জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির সমন্বয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ নামে নতুন যে রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ হলো—সেই দলের শীর্ষ নেতাদের অনেকের কথায় জনমনে এই ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, তারা জুলাই অভ্যুত্থানকে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ এবং ২০২৪ সালকে ১৯৭১-এর বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান। বিশেষ করে ১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান নিয়ে ন্যারেটিভ এবং বঙ্গবন্ধু ইস্যুতে তাদের অবস্থানে সেটি অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
Advertisement
কিন্তু জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে ১৯৭১ সালের প্রসঙ্গটি ছিল। দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমরা যে স্বপ্ন দেখেছিলাম—সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার, সেই স্বপ্ন আমরা বাস্তবায়ন করতে চাই।’ বলা হয় মর্নিং শোজ দ্য ডে। অর্থাৎ একটি সংগঠন বা দল কী করবে—সেটি তাদের আত্মপ্রকাশের অনুষ্ঠান, সেখানে নেতাদের বক্তব্যের টেক্সট, তাদের কর্মসূচি এবং সেই দলে যুক্ত মানুষদের পরিচয়ের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়।
জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানটি শুরু হয়েছিল কোরআন তেলাওয়াত এবং অন্য ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের পরে জাতীয় সংগীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে। রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউয়ে অর্থাৎ সংসদ ভবনের উল্টো দিকে সেই অনুষ্ঠানে যারা গিয়েছিলেন, তাদের অসংখ্য মানুষের হাতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ছিল। অর্থাৎ অনেক জাতীয় পতাকা প্রদর্শন এবং জাতীয় সংগীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে দলটির আত্মপ্রকাশ নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক ঘটনা। কিন্তু এই দলটির শীর্ষ নেতারা বারবার স্লোগান দিচ্ছিলেন ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে যে দলের আত্মপ্রকাশ, তাদের মূল স্লোগানটি বাংলায় হলো না কেন? ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বলার মধ্য দিয়ে তারা জুলাই অভ্যুত্থানকে মহিমান্বিত করা তথা জুলাইয়ের স্পিরিট ধারণের চেষ্টা করেছেন এটা ঠিক। কিন্তু এই দলের পক্ষ থেকে যেহেতু বলা হচ্ছে যে, জাতীয় নাগরিক পার্টি হবে মধ্যপন্থি দল—ফলে একটি মধ্যপন্থি দলের স্লোগান ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ হয় কি না—সেই প্রশ্নটি অনেকের মনেই আছে।
Advertisement
আগামী দিনগুলোতে দেশের অর্থনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং নির্বাচন ইস্যুতে যে সব রাজনৈতিক সংকট তৈরি হবে, সেখানে এই দলের অবস্থানই বলে দেবে তারা কোন পন্থি? বিশেষ করে দল গঠনের আগে থেকেই তাদের গায়ে ‘কিংস পার্টি’র যে তকমা লেগেছে—সেটি তাদের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।
বাংলাদেশে মূলধারার মধ্যপন্থি দল বলতে বোঝানো হয় সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে। এর বাইরে বড় দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামি এবং ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ ডানপন্থি দল। সিপিবিসহ কিছু বামপন্থি দলও বাংলাদেশে সক্রিয়—যদিও রাজনীতিতে তাদের প্রভাব ততটা নয়।
বাংলাদেশে বামপন্থি রাজনীতির সম্ভাবনা যেহেতু কম এবং দেশের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান এবং তারা ধর্মভীরু হওয়ায় মূলধারার সব দলই মুসলিম সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগাতে চায়। যে কারণে বামপন্থিদেরও অনেক সময় বলতে শোনা যায়, ‘বামপন্থি মানেই ইসলামের বিরুদ্ধে নয়।’ কেননা তারাও জানেন এই দেশের ভোটের রাজনীতিতে ধর্ম বরাবরই একটা বিরাট ফ্যাক্টর। যে কারণে ১৯৭২ সালে যখন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করা হয় তখন তার শুরুতে বিসমিল্লাহ এবং রাষ্ট্রধর্মের বিধান না থাকলেও একজন সামরিক শাসক সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম যুক্ত করেন এবং তারপরে আরেকজন সামরিক শাসক ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধান সংশোধন করেন।
এই দুজনেরই উদ্দেশ্য ছিল জনতুষ্টি তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন আদায়। শুধু তাই নয়, ২০১১ সালে যখন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় বাহাত্তরের মূল সংবিধানের অনেক বিধান ফিরিয়ে আনা হয়, তখন তৎকালীন সরকার বা সংসদ সংবিধান থেকে বিসমিল্লাহ বা রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের সাহস করেনি। কারণ তারা ভয় পেয়েছে এই কারণে যে, সাধারণ মানুষ এর বিরোধিতা না করলেও বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী এর বিরুদ্ধে রাস্তায় নামবে এবং তাতে দেশে দারুণ অস্থিরতা তৈরি হবে।
Advertisement
সেই সেন্টিমেন্ট তথা ভোটের রাজনীতি মাথায় রেখেই সদ্য গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি যদিও বলছে যে তারা মধ্যপন্থি দল হবে, কিন্তু অনেকের কাছেই এটা মনে হয় যে, তাদের ঝোঁকটা আসলে ডানপন্থার দিকে। বিশেষ করে এই দলটি দুই ধরনের ভোটারদের তাদের ভোটব্যাংক হিসেবে বিবেচনা করছে বলে মনে হয়। একটি হলো তরুণ ভোটার, বিশেষ করে যারা এই বছর ভোটার হয়েছেন এবং জুলাই অভ্যুত্থানের সমর্থক ছিলেন এবং মাদরাসাকেন্দ্রিক ভোটার। বাংলাদেশে যে হাজার হাজার মাদরাসা রয়েছে, তার শিক্ষার্থী ও শিক্ষক এবং তাদের পরিবার হিসাব করলে এটি একটি বিরাট ভোটব্যাংক। এই ভোটারদের সবাই যে তরুণদের নতুন দলকে ভোট দেবে তা হয়তো নয়। কিন্তু তারা এই জনগোষ্ঠীকে তাদের অন্যতম প্রধান শক্তি বলে বিবেচনা করে। এটা অনেকেই মনে করেন। তার কিছু লক্ষণও আছে। যেমন হাসনাত আব্দুল্লাহ বিভিন্ন মাহফিলে গিয়েও বক্তব্য দিয়েছেন।
যদি তাই হয়, সেক্ষেত্রে শেষমেশ এই দলটির পক্ষে মধ্যপন্থি চরিত্র ধরে রাখা কঠিন হবে। বরং তাদের কর্মসূচি এবং নেতাদের কথাবার্তায় প্রমাণ করতে হবে যে, তারা ইসলামের পক্ষে তথা তারা ডানপন্থি । যেমন নতুন এই দলটির গঠনের পরদিনই দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে লিখেছেন: ‘রাজনীতির আগেও আমার পরিচয়, আমি একজন মুসলমান। আমি আমার এই পরিচয় ধারণ করি, সবসময় করেই যাবো। আমার বিশ্বাসকে কিংবা আমার দেশের মানুষের বিশ্বাসকে আঘাত করে কোনো রাজনীতি আমি কখনো করবো না। স্পষ্ট কণ্ঠে জানিয়ে দিতে চাই, ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিপন্থি কিছুই আমার বা আমাদের রাজনীতিতে কখনো জায়গা পাবে না, যা হয়েছে, সেটা ছিল একটি অনিচ্ছাকৃত ভুল। আমরা নির্ভুল নই। কোনো ভুল করলে আপনারা আমাদের নিজের ভাই মনে করে ভুল ধরিয়ে দেবেন এবং যদি, কিন্তু অথবা ব্যতীত আমরা আমাদের ভুল সংশোধন করে নেবো।’
দল গঠনের পরদিনই তাকে কেন এই ঘোষণাটি দিতে হলো? যাদের তারা তাদের ভোটব্যাংক মনে করেন তাদের কোনো পক্ষ থেকে তার বা দলের ব্যাপারে কি দলের আদর্শ নিয়ে কোনো সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে যে সে কারণে তাকে ঘোষণা দিয়ে বলতে হলো যে, ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিপন্থি কিছুই আমার বা আমাদের রাজনীতিতে কখনো জায়গা পাবে না? তিনি লিখেছেন, যা হয়েছে, সেটা ছিল একটি অনিচ্ছাকৃত ভুল। কী সেই ভুল যার জন্য তাকে পাবলিকলি ক্ষমা চাইতে হলো?
বাস্তবতা হলো, এই দেশটি শুধু মুসলমানের নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান হলেও এখানে হিন্দুসহ অন্য ধর্মের মানুষও বসবাস করেন। সুতরাং কোনো একটি দলের নেতা যখন প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে বলেন যে, রাজনীতির আগেও তার পরিচয় তিনি একজন মুসলমান—সেটি অন্য ধর্মের মানুষের কাছে কী বার্তা দেয়? অন্য ধর্মের মানুষের ব্যাপারে এই দলের অবস্থান কী হবে, সেটি কি হাসনাত আব্দুল্লাহর এই পোস্টে কিছুটা হলেও পরিষ্কার হলো?
দল গঠনের পরদিনই যদি তাদের এ ধরনের ঘোষণা দিতে হয়, তাতে কি মনে হয় যে এই দলটি মধ্যপন্থি দল হিসেবে তাদের কর্মসূচি পালন করবে? আর যদি তারা শেষ পর্যন্ত মধ্যপন্থি চরিত্র ধরে রাখতে না পারে বা না রাখে, সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কাছে তারা কতটা গ্রহণযোগ্য হবে? নাকি তারা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত মানুষদের ভোটকেই যথেষ্ট মনে করছেন? অথবা মুসলিম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের মানুষের ভোট তাদের প্রয়োজন নেই? গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে বিভিন্ন ইস্যুতে যে ধরনের ধর্মীয় উন্মাদনা দেখা গেছে নতুন দলটি কি সেই উন্মাদনকে ভয় পাচ্ছে?
এটা ঠিক যে, মধ্যপন্থি হওয়াটা খুব জরুরি নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই কট্টরপন্থি দলও বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়ে সরকার গঠন করেছে। ধর্মীয় উগ্রবাদ ছড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত দলও রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে। একইভাবে বামপন্থি দলও সরকার গঠন করেছে বা করছে। সেক্ষেত্রে জাতীয় নাগরিক পার্টি যদি মনে করে যে তারা তাদের কর্মসূচিতে ধর্মকে প্রাধান্য দেবে এবং এই ধরনের মানসিকতার ভোটাররাই তাদের টার্গেট, সেক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যপন্থি বলে ক্যামোফ্লাজ তৈরির চেষ্টা না করাই ভালো। তারা যেহেতু তারুণ্যের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং তারা মনে করেন যে তরুণদের বিরাট অংশের ভোট তারা পাবেন, অতএব কোনো ধরনের লুকোছাপা ছাড়া যে কোনো বিষয়ে সরাসরি নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করাই শ্রেয়। সেটি ধর্মের প্রশ্নের যেমন, একইভাবে ১৯৭১ তথা মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নেও।
নতুন এই দলটি ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা ও ‘গণপরিষদ’ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন সংবিধান রচনার কথা বলছে—এ মুহূর্তে এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এরইমধ্যে বিএনপির সিনিয়র নেতা সালাহউদ্দীন আহমেদও তাদের এই বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন। ফলে একটি মধ্যপন্থি দল এরকম বিপ্লবী কর্মসূচি দেয় কি না—সেটিও প্রশ্ন। আবার তারা যদি ডানপন্থি বা কট্টরপন্থি দল হিসেবে আবির্ভূত হয় বা হতে চায়, বাংলাদেশের মানুষ সেটিও গ্রহণ করবে না। যদি হতো তাহলে এই দেশে ইসলামিক বা ধর্মভিত্তিক দলগুলো অনেক ভোট পেতো।
তবে আগামী দিনগুলোতে দেশের অর্থনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং নির্বাচন ইস্যুতে যে সব রাজনৈতিক সংকট তৈরি হবে, সেখানে এই দলের অবস্থানই বলে দেবে তারা কোন পন্থি? বিশেষ করে দল গঠনের আগে থেকেই তাদের গায়ে ‘কিংস পার্টি’র যে তকমা লেগেছে—সেটি তাদের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। যদি তারা সত্যিই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে দল গোছাতে থাকে এবং অন্য মূলধারার দলগুলো যদি তার বিরোধিতা করে, সেক্ষেত্রে তারা যত ভালো কর্মসূচি নিয়েই মানুষের কাছে যাক না কেন, তারা সরকারি বা সরকারপন্থি দল হিসেবেই চিহ্নিত হবে। তারুণ্যনির্ভর এবং নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করা দলটির জন্য সেটি খুব সুখকর হবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও লেখক।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস