দেশজুড়ে

জলের জন্য জীবনের লড়াই

জলের জন্য জীবনের লড়াই

• আয়ের নির্দিষ্ট অংশ ব্যয় হচ্ছে পানি কিনতে• পৌরসভার পানি দুর্গন্ধযুক্ত, ব্যবহারে নষ্ট হয় রান্নায় স্বাদ• টিউবওয়েলের পানিতেও আয়রন ও আর্সেনিক• বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে শিশু ও বৃদ্ধরা• পৌরসভার সীমাবদ্ধতা • স্বল্প খরচের সমাধান হতে পারে রেইনওয়াটার হারভেস্টিং

Advertisement

সাতক্ষীরা শহরের মুনজিতপুর এলাকার গৃহবধূ রহিমা খাতুন সকালে পৌরসভার পানির কল খুলে বিশুদ্ধ পানির বদলে পান দুর্গন্ধযুক্ত পানি। সেই পানি দিয়ে রান্না করা যায় না, গোসল করলেও চুল আর ত্বক নষ্ট হয়। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে প্রতিদিন টাকা দিয়ে জারের পানি কিনে পান করেন তারা।

রহিমার মতো এই শহরের অসংখ্য মানুষ এখন সুপেয় পানির জন্য টাকা গুনছেন। শহরের অনেক পরিবারই এখন বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি হওয়া জারের পানি বা দোকানের বোতলজাত পানির ওপর নির্ভরশীল। অথচ পানি তাদের মৌলিক অধিকার।

‘পৌরসভার পানি তো আসেই না ঠিকমতো। আর যেটুকু আসে সেটা খাওয়া তো দূরের কথা, মুখে দিতেই ভয় লাগে। পানি কিনে খেতে হচ্ছে, যা গরিব মানুষের জন্য কষ্টকর।’

Advertisement

তবে এই সংকটের মধ্যেও কেউ কেউ খুঁজে নিচ্ছেন বাঁচার নতুন উপায়। অনেকেই ঘরের ছাদে জমানো বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে তা ফুটিয়ে বা ছেঁকে রান্না, গোসল এমনকি পান করার ব্যবস্থাও করেছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শহরে ব্যক্তিগত বা পাড়াভিত্তিক ‘রেইনওয়াটার হারভেস্টিং’ বা বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখাই হতে পারে সুপেয় পানির একটি টেকসই সমাধান। এজন্য দরকার শুধু একটু সচেতনতা, আগ্রহ আর ছোট পরিসরের একটি ব্যবস্থা।

পানি এখন বাজারের পণ্য

সাতক্ষীরা শহরের সুলতানপুর, কামালনগর, কাটিয়া, মুন্সিপাড়া, রসুলপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায় প্রতিটি বাসায় দিনে একাধিক জার পানি কিনে খেতে হয়। একেকটি পানির জার বিক্রি হয় ২০ থেকে ৩০ টাকায়। পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারে মাসে খরচ পড়ে প্রায় ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা!

‘অনেকেই আর্সেনিকের এই বিষাক্ততার লক্ষণগুলোকে সাধারণ রোগ মনে করে গুরুত্ব দেন না। অথচ এটি একটি জনস্বাস্থ্য সংকট। সুপেয় পানি নিশ্চিত না করা গেলে ভবিষ্যতে সাতক্ষীরায় পানিবাহিত দীর্ঘমেয়াদি রোগের হার আরও বেড়ে যেতে পারে। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।’

Advertisement

শহরের কামালনগরের বাসিন্দা আমিরুজ্জামান বাবু বলেন, পৌরসভার পানি তো আসেই না ঠিকমতো। আর যেটুকু আসে সেটা খাওয়া তো দূরের কথা, মুখে দিতেই ভয় লাগে। পানি কিনে খেতে হচ্ছে, যা গরিব মানুষের জন্য কষ্টকর।

পৌরসভার পানিতে গন্ধ আর ঝুঁকি

সাতক্ষীরা পৌরসভার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা বছরের পর বছর ধরে অব্যবস্থাপনার শিকার। পুরোনো ও জীর্ণ পাইপলাইনের কারণে অনেক এলাকায় পানি পৌঁছায়ই না, আর যেখানে পৌঁছায়, সেখানেও পানির রং ঘোলা, দুর্গন্ধযুক্ত ও লবণাক্ত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পানিতে আয়রনের মাত্রা এত বেশি থাকে যে তা রান্নার স্বাদ নষ্ট করে দেয়। পৌরসভার পানি পরিশোধন ব্যবস্থাও প্রায় অনুন্নত। নেই আধুনিক যন্ত্রপাতি, আয়রন বা লবণ দূর করার ব্যবস্থা। পানি সরবরাহও সীমিত। কোথাও দিনে একঘণ্টা, কোথাও একেবারেই আসে না। বিদ্যুৎ না থাকলে বা পাম্পে সমস্যা হলে দিন পেরোলেও পানি আসে না। ফলে বহু পরিবার বাধ্য হয়ে জার কিনে পানি খায়। এ অবস্থায় নাগরিকদের স্বাস্থ্য, আর্থিক সক্ষমতা ও দৈনন্দিন জীবন গভীর সংকটে পড়েছে।

‘সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ছে, যা ভূগর্ভস্থ পানির উৎসেও প্রভাব ফেলছে। অপরিকল্পিত পানি উত্তোলন ও অনিয়মিত বর্ষণের ফলে পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে। এতে সাধারণ নলকূপ বা পৌরসভার পুরোনো সরবরাহ ব্যবস্থা দিয়ে বিশুদ্ধ পানি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।’

পৌরসভার সুলতানপুর এলাকার বাসিন্দা ওমর আলী বলেন, আমাদের এলাকায় সকালে পানির কল খুললে গড়গড় শব্দ হয়, পানি আসে না। আবার কখনো কখনো অল্প পানি এলেও সেটা ঘোলা থাকে। মাঝে মাঝে পানিতে একটা দুর্গন্ধ বের হয়।

তিনি বলেন, গ্লাসে এক ঘণ্টা পানি রাখলে নিচে সাদা পাউডারের মতো কিছু জমে থাকে। এই পানি খেয়ে কি বেঁচে থাকা যায়?”

‘সুপেয় পানির সংকটে স্বল্প খরচে সমাধান হতে পারে ছাদ থেকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ (রেইনওয়াটার হারভেস্টিং) ও ঘরোয়া পানিশোধন পদ্ধতি। বাড়ির ছাদে পড়া বৃষ্টির পানি প্রথম ১০-১৫ মিনিট ফেলে দিয়ে পরের অংশ একটি পাইপের মাধ্যমে ঢাকনাযুক্ত ড্রামে বা ট্যাংকে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। সংরক্ষণের আগে কাপড় বা মশারির মতো ছাঁকনির মাধ্যমে পানি ছেঁকে নিতে হবে।’

টিউবওয়েলের পানিতেও নেই স্বস্তি

কেউ কেউ এখনো টিউবওয়েলের ওপর নির্ভর করেন। কিন্তু শহরের অনেক টিউবওয়েলের পানিতে পাওয়া যাচ্ছে আয়রন ও আর্সেনিক, যা দীর্ঘমেয়াদে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সাতক্ষীরা শহরের বিভিন্ন এলাকায় গভীর নলকূপ বসানো হলেও সেগুলোও পানির সংকটের সমাধান দিতে পারেনি। অনেক জায়গায় গভীর নলকূপের পানি খেতে লবণাক্ত লাগে, কখনো বালিমিশ্রিত থাকে, যা স্বাদ ও গুণমানে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে এই সমস্যা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। ফলে বিশুদ্ধ পানির আশায় নলকূপ বসালেও সেগুলোও এখন ভরসার জায়গা হতে পারছে না, বরং মানুষ আরও বেশি হতাশ ও নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে বাজারের জারজাত পানির ওপর।

জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সাতক্ষীরা শহরের কিছু এলাকার টিউবওয়েলের পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি রয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। দীর্ঘমেয়াদে এই পানি পান করলে মানুষের শরীরে নানা ধরনের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়।

সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আসাদুজ্জামান বলেন, আর্সেনিকযুক্ত পানি শরীরের জন্য নীরব বিষের মতো কাজ করে। সাতক্ষীরার কিছু এলাকায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, দীর্ঘদিন আর্সেনিক মিশ্রিত পানি পান করার কারণে অনেক রোগী চর্মরোগ, জ্বরজ্বর ভাব, পাকস্থলীর সমস্যা, ওজন হ্রাস, এমনকি স্নায়ু দুর্বলতা নিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আর্সেনিক শরীরে জমে থেকে ধীরে ধীরে কিডনি, লিভার এবং স্নায়ুতন্ত্রে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হচ্ছে, এটি ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়ায়। বিশেষ করে শিশু, গর্ভবতী নারী এবং বয়স্কদের ক্ষেত্রে প্রভাব আরও মারাত্মক হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, অনেকেই আর্সেনিকের এই বিষাক্ততার লক্ষণগুলোকে সাধারণ রোগ মনে করে গুরুত্ব দেন না। অথচ এটি একটি জনস্বাস্থ্য সংকট। সুপেয় পানি নিশ্চিত না করা গেলে ভবিষ্যতে সাতক্ষীরায় পানিবাহিত দীর্ঘমেয়াদি রোগের হার আরও বেড়ে যেতে পারে। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

নারীদের কাঁধেই পানির বোঝা

সাতক্ষীরা শহরের পানি সংকটের সবচেয়ে বড় বোঝাটা যেন পড়েছে নারীদের কাঁধে। ঘরে পানি না থাকলে রান্না, কাপড় ধোয়া, বাসন মাজা, বাচ্চাদের দেখভাল সব কাজের মধ্যেই নতুন করে যুক্ত হয় পানি সংগ্রহের অতিরিক্ত শ্রম। একদিকে গৃহস্থালি কাজের চাপ, অন্যদিকে প্রতিদিন পানির জন্য লাইন ধরা বা হাঁটাপথে পানি বয়ে আনা এটি তাদের দৈনন্দিন জীবনে বাড়তি ক্লান্তি ও সময় নষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মুন্সিপাড়া এলাকার গৃহবধূ হামিদা বেগম বলেন, সাপ্লাই কল থেকে ঠিকমতো পানি আসে না। ভোরবেলা উঠেই কলের সামনে লাইনে দাঁড়াতে হয়, দুই-তিন বালতি পানি তুলতে কখনও আধা ঘণ্টা, কখনও তারও বেশি সময় লাগে। অনেকে আগে এসে দাঁড়িয়ে থাকে, তাই কখনও পানি না পেয়ে খালি হাতে ফিরতে হয়। তখন বাধ্য হয়ে হেঁটে দূরের একটা টিউবওয়েল থেকে পানি আনতে হয়। ওই পানি আবার খাওয়ার মতো হয় না, শুধু কাপড় ধোয়ার কাজে লাগে।

এই বাড়তি কষ্ট শুধু শারীরিকই নয়, মানসিক চাপও তৈরি করছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর নারীরা যারা বাইরের কাজও করেন, তাদের জন্য প্রতিদিন পানি সংগ্রহ এক কঠিন যুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

হুমকিতে শিশু ও বৃদ্ধদের স্বাস্থ্য

পানির এই দুরাবস্থায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা। দূষিত পানি খেয়ে ডায়রিয়া, টাইফয়েড, চর্মরোগ ও পেটের সমস্যা বেড়েই চলেছে। সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, গত কয়েক বছরে পানিজনিত রোগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা আগের চেয়ে কয়েক গুণ বেড়েছে। এদের অধিকাংশ বৃদ্ধ ও শিশু, যারা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এছাড়া আর্সেনিকজনিত কারণে চর্ম রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে।

আরও পড়ুন ২৩ কোটি টাকা খরচে প্রকল্প, তবুও মিলছে না সুপেয় পানি  সুপেয় পানির তীব্র সংকট, অকেজো হাজারও নলকূপ  সুপেয় পানির সংকটে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাতক্ষীরা শহরের সুপেয় পানির সংকট আরও গভীর হয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিবছর নিচে নেমে যাচ্ছে, যা অনিয়মিত বর্ষণ, দীর্ঘ শুষ্ক মৌসুম এবং অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে ঘটছে। পাশাপাশি উপকূলবর্তী জেলা হওয়ায় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে মিঠা পানির উৎসগুলো দূষিত হচ্ছে। অনেক গভীর নলকূপের পানিও লবণাক্ত বা আয়রনযুক্ত হয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টির পরিমাণ ও ধরনে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, যার ফলে রেইনওয়াটার হারভেস্টিংও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সব মিলিয়ে এই সংকট শুধু অবকাঠামোগত নয়, এটি একটি জলবায়ু জনিত জনস্বাস্থ্য সংকট, যা নারী ও শিশুদের ওপর আরও বেশি চাপ তৈরি করছে।

সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আ.ন.ম গাউছার রেজা বলেন, সাতক্ষীরা শহরের সুপেয় পানির সংকট এখন আর শুধু অবকাঠামো বা পৌর পরিষেবার সীমাবদ্ধতার কারণে নয়, এটি স্পষ্টতই জলবায়ু পরিবর্তনের একটি বাস্তব প্রতিক্রিয়া। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ছে, যা ভূগর্ভস্থ পানির উৎসেও প্রভাব ফেলছে। অপরিকল্পিত পানি উত্তোলন ও অনিয়মিত বর্ষণের ফলে পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে। এতে সাধারণ নলকূপ বা পৌরসভার পুরোনো সরবরাহ ব্যবস্থা দিয়ে বিশুদ্ধ পানি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। সাতক্ষীরার মতো জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ শহরগুলোতে পানি ব্যবস্থাপনায় এখনই জলবায়ু সহনশীল ও বিকল্প পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।

সমস্যা সমাধানে করণীয় কী?

নাগরিক নেতৃবৃন্দ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জীবন বাঁচাতে নিরাপদ পানি চাই, পানি আমাদের জীবনের মৌলিক চাহিদা। অথচ সাতক্ষীরা শহরের হাজার হাজার মানুষ সেই মৌলিক চাহিদা থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছেন। নিরাপদ পানি না থাকলে, সুস্থ জীবন ও উন্নয়ন দুটোই প্রশ্নের মুখে পড়ে।

জেলা নাগরিক কমিটির নেতা আলী নূর খান বাবুল বলেন, পানি শুধু জীবনধারণের উপকরণ নয়, এটি নাগরিক অধিকার। কিন্তু সাতক্ষীরার মানুষকে প্রতিদিন সেই অধিকার ছিনিয়ে আনতে হয় কষ্ট, টাকা আর অপেক্ষার বিনিময়ে। পৌরসভার পানি সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতা, পর্যাপ্ত পরিশোধনের অভাব ও ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা আজ নাগরিক দুর্ভোগের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সংকট সমাধানে স্থানীয় সরকারকে দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক হতে হবে।

সাতক্ষীরা পৌর এলাকায় পানি সংকট বিষয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা বারসিক সাতক্ষীরা অফিসের প্রোগ্রাম অফিসার গাজী মাহিদা মিজান মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, আমরা সাতক্ষীরা পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের ১৭টি নিম্নবিত্ত এলাকায় নিয়মিত কাজ করছি। প্রায় প্রতিটি কর্ম এলাকায় গিয়ে আমরা একই চিত্র দেখতে পাই, মানুষ বিশুদ্ধ পানির সংকটে আছে। প্রায় প্রতিটি পরিবারই খাবার পানি কিনে খায়। তারা যা আয় করে, তার একটা বড় অংশই পানি কিনতে খরচ হয়ে যাচ্ছে। এটি দীর্ঘমেয়াদে একটি আর্থ-সামাজিক চাপ তৈরি করছে।

আরও পড়ুন নদীবেষ্টিত রাজবাড়ীতে পানির অভাবে বাড়ছে সেচ খরচ  কারখানার পানি পান করে হাসপাতালে শতাধিক শ্রমিক 

তিনি বলেন, সাতক্ষীরা শহরের পানি সংকটের সম্ভাব্য সমাধানের পথ হিসেবে রেইনওয়াটার হারভেস্টিং বা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ধারণাটি বিশেষজ্ঞ ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর কাছে এখন গুরুত্ব পাচ্ছে। এটি বাস্তবায়ন করতে খুব বেশি খরচ বা প্রযুক্তির প্রয়োজন পড়ে না। শুধু একটি ঢালু ছাদ, পাইপের মাধ্যমে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা, একটি বালতি/ড্রাম/ট্যাংক এবং একটি সাধারণ ফিলটার সিস্টেম থাকলেই বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা সম্ভব। প্রাথমিকভাবে এই পানি রান্না, গোসল বা ধোয়া-মোছায় ব্যবহার করা গেলেও, ফিলটার ব্যবস্থায় উন্নয়ন এনে তা পানযোগ্য করাও সম্ভব।

পৌরসভার ব্যর্থতা স্বীকার

সাতক্ষীরা পৌরসভার পানি সরবরাহ বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মাসুদ রানা বলেন, শহরের পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় পৌরসভার অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পৌরসভার পানির পাম্প, মোটর ও লাইনগুলো অনেক পুরোনো। কোথাও কোথাও ৪০ বছর আগে স্থাপিত। তাছাড়া শহরের ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও আগের তুলনায় অনেক নিচে নেমে গেছে, যা আমাদের পানি উত্তোলনে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।

তিনি আরও বলেন, সাতক্ষীরায় আগে দুটি পানির প্ল্যান্ট ছিল। পানির চাহিদা বাড়ায় ২০১৭ সালে শহরের কুখরালি এলাকায় একটি আধুনিক ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বসানো হয়েছে। নতুন করে আরও একটি প্ল্যান্ট বসানোর চেষ্টা চলছে। তবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ এখনো পাইনি। বরাদ্দ পাওয়া গেলে দ্রুত কাজ শুরু করা হবে। এছাড়া পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে, এবং আরও কিছু এলাকাভিত্তিক গভীর নলকূপ বসানোর পরিকল্পনাও হাতে আছে। তবে প্রতিনিয়ত শহরের আয়তন বৃদ্ধির কারণে পানির চাহিদা বাড়ছে। ফলে পৌরসভার পক্ষে চাহিদা অনুযায়ী পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।

স্বল্প খরচে সুপেয় পানি কীভাবে পাবেন?

সাতক্ষীরা পৌরসভার সাবেক সহকারী প্রকৌশলী সেলিম সরোয়ার বলেন, সাতক্ষীরা শহরের পানি সংকট নিরসনে আধুনিক ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন, পৌরসভার পানি লাইনগুলো আধুনিকায়ন, টিউবওয়েলের পানি পরীক্ষার জন্য নিয়মিত উদ্যোগ, ছাদে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের সরকারি ও সামাজিক উদ্যোগ, কমিউনিটি ট্যাংক বা বিকল্প পানি সরবরাহ ব্যবস্থা চালু এবং স্কুল ও ওয়ার্ড পর্যায়ে পানি সচেতনতা কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।

স্বল্প খরচে সুপেয় পানির বিষয়ে তিনি বলেন, সুপেয় পানির সংকটে স্বল্প খরচে সমাধান হতে পারে ছাদ থেকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ (রেইনওয়াটার হারভেস্টিং) ও ঘরোয়া পরিশোধন পদ্ধতি। বাড়ির ছাদে পড়া বৃষ্টির পানি প্রথম ১০-১৫ মিনিট ফেলে দিয়ে পরের অংশ একটি পাইপের মাধ্যমে ঢাকনাযুক্ত ড্রামে বা ট্যাংকে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। সংরক্ষণের আগে কাপড় বা মশারির মতো ছাঁকনির মাধ্যমে পানি ছেঁকে নিতে হবে। পানি ফুটিয়ে ১০-১৫ মিনিট রেখে ঠান্ডা করে খাওয়া সবচেয়ে নিরাপদ উপায়। রোদের তাপে রেখে (সোলার ডিসইনফেকশন), অথবা প্রাকৃতিক উপায়ে সহজেই এই পানি শোধন করা যায়। কয়েক হাজার টাকায় একটি পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় রেইনওয়াটার হারভেস্টিং ইউনিট তৈরি করা সম্ভব, যা পুরো মৌসুম বিশুদ্ধ পানির জোগান দিতে পারে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও স্থানীয় কিছু এনজিও কারিগরি সহায়তা দিয়ে থাকে।

এফএ/জিকেএস