গ্রামের এক দুপুর। খালপাড়ের মাথা দিয়ে হালকা বাতাস বইছে। আকাশে রোদ্দুর ঝলমল করছে। মাটির গন্ধে ভিজে আছে চারপাশ। এমন এক সময় দূর থেকে ভেসে এলো একটানা একটি সুর—টুন টুন টুন। তার সঙ্গে একাধিকবার শোনা গেল, ‘আইসক্রিম আইসক্রিম!’
Advertisement
এমন মুহূর্ত ছিল; যখন সেই শব্দেই কেঁপে উঠতো পুরো গ্রাম। গলির মাথায় একে একে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ছুটে চলতো। তাদের হাতে ধান, পয়সা, বোতল, প্লাস্টিক, চুল ইত্যাদি। কেউ আবার চাল হাতেও দৌড় দিচ্ছে। কেউবা বাবার পকেট থেকে টাকা নিয়ে হুটহাট হাজির হচ্ছিল।
এই তো ছিল সেই পুরোনো দিনের দৃশ্য। তখন আইসক্রিমওয়ালা শুধু বিক্রেতা নন, ছিলেন বন্ধু, ভালোবাসার গল্পের সঙ্গী। তিনি শুধু ‘আইসক্রিম! আইসক্রিম!’ বলে হাঁকতেন না। বরং তার গলায় ছিল একধরনের মধুর সুর। অনেক সময় ঘণ্টা বাজিয়ে বলতেন, ‘ঠান্ডা ঠান্ডা আইসক্রিম, মজাদার আইসক্রিম!’ অন্য সময় বলতেন, ‘বাচ্চাদের স্বাদের খাবার! আইসক্রিম আইসক্রিম!’ তার কণ্ঠে শুধু শব্দ নয়, ছিল একরাশ উচ্ছ্বাস। সেই উচ্ছ্বাসে সাড়া দিতো পুরো গ্রাম।
তখনকার আইসক্রিমওয়ালাদের প্রতি গ্রামের শিশুদের ছিল বিশেষ ভালোবাসা। তারা শুধু মজাদার আইসক্রিমই দিতো না। সঙ্গে থাকতো স্নেহের পরশ, মধুর সম্পর্ক। পরিচিত হলে প্রায়ই তারা শিশুদের হাতে বাড়তি একটি আইসক্রিম গুঁজে দিতেন। তাদের কণ্ঠে ছিল মমতা। বাড়তি আইসক্রিম প্রাপ্তি ছিল একধরনের ভালোবাসার পুরস্কার।
Advertisement
সেই ঘণ্টার শব্দ শোনার পর ছেলেমেয়েরা একে একে বেরিয়ে আসতো। কোনো মেয়ে যদি উঠানে খেলা ফেলে ছুটে দৌড়ায়, তখন ছেলেরা গাছ থেকে লাফ দিয়ে নামতো। পুকুরঘাট, তালগাছের ছায়া, খেজুর পাতার ছাউনি সব জায়গাতেই ছিল আইসক্রিম খাওয়ার অমলিন স্মৃতি। কারো ঠোঁটে লেগে থাকতো কমলা রঙের বরফ, কারোবা দাঁতের ফাঁকে মিষ্টি হিম। ছোট ছোট আনন্দের মধ্যে তারা সুখ পেতো। তখনই যেন ছিল শৈশবের শ্রেষ্ঠ সময়।
এখন সেই দৃশ্যগুলো আর তেমন দেখা যায় না। আইসক্রিমওয়ালা আজকাল আর আসেন না। ঘণ্টার শব্দও এখন তেমন শুনতে পাওয়া যায় না। আমাদের জীবনে এসেছে আধুনিকতা-প্রযুক্তি। মোবাইল স্ক্রলে গড়িয়ে যায় সবকিছু আর সেই রঙিন দিনগুলো হারিয়ে যায় কংক্রিটের শহরে। আইসক্রিমও এখন শুধুই একটা প্যাকেটজাত খাবার। যা দোকান থেকে কিনে খাওয়া হয়। শৈশবের সেই উচ্ছ্বাস এবং মিষ্টি চিৎকার এখন স্মৃতির মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে।
তবে এখনো কোনো কোনো গ্রামে, কোনো ছোট হাটের কোণে দেখা যায় সেই পুরোনো ঘণ্টা বাজানো মানুষটিকে। হয়তো তিনি এখনো বাজান সেই ঘণ্টা। ছোট ছোট শিশুদের মধ্যে মিষ্টি স্মৃতি তৈরি করে। তখন হঠাৎই থেমে যেতে চায় সময় আর আমরা মনে মনে বলে উঠি, ‘ঘণ্টা বাজলেই শৈশব ফিরে আসে।’
আধুনিক সময়ে পুরোনো মুহূর্তগুলো হারিয়ে গেলেও স্মৃতির মধ্যে তারা চিরকাল অমলিন থাকবেন। তারা স্মরণ করিয়ে দেবেন সেই দিনগুলো, যখন ঘণ্টার শব্দে ছুটে আসতো পুরো গ্রাম। যখন শিশুদের মুখে ছিল বিশাল এক হাসি আর আইসক্রিমের স্বাদ ছিল আকাশ সমান।
Advertisement
এসইউ/এএসএম