জীবিকার সন্ধানে বিদেশ যাওয়া। দেশের মানুষের প্ররোচণায় বিদেশের মাটিতে জিম্মিদশা। এরপর পর্যায়ক্রমে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। নিজেদের জিম্মিদশা ও নির্যাতনের কথা বলার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা। তাদের কথা আর কান্নায় উপস্থিত অনেকেরই চোখ বেয়ে অশ্রু নামে। শনিবার দুপুরে রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে আয়োজিত ‘নিরাপদ অভিবাসন এবং মানবপাচার প্রতিরোধ’ শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা) ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। সেখানে পাচারের শিকার ও জিম্মিদশার বর্ণনা দেন ফরিদপুরের মুহিত মোল্লা ও সিরিয়া ফেরত পটুয়াখালীর এক নারী।চাকরির কথা বলে বিদেশে পাচার ও র্যাবের সহায়তায় জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হওয়া এমন ১০ জনের কথা হয় সেমিনারে। জিম্মিদশা থেকে ইতোমধ্যে দেশে ফিরেছে সাতজন। বাকি তিনজন মুক্ত হয়ে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন।অনুষ্ঠানের শুরুতেই দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠানোর নামে দালালদের প্রতারণার কথা তুলে ধরেন ফরিদপুরের মুহিব উল্লাহ। তিনি বলেন, মাদারীপুর শিবচর এলাকার বেলায়েত নামের একজনের কথায় গত বছরের ১০ মার্চ আফ্রিকা যাওয়া। সেখানে বেলায়েতের দোকানে চাকরি দেবেন বলেই আফ্রিকায় নিয়ে যায়। কিন্তু চাকরি না দিয়ে সেখানে পাকিস্তানিদের মাধ্যমে জিম্মি হই।‘১০ লাখ টাকা পাঠাতে বল নইলে মরতে হবে।’ এরপর বাড়িতে ফোন করে টাকা চাই। কিন্তু দরিদ্র পরিবার টাকা দিতে না পারায় চলে নির্যাতন। কখনো বৈদ্যুতিক শক দেয়া হতো, কখনো গরম পানি। পানি ছাড়া কিছুই খেতে দেয়া হতো না। বাড়ির লোকজন টাকা দিতে না পারলেও র্যাব-৩ এর শরণাপন্ন হয়। পরে র্যাব ও চয়ন নামে এক বাংলাদেশির সহযোগিতায় গত ২ এপ্রিল দেশে ফিরি। এরপর সিরিয়াফেরত পটুয়াখালীর মেয়ে এসে নিজের দুর্ভোগের কথা বলতে শুরু করেন। তিনি বলেন, আমাকে তিন মাস আটকে রাখা হয়। চাইলেও সব সময় খেতে দেয়া হতো না। একটা পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়া হয়। সেখানে শরীরে বৈদ্যুতিক শক দিয়েও নির্যাতন করা হতো। কোনো একদিন সুযোগ পেয়ে বাড়ি ফোন করে মায়ের কাছে সব খুলে বলি। মা র্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর আমাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।তার বক্তব্যের মধ্যেই অনেকে কেঁদে ওঠেন। অনেকে চোখ বেয়ে নেমে আসে অশ্রু। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সেটাই বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও।তিনি বলেন, মানবপাচারকারীরা দেশের শত্রু। আমার বোন বিদেশে গিয়ে নির্যাতিত হবেন, তা কোনোভাবেই মানা যায় না। এ ধরনের খবর আমাদের কষ্ট দেয়। আমরা এমন নির্যাতনের আর কোনো ঘটনা শুনতে চাই না। এসব বন্ধে কাজ করতে হবে। সবাইকে সচেতন হতে হবে। পরে পটুয়াখালীর মেয়েটি জাগো নিউজকে বলেন, দেশে ভিক্ষা করে খেলেও কষ্ট হতো না। অভাবের সংসারে সচ্ছলতার জন্য সিরিয়া যাওয়া। বুঝতে পারিনি ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। আর কারো ভাগ্যে যেন এমন দুর্বিষহ ঘটনার পুরাবৃত্তি না ঘটে।অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বলেন, যারা বিদেশে যাবেন, তাদের দক্ষ হয়ে যেতে হবে। সরকার এজন্য নতুন করে আরও ৪০টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলেছে। আর প্রবাসীদের কল্যাণেও সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে।প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব বেগম শামছুন নাহার বলেন, বৈধভাবে যারা বিদেশ যাবেন, যাচ্ছেন ও গেছেন মন্ত্রণালয় শুধু তাদের নিয়েই কাজ করে। তবে যেহেতু অবৈধভাবে অনেকেই বিদেশে গেছেন তাই তাদের ফিরিয়ে আনাটা কর্তব্যের মধ্যে পড়ছে।তিনি আরও বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর জন্য নারী পাচ্ছিলাম না। অথচ অনেকেই গেছেন অবৈধভাবে। যারাই অবৈধভাবে গেছেন তারাই বিপদে পড়েছেন। সরকার যাদের বৈধভাবে পাঠিয়েছে তাদের বিপদ কমই হয়েছে। বায়রার সভাপতি বেনজির আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক সেলিম রেজা, বায়রার সাবেক সভাপতি নূর আলী ও বর্তমান মহাসচিব রুহুল আমিন। র্যাব ৩-এর কমান্ডিং কর্মকর্তা তুহিন মোহাম্মদ মাছুম। জেইউ/এএইচ/জেআইএম
Advertisement