একুশে বইমেলা

সাহিত্যের প্রসারে ঈদ সংখ্যা

অলোক আচার্য

Advertisement

এ দেশে অন্য সবকিছুর বাজারের সাথে সাহিত্যেরও একটা বাজার আছে। এই বাজারে মেধাশ্রম বেচাকেনা হয়। খুব সস্তা এই শ্রম! সবকিছুর দাম বাড়ে। তবে সাহিত্যের কদর এ দেশে বাড়ে না। তারপরও বাংলায় পবিত্র ঈদুল ফিতরের আনন্দের ঢেউ আর সব জায়গার মতো সাহিত্যের বাজারেও লাগে। ঈদের দিন পনেরো আগে থেকেই দেশের সব পত্রিকা থেকেই ঈদ সংখা বের করে। কেউ লেখা নেন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে। আবার কোনো কোনো পত্রিকা গোপনেই কাজটি সেরে ফেলে! অর্থাৎ তারা লেখা আহ্বান করেন না। যেমন-তেমন লেখকের লেখা তাদের দরকার হয় না!

যা-ই হোক, এখন এত পরিমাণ ঈদ সংখ্যা বের হয়; তা গুনেও শেষ করা কষ্টসাধ্য। জাতীয় পত্রিকা, আঞ্চলিক পত্রিকা, অনলাইন পত্রিকা, মাসিক পত্রিকা; মোট কথা সবাই বের করে ঈদ সংখ্যা। তবে এসব পাঠ করেন কতজন পাঠক; সে নিয়ে রয়েছে সন্দেহ! যেখানে বই-ই পড়ে না পাঠকেরা; সেখানে সেই পাঠক আবার ঈদ সংখ্যা কিনে পড়বেন, তা নিয়ে সন্দেহ থাকাই স্বাভাবিক। তারপরও ঈদ যেমন আনন্দ, ঈদ সংখ্যাও তেমনই আনন্দ। সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে মানে লেখক ও পাঠকদের কাছে এটি একটি বিশেষ সময় বা অপেক্ষার ক্ষণ।

বইমেলা শেষ হয়েছে খুব বেশি দিন হয়নি। তারপর আবার এই ঈদ সংখ্যার আয়োজন। সবমিলিয়ে সাহিত্য একটি গতি লাভ করে। প্রাণ ফিরে পায়। তবে কিছু প্রশ্ন কিছু দ্বিধা রয়েছে। সেটি হলো এই যে এত এত ঈদ সংখ্যা বেরোচ্ছে, বাজারে আসছে বলে পত্রিকার পাতায়, ফেসবুকে ঘোষণা দিচ্ছেন; সেগুলো লেখকের বাইরে পাঠক কতজন কিনছেন, খোঁজ নিচ্ছেন বা পড়ছেন। অথচ প্রায় পরিচিত জাতীয় দৈনিক, স্থানীয় দৈনিক, অনলাইন পত্রিকা, ই-পেপার রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে ঈদ সংখ্যা বাজারে আনছে।

Advertisement

লেখকরা খোঁজ নিচ্ছেন তার লেখা ঈদ সংখ্যায় থাকছে কি না। এ ছাড়া পাঠকেরা খোঁজ নিচ্ছেন কমই। কারণ আজকাল তো পাঠক প্রায় নেই বললেই চলে। গত কয়েক বছর ধরেই লক্ষ্য করছি, ঈদ সংখ্যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রীতিমতো বাগযুদ্ধ চলে। অর্থাৎ ঈদ সংখ্যা প্রকাশের আগে লেখকেরা দুটি দলে ভাগ হন। এক দলে যারা ঈদ সংখ্যায় লিখছেন এবং আরেক দল যাদের লেখা ঈদ সংখ্যায় থাকে না বা লেখেন না।

তবে ঈদ সংখ্যায় লিখতে চান না এমন লেখক পাওয়া যাবে খুব কমই। এই দুই শ্রেণিতে ভাগ হয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গরম হয়ে ওঠে। তা উঠুক। এটাও তো এক ধরনের আলোচনা। আবার কে ঈদ সংখ্যা ভালো করছে আর কে মানসম্পন্ন করতে পারছে না, সেটিও আলোচনা হচ্ছে। এই ঈদ সংখ্যার লেখকদের মধ্যেও রয়েছে দুই শ্রেণি। প্রথম শ্রেণি হলো সাহিত্য সম্পাদকেরা যাদের কাছ থেকে লেখা চেয়ে নেন আর অন্যরা হলেন যারা নিজ উদ্যোগে লেখা সাহিত্য সম্পাদকের কাছে পাঠান এবং তীর্থের কাকের মতো বসে থাকেন তার নামটি ঈদ সংখ্যার সূচিতে আছে কি না দেখার জন্য। না থাকলে হতাশ হন এ কথা বলাই বাহুল্য। তবে থাকলে আবার গর্ব সূচক বক্তব্য দিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন! এ অবস্থাই চলছে।

এখানে একটি প্রশ্ন জাগে যে, সত্যি কি এত এত ঈদ সংখ্যার দরকার আছে? সাহিত্যের মান কি সকলে বজায় রাখতে পারছেন? একই লেখক বা কবি বহু পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় লিখছেন। লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে তার সবগুলো লেখা মানসম্পন্ন হয়নি।

আরও পড়ুন এক স্বপ্নবাজ লেখকের অগ্রযাত্রা বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প ও আমাদের দায়

কেউ কেউ চাপে পরেও লেখা দেন। অর্থাৎ একটা লেখা দিতেই হবে এমন অবস্থা! এবার আসা যাক ঈদ সংখ্যার বাজারের কথা। বাস্তবিক অর্থে ঈদ সংখ্যার বাজার ভালো না। মানে যারা লিখছেন তার বাইরে ঈদ সংখ্যা কিনছেন খুব কমই। তাহলে ঈদ সংখ্যা তৈরির উদ্দেশ্য যদিও পাঠককুলকে বিশেষ লেখা পাঠ করানো কিন্তু তা আদতে হচ্ছে না। কিন্তু বাংলা সাহিত্য বিস্তারে বা শক্তিশালী সাহিত্য ক্রমধারায় ঈদ উপলক্ষ্যে প্রকাশ করা বিশেষ সংখ্যাগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।

Advertisement

ঈদ উপলক্ষে করা বিশেষ সংখ্যাগুলো বাংলা ভাষার একটি ঐতিহ্য। আজ থেকে কয়েক দশক আগেও এত বিপুল আয়োজনে ঈদ সংখ্যা প্রকাশিত হতো না। তখন পত্রপত্রিকার সংখ্যাও ছিল হাতেগোনা। অনলাইন তো ছিলই না। আবার ই-পেপারের অস্তিত্বও ছিল না। কিছু জাতীয় দৈনিক আয়োজন করে ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করতো। তখন আবার এসব ঈদ সংখ্যার একটি পাঠক শ্রেণিও ছিল। তারা অপেক্ষাই করতেন ঈদে বিশেষ সংখ্যা কিনে পড়ার। যেমনটা একসময় ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠানমালা নিয়ে দর্শকদের ভেতর ব্যাপক আগ্রহ ছিল।

এখন ঈদের অনুষ্ঠানের দর্শকও যেমন উধাও; তেমনই ঈদ সংখ্যার পাঠককুলও উধাও। তাছাড়া কয়েকদিন আগেই তো বইমেলা থেকে বই কেনা হয়েছে। কিছু পাঠক এখনো আছে। যারা আছেন; তারা সারাজীবনই থাকবেন। কিন্তু নতুন পাঠক খুব কমই তৈরি হয়েছে। তবে ঈদ সংখ্যার লেখক কিন্তু বেড়েছে। আয়োজনের কলেবর দেখলেই তা বোঝা যায়। এসব লেখকেরাই টিকিয়ে রেখেছেন ঈদ সংখ্যা। ইদানিং এ বিভক্তি অর্থাৎ ঈদ সংখ্যার লেখক এবং না লেখা লেখক বেশিই প্রকাশ্যে এসেছেন। এটা হওয়া উচিত নয়। কারণ লেখা তো লেখাই। যে লিখছে ঈদ সংখ্যায় লিখতে থাকুক। ক্ষতি তো নেই! চাইলে আপনিও লিখুন।

এভাবে এক তরফা ঈদ সংখ্যা নিয়ে সমালোচনা করা উচিত নয়। কারণ সম্পাদকরা যথেষ্ট পরিশ্রম করেই একটি ঈদ সংখ্যা তৈরি করে থাকেন। তিনিই ভালো বুঝবেন কার লেখা থাকা উচিত আর কার লেখা থাকা উচিত নয়। কারণ বাজারেরও তো একটা ব্যাপার-স্যাপার আছে। কিছু পাঠকের কাছে তো বিক্রি করতে হবে। ত না হলে আর সেটা ঈদ সংখ্যা কেন। ঈদ সংখ্যায় অন্তর্ভুক্ত থাকে ছোট গল্প, বড় গল্প, অণুগল্প, উপন্যাস, উপন্যাসিকা, কবিতা, ভ্রমণ, প্রবন্ধসহ কিছু বিষয়।

এবার বলি ঈদ সংখ্যায় লাভ হয় কোথায়? আমি যদি একটি বই কিনি তাহলে সেখানে একটা উপন্যাস অথবা কয়েকটা গল্প অথবা কিছু কবিতা এসব পাওয়া যাবে। তা-ও আমাকে আলাদা আলাদা কিনতে হবে। কিন্তু একটি ঈদ সংখ্যার ভেতর থাকে কয়েকটি উপন্যাস, বেশ কিছু ছোট গল্প, বড় গল্প, অনেক কবিতা এবং আরও অনেক আয়োজন। এক মলাটে ঈদ সংখ্যা ছাড়া আর এত আয়োজন কোথায় পাবেন! তাই ঈদ সংখ্যার গুরুত্বটা আলাদা। এর সাথে কিছুই মেলানো যায় না।

মোট কথা, লেখায় বৈচিত্র্যের অভাব থাকে না ঈদ সংখ্যার আয়োজনে। কে লিখতে পারছেন আর কে পারছেন না; সেটা নিয়ে আসলে সমালোচনার কিছু নেই। বা আমি লিখতে না পারলেই ঈদ সংখ্যার মান থাকছে না সেটা বলারও সুযোগ নেই। যারা লিখতে পারছেন তাদের জন্য শুভ কামনা। এর সাথে যোগ করা যায়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মেধাবী সাহিত্যিকদের যদি এখানে লেখার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে অনেক ভালো লেখক-কবি উঠে আসবেন নিশ্চিত। যদিও তরুণ লেখকদের সুযোগ কমই থাকে ঈদ সংখ্যাগুলোয় লেখার। সেটাও ওই ব্যবসায়িক কারণেই। কিন্তু সুযোগ দেওয়া উচিত।

যা-ই হোক, ঈদ সংখ্যা মানে আলাদা একটা আনন্দ, অনুভূতি। বিশেষ কিছু তো থাকেই। ঈদ সংখ্যা সাহিত্যের প্রসারে ভূমিকা রাখুক এটাই প্রত্যাশা। লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।

এসইউ/এএসএম