যেখানে হাসি-উল্লাসে বেড়ে ওঠার কথা, সেখানে শুধুই দারিদ্রের কশাঘাত। যে শিশুটির হাতে থাকার কথা ছিল বই, সেই শিশুটিই মাছ ধরার বড়শি নিয়ে দিনভর ঘুরে বেড়ায় নদী-খালের ধারে। স্কুলের হাজিরা খাতায় কোনো না কোনো শ্রেণিতে নাম থাকলেও যাওয়া হয় না ক্লাসে। যে চোখে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন থাকার কথা, সেই চোখ দুটো নির্ঘুম কাটে। আবার রাতে কোনোমতে ঘুমালেও, সকাল হতেই ছুটতে হয় বাবার কর্মের সঙ্গী হিসেবে।
Advertisement
দারিদ্রের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত, এমন জীবন কাটে উপকূলের হাজারো শিশুর। উপকূলীয় প্রান্তিক শিশুদের অন্তহীন দুর্দশার এই চিত্র দেখা গেছে উপকূলীয় জেলা বরগুনার একাধিক আশ্রয়ণ প্রকল্পগুলোতে। শিশু অধিকারের কথা জানে না পরিবারের কেউ, আর শিশু সুরক্ষা যেন অর্থহীন বার্তা এইসব পল্লিতে।
প্রতিটি শিশুর মতো তাদেরও বেড়ে ওঠার কথা ছিল সমান অধিকার নিয়ে, পাওয়ার কথা ছিল সমান সুযোগ সুবিধা, কিন্তু সেখানে শৈশব থেকেই সূচনা হয় বিবর্ণ জীবনের। সুষম খাদ্য, একটি শিশুর জন্য একাধিক বস্ত্র, ভালো শিক্ষা ব্যবস্থা যেন এখানে অমাবস্যার চাঁদ। এমন এক অনিশ্চয়তায় বিবর্ণ হয়ে উঠেছে এসব পল্লির হাজারো শিশুর শৈশব। এখনো প্রতিদিন বাবার কাজের ঘানি শিশু ছেলেটাকেও টানতে হয়। শিশুশ্রমের বেড়াজালে বন্দিজীবন আর বাবার কষ্টের কর্মের সঙ্গী হতে ষষ্ঠ শ্রেণির গণ্ডিতে যাওয়া হয় না অধিকাংশ শিশুর। ফলে কোমলমতি সব শিশুদের কাঁধে ওঠে সংসারের বোঝা। ভবিষ্যতে নতুন একজন দরিদ্র জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনাকে বুকে নিয়েই কর্মজীবন শুরু করে এই পল্লিগুলোর দরিদ্র শিশুগুলো।
বরগুনা পোটকাখালি আশ্রয়ণ প্রকল্পের শিশু আবির, বাবুল, মিলন, দিপু আর সাইফুল মারবেল খেলছিল বিকালের রোদে। সকাল থেকে পড়ন্ত বিকাল খেলতে আসার আগ পর্যন্ত তারা ব্যস্ত ছিল যে যার কাজে। তাদের পাঁচজনের মধ্যে আবির একাই স্কুল থেকে ফিরেছে, বাকি চারজন ছিলেন কাজে। বাবুল চায়ের দোকানে কাজ করে, মিলন মাছের আড়তে, আর দিপু কোনো কাজ না করেও স্কুলে যায় না। সাইফুল প্রতিদিন সকালে বাবা-চাচাদের সঙ্গে গড়ার জাল তুলতে যায়।
Advertisement
শিশু সাইফুল জানালো, ‘স্কুলে যাইতে ইচ্ছা করে, তয় কাজের লইগ্যা যাইতে পারি না। জোয়ার আওয়ার আগেই জাল পাতি, আর ভাটায় পানি টানলে মাছ লইয়া আইয়া আইতে আইতে স্কুলের ছুটি হইয়া যায়। মাছের আড়তে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত কাজ করে ফেরা মিলন (১০) নামের শিশুটি বলে, আমার পরিবারের ভাইবোনদের মধ্যে আমি বড়, আমার ছোট আরও দুইটা ভাইবোন আছে। আমরাতো গরীব, পরিবারের সবাই কি লেখাপড়া করতে পারে? আমি করি না তবে আমার ছোট ভাইটাকে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করে দিয়েছি এ বছর।’
শুধু ওরাই নয়, দারিদ্রের বেড়াজালে এভাবে হাজারো শিশুর শৈশব ও ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে উপকূলে। শিশু অধিকারের কথা কাগজে কলমে থাকলেও নেই বাস্তবে। তাই উপকূলের হাজারো শিশু বঞ্চিত হচ্ছে তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে।
শিশুদের সুরক্ষায় ১৯৭৪ সালের শিশু আইন সংশোধন করে ২০১৩ সালের ১৬ জুন সংসদে শিশু আইন ২০১৩ পাস হয়। শিশু আইন ছাড়াও শিশু অধিকার রক্ষায় সরকারের অসংখ্য আইন ও প্রকল্প রয়েছে। এগুলোর মধ্যে জাতীয় শিশু নীতিমালা ২০১১, জাতীয় শিক্ষা নীতিমালা ২০১০ এবং জাতীয় শিশুশ্রম নিরোধ নীতিমালা ২০১০ অন্যতম। আগের তুলনায় শিশুশ্রম কিছুটা কমলেও উপকূলের চরাঞ্চল ও প্রান্তিক দরিদ্র পল্লিগুলোতে এর মাত্রা এখনো অকল্পনীয়।
এই পল্লির বাসিন্দা সেলিম মিয়া (৫৫) বলেন, ‘সব পরিবারই এখন বোঝে যে তাদের পোলাপানগুলারে পড়ানো উচিত, কিন্তু প্যাডের (পেটের) তাগিদে সবাই তো পড়াইতে পারে না।’
Advertisement
স্থানীয় স্কুল শিক্ষক সুমন চন্দ্র গাইন বলেন, ‘আবাসনের অনেক শিশুরা কাজের কারণে বা পরিবারের আগ্রহ না থাকায় স্কুলে আসে না। আবার যারাও আসে তারাও প্রতিবেশী শিশুটি স্কুলে না আশার ফলে লেখাপড়া থেকে আগ্রহ হারাচ্ছে। প্রতিনিয়ত ঝরে পরছে স্কুল পড়ুয়া এখানকার শিশুরা।’
বিষয়টি নিয়ে কথা হলে শিশুবিষয়ক গবেষক ও বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. ইব্রাহিম খলিল বলেন, ‘উপকূল অঞ্চলে শিশুদের শিক্ষিত করার প্রবণতা কম পরিলক্ষিত হয়। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে এই অঞ্চলে দরিদ্র ও অভাবী মানুষের বিচরণ বেশি। শিশুদের শিক্ষিত করার প্রবণতা তখন বৃদ্ধি পাবে যখন সমাজ থেকে অভাবকে দূর করা যাবে। প্রতিটি শিশুর জীবনের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পরিবারকে সচেতন করতে পারলে কমে আসবে শিক্ষাবঞ্চিত শিশুর সংখ্যা।’
তিনি আরও বলেন, ‘একটি শিশুর জীবন হওয়া উচিত চিন্তামুক্ত। কিন্তু শিশুকেই যদি পরিবার-পেট-প্রয়োজন নিয়ে চিন্তা করতে হয়, তখন তার লেখাপড়ার ব্যাঘাত ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। শিশুটি চিন্তামুক্ত না থাকলে শুধু পড়ালেখার ক্ষতিই নয়, বরং তার মানসিক স্বাস্থ্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর ফলে ওই শিশুটি স্বাভাবিক জীবনাচরণ হারায়। তাই আগে প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগে এমন পরিবারগুলোকে বাছাই করে আর্থিক সাপোর্ট দেওয়া। জরুরি হয়ে উঠেছে, দেশের দরিদ্র পল্লিগুলো বাছাই করে করে মনস্তাত্ত্বিক কাউন্সেলিং করা। এমনটা বাস্তবে দেখা গেলেই, পরিবর্তন আসবে শিশুদের জীবনাচরণে।’ আরও পড়ুন
তুষারের শহর থেকে মহাকাশে লাইকা চরাঞ্চলে একমাত্র যান ঘোড়ার গাড়িকেএসকে/এমএস