একুশে বইমেলা

আশা-নিরাশার বইমেলা

‘কেমন হলো এবারের অমর একুশে বইমেলা?’ এমন প্রশ্ন প্রতি বছরই শুনতে হয়। সেটা সার্বিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে কোনো কাজেই তৃপ্তির ঢেকুড় তোলার সুযোগ থাকে না। কেননা ভালোর কোনো শেষ নেই। সব কাজেই ইতিবাচক ঘটনার সঙ্গে নেতিবাচকতাও থাকে। সে ক্ষেত্রে দেখার বিষয়—ইতিবাচকতা কতটুকু আর নেতিবাচকতার প্রভাব কতটুকু বিস্তার করেছে। আমরা বিশ্বাস করি, অমর একুশে বইমেলা বাঙালির প্রাণের উৎসব। লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের মহা মিলনমেলা। এই মিলনমেলার জন্য আমরা একটি বছর অপেক্ষা করে থাকি। বিগত বছরের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে পরের বছর ভালোভাবে আয়োজনের চেষ্টা করা হয়। তাই এই মূল্যায়ন সবার জন্যই মঙ্গলজনক।

Advertisement

এবার দেখতে দেখতেই যেন শেষ হয়ে গেল আমাদের আবেগের উৎসব এই বইমেলা। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে পর্দা নেমেছে বইমেলার। এ বছর পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় আশানুরূপ না হলেও বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই শেষ হয়েছে মাসব্যাপী আয়োজিত এই মেলা। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর নানা জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধন করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান: নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ’—প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে ১ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৪টায় বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণে মাসব্যাপী বইমেলার উদ্বোধন করেন তিনি। তবে প্রথম সপ্তাহে বরাবরই কম জমে ওঠে বইমেলা। নতুন বইয়ের আগমন, লেখক ও পাঠকের প্রস্তুতি ঘিরে প্রথম সাতদিন চলে যায় চোখের পলকেই। এরপর আস্তে আস্তে জমতে শুরু করে। ফিরে আসে উৎসবের আমেজ।

অমর একুশে বইমেলার সপ্তম দিনে মেলার প্রথম শিশুপ্রহরে আনন্দে মেতে ওঠে শিশুরা। তবে এ বছর প্রতিবারের মেলার গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ সিসিমপুর না থাকায় আক্ষেপ করেছেন অনেকেই। কিছুটা হতাশ হয়েছে শিশুরাও। জানা গেল, সিসিমপুর এবার আবেদনই করেনি। যে কারণে এ বছর সিসিমপুর ছিল না। তবে অন্য আয়োজনে কোনো কমতি ছিল না। শিশুরা নানা প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় স্বতস্ফূর্ত ভাবেই। সিসিমপুর না থাকায় অভিভাবকরা কিছুটা আক্ষেপ করে বলেছেন, আমরা প্রতি বছর শিশুপ্রহরে বাচ্চাদের নিয়ে আসি। এখানে এলে অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে ওদের মধ্যে। বর্তমান অনলাইন কার্টুনের যুগে এখানে শিশুরা বাস্তবে সিসিমপুরের হালুম, ইকরিদের সঙ্গে খেলতে পারে। আনন্দময় মুহূর্ত কাটাতে পারে। কিন্তু এবার সেই সুযোগ ছিল না। এটি মোটেও ভালো লাগার মতো কোনো বিষয় ছিল না অভিভাবকদের কাছে।

প্রতি বছর ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় ‘ভ্যালেন্টাইন উইক’। সপ্তাহের প্রথমদিনে থাকে রোজ ডে। অপরদিকে অমর একুশে বইমেলার সপ্তম দিনটি ছিল শুক্রবার। ফলে দিবসের মাহাত্ম্য কিংবা শুক্রবার যা-ই হোক না কেন। জনতার সব স্রোত মিশেছিল বইমেলায়। বিকেলের লাল সূর্য যখন হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। তখনো গেট দিয়ে প্রবেশ করতে লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে। বিশাল লম্বা ছিল সেই লাইন। তরুণদের উল্লাস আর তরুণীদের হাসি এক অন্যরকম আবহ সৃষ্টি করেছিল। বইমেলার সার্থকতা খুঁজে পেয়েছিল পাঠক। তবে এবার দুটি শুক্রবার এবং সরকারি দুটি ছুটি একই দিনে হওয়ায় লোক সমাগম তুলনামূলক কম হয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও শবে বরাতকে কেন্দ্র করে অন্যান্য দিবস হাতছাড়া হয়েছে পাঠক এবং প্রকাশকদের। তবে বসন্তবরণের সঙ্গে যোগ হয় বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। সবমিলিয়ে বাড়তি উচ্ছাস আর উদ্দীপনা নিয়ে অমর একুশে বইমেলায় হাজির হন বইপ্রেমীরা। অন্য দিনের তুলনায় এদিন বইমেলায় বাড়ে ক্রেতা-দর্শনার্থী। বিকেল হতে না হতেই পুরো মেলা প্রাঙ্গণে ক্রেতা-দর্শনার্থীর উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। মেলায় নারী-পুরুষ উভয়কেই বসন্তের সাজে আসতে দেখা যায়। বাদ যায়নি শিশুরাও। তবে তরুণ-তরুণীদের উপস্থিতি ছিল বেশি। বইও বিক্রি হয়েছে আশানুরূপ।

Advertisement

এত আনন্দের মধ্যেও কিছুটা বিষাদ যুক্ত হয়েছে। যা অস্বীকার করার উপায় নেই। এর মধ্যে আবার কোনো কোনো দিন ছোটখাটো কিছু বিশৃঙ্খলা হয়েছে। যা প্রতি বছরই কমবেশি হয়ে থাকে। বইমেলার একটি স্টলে বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরীনের বই বিক্রিকে কেন্দ্র করে লেখক শতাব্দী ভবকে বের করে দেয় জনতা। এর প্রতিবাদে আবার বিক্ষোভ করে বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলো। তবে পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আগেই বইমেলা কর্তৃপক্ষ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে। বইমেলার দশম দিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ১২৮ নম্বর স্টলে সংঘটিত এই অনভিপ্রেত ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তদন্ত কমিটি গঠন করে বাংলা একাডেমি। অপরদিকে সোহেল হাসান গালিবের একটি কবিতাকে কেন্দ্র করে বন্ধ রাখা হয় উজান প্রকাশনীর স্টল। এই দুটি ঘটনা ছাড়া তেমন কোনো বিশৃঙ্খলা চোখে পড়েনি। তবে ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে বইমেলা আরও প্রাণবন্ত হতে পারতো। যেহেতু এবার স্টলের সংখ্যা বেড়েছিল। নতুন অনেক প্রতিষ্ঠান যোগ দিয়েছিল এবারের মেলায়। তাছাড়া ভিন্ন একটি বিষয় নিয়ে মতবিরোধ তৈরি হয় মেলা প্রাঙ্গণে। অমর একুশে বইমেলায় প্রদর্শিত নারীস্বাস্থ্য সুরক্ষার পণ্য স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্রদর্শন ও বিক্রি বন্ধ করে দেয় বইমেলা কর্তৃপক্ষ। কিছু মানুষ এই স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রকাশ্যে বিক্রি বা প্রদর্শনীতে আপত্তি জানায়। তাদের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা একাডেমি দুটি স্টল বন্ধ করে দেয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে পণ্যগুলো তুলে নেওয়া হয়। পরে অবশ্য বিনা মূল্যে বিতরণের শর্তে স্টল খুলে দেওয়া হয়।

আরও পড়ুনশুদ্ধ চর্চার সংস্কৃতি এবং নষ্ট রাজত্বের ইতিবৃত্তলাল গোলাপ ও বইমেলার জমে ওঠা শুক্রবার

যে বিষয়টি প্রতি বছরই হতাশ করে, তা হলো—লিটল ম্যাগ চত্বর। বইমেলার ২২তম দিনে এসেও লিটল ম্যাগ চত্বরের নির্জনতা ভাঙতে দেখা যায়নি। যা হতাশা বাড়িয়েছে লেখক, লিটল ম্যাগ সম্পাদক ও প্রকাশকদের মধ্যে। ছুটির দিনে তুলনামূলক ভিড় বাড়লেও বিক্রি হয়নি তেমন ছোট কাগজ। দেয়াঙ সম্পাদক মাহমুদ নোমান একদিন বললেন, প্রথম নয় দিনে তার একটি ছোট কাগজও বিক্রি হয়নি। যা তাকে অনেকটা হতাশ করেছে। সাহিত্যকর্মীরা মনে করেন, বহেরাতলা থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলে আসার পর থেকেই লিটল ম্যাগ চত্বরে লোক সমাগম কমেছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, বৃহৎ পরিসরে বইমেলা এসেছে ঠিক, আয়োজনও অনেক বড় কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি মানুষের বা লেখকদের যে টান বা দায়; তা যেন কমেছে। ফলে লিটল ম্যাগ নিয়ে সবাই কমবেশি হতাশ ছিলেন।

বইমেলায় সমস্যার যেন শেষ নেই। তবে বৃষ্টি তো প্রতি বছরই মেলার সময় দেখা দেয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বৃষ্টি বাগড়া বাঁধিয়েছিল একদিন। বসন্ত যখন শুরু হয়েছে, বিকেলবেলা রাজধানীজুড়ে হঠাৎ তুমুল বৃষ্টি! চলল সন্ধ্যার পর পর্যন্ত। রাস্তাঘাট কাদায় মাখামাখি। ফ্লাইওভারে উপচে পড়া জ্যাম। ধোঁয়া-পানি-ধুলো মিলিয়ে অদ্ভুত এক স্যাঁতস্যাঁতে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল বইমেলায়। এর মধ্যেও বইপ্রেমীরা ঠিক পৌঁছে যায় অমর একুশে বইমেলায়। যদিও বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর মেলায় মানুষ অনেক কমে এসেছিল কিন্তু মেলা চলেছে নির্ধারিত শেষ সময় পর্যন্ত। এভাবেই সমস্যা ও সম্ভাবনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে বইমেলা। আয়োজকরা নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হলেও কঠোর ভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। এবারের বইমেলা আয়োজকদের জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল। তারা সেই চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করতে পেরেছেন। একটি সার্থক ও সুন্দর বইমেলা অবশেষে উপহার দিতে পেরেছেন।

দীর্ঘসময় ব্যাপী আয়োজিত এই মেলা একটু-আধটু ঘটনার জন্ম দিতেই পারে। তবে তাকে উৎড়ে যাওয়াই মূল বিষয়। তবে এবারের মেলায় হকারদের অবাধ বিচরণ ছিল। এত বেশি হকার কোনো বছরই চোখে পড়েনি। এবার নিরাপত্তা নিয়েও কথা বলেছেন কবি-লেখকরা। প্রথমদিকে জোরালো না হলেও পরের দিনগুলোতে নিরাপত্তা নিয়ে তেমন শঙ্কা ছিল না। এবারের মেলায় অংশ নিয়ে হতাশ হয়েছেন প্রকাশকরা। সেটি অবশ্য বিক্রির বিষয়ে। এতে আয়োজকদের কোনো হাত নেই। পাঠকের উপস্থিতি যা-ই হোক, দুই-একদিন বাদে বই বিক্রি আশানুরূপ হয়নি। কোনো কোনো প্রকাশক বলেছেন, করোনাকালের চেয়েও কম বিক্রি হয়েছে এবারের বইমেলায়। শুধু কয়েকজন ভাইরাল লেখক কিংবা কনটেন্ট ক্রিয়েটরের বই নিয়ে পাঠককে হইচই করতে দেখা গেছে। কারো কারো বই নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে।

Advertisement

বইমেলা শেষে বাংলা একাডেমির তথ্য অনুযায়ী কত টাকার বই বিক্রি হয়েছে, তা এবার জানা যায়নি। তবে তা-ও ত্রিশ-চল্লিশ কোটির বেশি হওয়ার সম্ভাবনা কম। একাডেমির সচিব জানিয়েছেন, প্রকাশকদের কাছে বাংলা একাডেমির পাঠানো তথ্য ফর্মে প্রকাশকরা তথ্য না দেওয়ায় এবারের বইমেলায় মোট বই বিক্রির হিসাব প্রকাশ করা যায়নি, যা বইমেলার ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। এবার ২৮ দিনে এসেছে মোট ৩ হাজার ২৯৯টি নতুন বই। আমরা জানি, ২০২৪ সালের অমর একুশে বইমেলায় ৬০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিল। প্রকাশিত হয়েছিল ৩ হাজার ৭৫১টি নতুন বই। যেখানে ২০২৩ সালে বিক্রি হয়েছিল ৪৭ কোটি টাকার বেশি বই আর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৭৩০টি। ২০২২ সালে সমগ্র মেলায় ৫২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিল।

সবশেষে শুক্রবার ছুটির দিনে একটি জমজমাট সার্থক বইমেলা উপহার দেওয়ার জন্য বাংলা একাডেমিকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। অনেক সাহসিকতার সঙ্গে তারা এমন বৃহৎ একটি উৎসব সম্পন্ন করতে পেরেছেন। আগামী বইমেলা আরও ঝলমলে হবে—এই প্রত্যাশা রাখছি।

এসইউ/জেআইএম