আবুল মোমেন:নিখোঁজ ব্যক্তির হদিস পাওয়া একটি আনন্দ সংবাদ। তাঁর বাষট্টি দিনের নিখোঁজ-জীবনের বৃত্তান্ত আমরা এখনও জানি না। তিনি কবে নাগাদ দেশে ফিরতে পারবেন তাও আমাদের জানা নেই। বিষয়টি নিয়ে তিনি নিজে এবং তাঁর পরিবারও হয়ত এখনও অন্ধকারেই আছেন।বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদের নিখোঁজ হওয়া এবং দীর্ঘ ৬২ দিন পরে প্রতিবেশী দেশের পাহাড়ী এক রাজ্যে তাঁর আবির্ভাব রহস্যের জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে সুখবর হল তিনি বেঁচে আছেন, সুস্থ আছেন। সে কারণেই একে নাটকীয় ঘটনাও বলা যায়।এখন মানুষ জানতে চাইবে এ নাটকের রচয়িতা কারা, অন্য কুশীলবদের কী পরিচয়। জানতে চাইবে নাটকের নির্দেশকের নাম। সালাহউদ্দিন আহমদের অন্তর্ধান তাঁর ও তাঁর পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে যাকে অপহরণ বলা যায় তাঁর নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনাটি কেবল এ বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্যেই জানা প্রয়োজন তা নয়, এ থেকে হয়ত ইলিয়াস আলীসহ আরও নিখোঁজ, গুম বা অপহরণের ঘটনা সম্পর্কে আমাদের জিজ্ঞাসার উত্তর পেতেও সাহায্য হতে পারে। বাংলাদেশে অতীতের রাজনৈতিক হানাহানির নানা ধরন আমরা দেখেছি, কিন্তু জ্বলজ্যান্ত মানুষ হাওয়া হয়ে যাওয়ার মত ঘটনা আমরা আগে দেখিনি। সমস্যা-সংকুল রাজনীতি কেবলই নানা দূষণে আক্রান্ত হচ্ছে। তার সাথে অপহরণ-গুমের মত উপাদান সর্বশেষ সংযোজন। আমরা জানি না সালাহউদ্দিন আহমেদের স্বদেশে ফিরতে কতদিন লাগবে। একজন ভারতীয় সাংবাদিক মনে করছেন যদি দু’দেশের সরকার-পর্যায়ে সমঝোতার মাধ্যমে কোনো সিদ্ধান্ত হয় তাহলে তাঁর দেশে ফিরতে দেরি হওয়ার কথা নয়। তা না হলে অবৈধ অনুপ্রবেশের জন্যে যে আইনি প্রক্রিয়া আছে তা তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে এবং সেক্ষেত্রে কিছু সময় লাগবেই। ঐ সাংবাদিকের মতে ভারতবর্ষে আইনি প্রক্রিয়া শেষ হওয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আবার এও হতে পারে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের উপজাত সমস্যা বিবেচনা করে এর বোঝা নিজেরা টানতে না-ও চাইতে পারে ভারত সরকার। সেক্ষেত্রে তাঁর দ্রæত বাড়ি ফেরা সম্ভব হতে পারে।স্বদেশে ফেরার পর জনাব সালাহউদ্দিন আহমদের জন্যে কী ধরনের বাস্তবতা অপেক্ষা করছে তাও ভাববার বিষয়। সমগোত্রীয় অন্যান্য বিএনপি নেতার মত তাঁর বিরুদ্ধেও নিশ্চিতভাবেই বেশ কিছু ফৌজদারি মামলা রয়েছে। ফলে আসার পরপর মামলায় হাজিরা দেওয়ার প্রশ্ন উঠবে, জামিন প্রাপ্তির বিষয় রয়েছে। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনির করিৎকর্মা ব্যক্তিদের তৎপরতায় তাঁকে বাংলাদেশের প্রবেশ-পথেই গ্রেপ্তার বরণ করতে হতে পারে। তারপর আদালত, জামিন কিংবা কারাবরণ। ফলে স্বদেশেও তাঁর জন্যে বিশেষ আনন্দদায়ক সংবাদ অপেক্ষা করে নেই।আমরা যদি রাজনীতির ডামাডোল বাদ দিয়ে ব্যক্তি মানুষটির বিষয় ভাবি, ভাবতে পারি তাঁর পরিবার ও স্বজনদের কথা, তাহলে বলতেই হবে সালাহউদ্দিন আহমদকে ফিরে পেয়ে যে আনন্দ তারা পেয়েছেন তাকে অনুসরণ করেই এসেছে তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ।বাংলাদেশের বাস্তবতায় ও বিবেচনায় তাঁর দল বিএনপির রাজনীতিতে ভ্রান্তি আছে। আবার দলটি ব্যক্তি নির্ভর, বড়জোর মাতাপুত্রের সিদ্ধান্তের ওপরই সর্বতোভাবে নির্ভরশীল। তাঁরা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে কতটা সঠিক রাজনীতির পথ দেখাতে পারবেন তা আমরা জানি না। কিন্তু বিএনপির ভিতর থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দলের সাথে সখ্য এবং এ দলের যুদ্ধাপরাধী নেতাকর্মীদের প্রতি পক্ষপাত সম্পর্কে নতুন ভাবনা ও আলোচনা আসা দরকার। আমাদের ধারণা বিএনপি যদি এ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান পরিস্কার করে দলকে ঠিক জায়গায় নিয়ে আসতে পারে তবে সরকারের দমনমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনমত আরও স্পষ্ট ও শক্তিশালী হবে। কিন্তু নিজেদের অবস্থান অস্পষ্ট রেখে দেশের ইতিহাসের একটি মৌলিক মানবিক বিষয়ে দলীয় অবস্থানকে বিতর্কিত করে রাখলে তার খেসারত বিএনপিকে দিয়ে যেতে হবে।আমরা বলি না খেসারত একা বিএনপি দেবে। এ খেসারত কার্যত দেশ ও জনগণকেও দিতে হবে। কারণ একতরফা শাসন চলতে থাকলে দেশে কোনোদিন সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। যে কোনো ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসন শেষ পর্যন্ত দেশ ও জনগণের কল্যাণ বয়ে আনে না। এতে সামাজিক শান্তি ও স্থিতি নষ্ট হয়। আশা করি সরকার, বিএনপিসহ সংশ্লিষ্ট সকলে বিষয়টি অনুধাবন করবেন এবং সেভাবে ভবিষ্যতের পথ রচনা করবেন।লেখক : কবি, চিন্তাবিদএইচআর/আরআই
Advertisement