিউজ : সিপিএর স্টিয়ারিং কমিটি ও ওয়ার্কশপে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে অনেকগুলো প্রস্তাব দিয়েছেন আপনারা। সেগুলো কী? ডাটো নোরানি আহমেদ : নারীরা জম্মগতভাবেই বঞ্চিত হয়। অথচ বিশ্বের অর্ধেকের বেশি নারী। কিন্তু তারা বিভিন্নভাবে বঞ্চিত। এদের উন্নয়ন ছাড়া বিশ্বেও উন্নয়ন অবাস্তব। যদি সমান মর্যাদা ও কর্মক্ষেত্রে নারীদের উপযুক্ত সুযোগ সৃষ্টি হয় তাহলে জিডিপি এক শতাংশ বেড়ে যাবে। নারীর শক্তি সাহস ও যোগ্যতাকে কাজে লাগানোর সুপারিশ করা হয়েছে। নারীদের রাজনীতি ও সংসদে আসার জন্য অনুপ্রেরণা সৃষ্টি ও পরিবেশ নিশ্চিত করা, সংসদসহ দেশের বিভিন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীদের জন্য অধিক অর্থ বরাদ্দ ও নারীবান্ধব বাজেট প্রণয়ন, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে নারীদের আরও বেশি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার সুপারিশ এসেছে। এছাড়া জেন্ডারবিষয়ক প্রতিবেদন প্রস্তুত করে সংসদে উত্থাপনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
জাগো নিউজ : সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ডাটো নোরানি আহমেদ : আপনাকেও ধন্যবাদ।
প্রসঙ্গত, ১ নভেম্বর থেকে ঢাকায় শুরু হয়েছে সিপিএ’র ৬৩তম সম্মেলন। এ সম্মেলনে কমনওয়েলথভুক্ত ৫২ দেশ ও ১৮০ টি সিপিএ ব্রাঞ্চের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, সংসদ সদস্য ও অন্যান্য প্রতিনিধিসহ প্রায় ছয়শত প্রতিনিধি অংশ নিচ্ছেন। এ সম্মেলন চলবে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত। এ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন ডাটো নোরানি আহমেদ। এইচএস/জেডএ/আরআইপি