মাননীয় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মহোদয়, আসসালামু আলাইকুম।
Advertisement
আমি একজন নগণ্য সাধারণ নাগরিক হিসাবে যারপরনাই মন খারাপ নিয়ে আপনাকে লিখছি। আমার মত এমন মন খারাপ হওয়া অসংখ্য মানুষ আপনার দিকে অধীর আগ্রহে আর আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে বলে আমার বিশ্বাস। ভুল ত্রুটি হলে আমাকে মাফ করে বাধিত করবেন বলে আশা রাখি।
ছাত্রজনতার সফল বিপ্লবের পরে একটা নতুন আশা আর স্বপ্নে আমরা সাধারণেরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলাম এবং এখনও আছি যেন আমাদের দেশটি সম্মানের সাথে বিশ্ব-দরবারে ঘুরে দাঁড়াতে পারে। গত ১৬ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনের বিষবাষ্পে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা দেশটি আবার নিজের পায়ে হাঁটতে পারবে এমনটিই স্বপ্ন দেখছিল ছাত্র জনতা। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অনেকেরই আশা ছিল এবার ‘নতুন' এক বাংলাদেশকে দেখা যাবে। সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় চাওয়া ছিল নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যে লাগাম। আরেকটি প্রত্যাশা ছিল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি। কিন্তু দুটি ক্ষেত্রেই অন্তর্বর্তী সরকার প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে পারছে না বলে মনে করেন অনেকেই৷
আমরা মনে করেছিলাম যে, ফ্যাসিস্টদের পতনের পরে নতুন সরকারের মাধ্যমে আইন শৃঙ্খলা খুব দ্রুত উন্নতি হবে। অপরাধীগণ ভয় পাবে এবং তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। কিন্তু সেটা আশানুরূপভাবে হয়নি বা করা যায়নি; কারণ দেশের সকল স্তরে ফ্যাসিস্ট সরকারের বীজ, চারা, বড় গাছ, দেয়াল, ইট সবই রয়ে গেছে। আর তারাই আপনাকে সহযোগিতা করছে না বরং গোপনে সরকারকে অকার্যকর করার জন্য ভারতের সাথে আঁতাত করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত ঘরেই রয়েছে আমাদের মূল শত্রু। এই ফ্যাসিস্টদের হাতে রয়েছে প্রচুর টাকা আর এই টাকা নিয়োগ করে তারা অপরাধ করাচ্ছে বলে অনুমেয়। টাকায় কথা বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। আর আমরা টাকা পেলে অনেকেই বিক্রি হই সেটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আরও একটা কথা প্রচলিত আছে যে, ‘বিড়াল মারো প্রথম রাতেই’।
Advertisement
বিপ্লবের মাধ্যমে আমরা ফ্যাসিস্টকে হটিয়েছি- দেশ গঠনের পাশাপাশি এখন দরকার পরিশুদ্ধি অভিযান। কিন্তু ‘মগজ ধোলাই’ হওয়া মানুষগুলি এখনও সমাজের সর্বস্তরে বিরাজমান। আমাদের এই পরিস্থিতি থেকে দ্রুত বের হতে হবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার মাধ্যমে; আর সে চিকিৎসা হল বিপ্লবের চেতনায় নতুন ধারা সৃষ্টি করে এই সব মগজধোলাই হয়ে যাওয়া মানুষ গুলিকে পরিপূর্ণভাবে আজীবন নিষ্ক্রিয় করে দেয়া।
আমরা সাধারণ মানুষেরা এই সরকারের শুরু থেকেই বলে আসছিলাম যে শুরু থেকেই আপনারা কঠোর অবস্থানে যান, তা’না হলে যতই দিন যাবে ততই ফ্যাসিস্টদের দোসর এবং অপরাধীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। বিপ্লবের পরে বেশ কঠোর হাতে পরিস্থিতি সামলাতে হয় এটা বিপ্লবের একটা সূত্র-কিন্তু আপনারা তা মানেননি। ঠিক তারই প্রতিফলন এখন আমরা দেখছি সর্বত্রই। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। আমরা রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে নিরাপদে বাঁচতে চাই। সাধারণ মানুষের আশ্রয়স্থল এখন আপনারা।
মাননীয় উপদেষ্টা, আপনিও দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিফাল। তবুও কিছু বলছি সারা দেশে এখন পরিকল্পিতভাবে একটা ঝুঁকি তৈরি করা হচ্ছে। যাদের পতন হয়েছে, তাদের পরিকল্পনা হলো অন্য কোনো পক্ষ যেন দেশ চালাতে না পারে, বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে দেশকে অস্থিতিশীল করা তাদের মূল লক্ষ্য। থেকে থেকে দাবির মিছিল যার ফলে জনগণের ব্যাপক ভোগান্তি বেড়ে যাচ্ছে প্রতিদিন।
দাবির তো শেষ নেই; দাবি পূরণ হলেই কি সব কিছু যথানিয়মে চলে যাবে? নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে জনমনে ক্ষোভ বাড়ছেই। মনে হচ্ছে বাজার সিন্ডিকেট আরো শক্তিশালী হয়েছে। নিত্যপণ্যের দাম কমেনি, উল্টো বেড়েছে। দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না বরং উপদেষ্টারা অনেকটা অসহায়ত্ব প্রকাশ করছেন। সুবিধাবাদিরা এখনো সক্রিয়-তোষামোদি আর মুখ চিনে কাজ করার সংস্কৃতি চারিদিকে এখনো বিদ্যমান। সবকিছু মিলিয়ে আমরা আমজনতা বড় বেশি চিন্তিত।
Advertisement
সাম্প্রতিক সময়ে দেশব্যাপী ছিনতাই, হামলা, চাঁদাবাজি, ধর্ষণের মতো অপরাধ বেড়ে যাওয়া ও দেশব্যাপী আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সমাজে উদ্বেগজনক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। ক্রমবর্ধমান অপরাধমূলক কার্যকলাপ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা নাগরিক জীবনে অনিরাপত্তার বোধ সৃষ্টি করছে। সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত। এমনকি খোদ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিতরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে বলে অনুমেয়।
মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভয় ও শঙ্কা কাজ করছে যেন, কখন আমি এবং আমার পরিবার আক্রান্ত হয়ে যাই। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তা রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এই ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা হুমকি মোকাবেলার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি, যাতে অপরাধীদের যথাযথ শাস্তি দেওয়া এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা যায়। একই সঙ্গে, সাধারণ মানুষকেও এই সমস্যার সমাধানে সম্পৃক্ত করতে হবে, যাতে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং অপরাধমূলক কার্যকলাপ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।
আমরা বাঙালিরা শুরু করি একভাবে আর শেষ করি ভিন্নভাবে। আমাদের চিন্তায় সবসময়ই একটা নিজস্ব ‘সুবিধাবোধ’ কাজ করে। শুরুতেই আমাদের কাছে যিনি ‘হিরো’,দিন শেষে আমরা তাকে ‘জিরো’ করে দেই- আবার ‘জিরো’ থেকে ‘হিরো’ করি জ্ঞান, সক্ষমতা বা অবদান যাই থাকুন। বিপ্লবের পরে আপনাকে যারা স্বাগত জানিয়াছিল আজ কিন্তু তারাই আপনার পদত্যাগ চাইছে। কি অদ্ভুত তাই না! আপনি সমালোচনায় থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। ভাল কাজে বাধা আসে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা সাধারণ বিষয় নয় তাও আবার একটা সফল ছাত্রজনতার আন্দোলনের পর যখন সবকিছুই প্রায় এলোমেলো, বৈরী। সব সমালোচনাই তিক্ত বা বিরক্তিকর নয় মাননীয় উপদেষ্টা। কিছু কিছু সমালোচনা আমলে নিতে হয়। গঠনমূলক সমালোচনা অবশ্যই কাজে লাগে। ‘বিশ্বাস’ কোনো সাধারণ বিষয় নয়। যেখানে ঘরের মানুষ বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠে না সেখানে দেশ পরিচালনায় আপনি সকলকে বিশ্বাস করতে পারবেন না। বর্তমান পৃথিবীতে আর রাজনীতিতে বিশ্বাস বলে কিছুই নেই।
আমরা উপলব্ধি করতে পাচ্ছি যে, কার্যত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বর্তমানে অনেকটা নিষ্ক্রিয়, ভীত এবং তাদের মধ্যে এক ধরনের ট্রমা কাজ করছে। নিরাপত্তার উন্নয়নে ‘স্ট্যাটিস্টিক্যাল’ উপস্থাপনা বা ধারণা আর মাঠে এবং প্রান্তিক পর্যায়ে ঘটে যাওয়া প্রকৃত পরিস্থিতি এক নয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ভয় না পাওয়া এবং তাদের উপস্থিতিতে অপরাধ ঘটে যাওয়া জনগণের মনে মারাত্মক একটা অসহায়ত্ব কাজ করছে। আমরা অনেকেই প্রকারন্তে ‘ traumatized’ হয়ে যাচ্ছি।
অনেক অপরাধ ঘটে যাচ্ছে কিন্তু সেটা নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে ‘তথ্য নেই বা দেরিতে তথ্য আসছে বা অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেব’- এ ধরনের আশাবাদ কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। সরকারী প্রশাসন দায় সারা ভাবে কাজ করছে, রাজনীতিদিরা নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতায় আসার চিন্তায় মশগুল। প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মানুষের যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, সেই আস্থা ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না । দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে তাহলে দেশ নিয়ে ভাবছে কে? যারা দেশের সুবিধা নিবে কিন্তু দেশের জন্য কাজ করবে না, যারা নিজের আখের গোছাবে, ফ্যাসিস্টদের সাথে গোপনে কাজ করবে রাষ্ট্রের জন্য তাদের কি আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা সেটা ভেবে দেখবেন।
অরাজনৈতিক সরকারের সামনে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জও বড় একটা বিষয়। মূল ধারার দেশ পরিচালনায় জাতীয় ঐক্য, ইতিবাচক রাজনীতি এবং কূটনীতি ছাড়া সার্বিক কার্যক্রম প্রায় অসম্ভব। কারণ, শেষ পর্যন্ত নির্বাচিত রাজনৈতিক দলই সরকার পরিচালনা করবে। সংস্কার অবশ্যই প্রয়োজন এবং আপনারা সেটা করবেন । কিন্তু সংস্কার একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া যা সীমিত সময়ের মধ্যে সম্ভব নয়। কিছু কিছু সংস্কার রাজনৈতিকভাবে করতে হয় এবং সেইভাবে এগোনো উচিত। তাই এই ‘স্টেক হোল্ডারদের’ সাথে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে অবদান রাখার জন্য কাজ করা বড় প্রয়োজন। অন্যের উপদেশ নেয়া ভাল তবে সেই উপদেশ কতটুকু প্রয়োজন, উপকারী এবং বাস্তবায়নযোগ্য সেটা অবশ্যই ভেবে দেখবেন। মাঝে মাঝে চোখে চোখ রেখে নির্ভীকভাবে ‘না’ বলা বড় বেশি দরকার।
যেহেতু আপনি দায়িত্ব দিয়ে সবাইকে বিশ্বাস করতে পারবেন না আবার আপনাকে সকলকে নিয়েই কাজ করতে হবে তাই আপনাকে ‘আইন’ প্রয়োগে খলিফা ওমরের মত খড়্গ হস্ত থাকতে হবে। ‘Say No to Fascist supporters; Say no to criminals. Say no to illegal interest holders; just Do or Die Method’. মাঝে মাঝে গর্জন দিতে হয় সিংহের মত। যেন অপরাধী ঘাবড়ে যায়। কার্যকর হুংকারের প্রয়োজন আছে। প্রয়োজন আছে নীরবে পদক্ষেপ নেয়ার।
মহাত্মন, আপনি এমন কিছু করে যান, যেন এই দেশের মানুষ আপনাকে শ্রদ্ধাভরে চিরকাল স্মরণ করে। যারা দেশের জন্য কাজ করবে না তাদের মুক্তি দিন, বিপ্লবোত্তর দেশের কাজে অংশগ্রহণের জন্য বিপ্লবী মনোভাবের সৎ, নৈতিক, সাহসী এবং দেশপ্রমিকদের সম্পৃক্ত করুন। এখনও আমাদের সমাজে সৎ, নৈতিক এবং তেজি মানুষের বসবাস আছে; শুধু তাদের খুঁজে বের করে কাজে লাগানো প্রয়োজন।
আমার খোলা চিঠি শেষ করছি প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘হীরক রাজার দেশ’ ছবির বিষয়টি উল্লেখ করে। এই ছবিটি দেখেননি এমন কোনো ছবি প্রেমিক পাওয়া দুষ্কর। কাহিনী সবারই জানা তবুও আমার লেখার পরিপূর্ণতার জন্য উল্লেখ করছি।
হীরক রাজা তোষামোদকারীদের নিয়ে রাজ্য পরিচালনা করত। ভিন্নমত পছন্দ করত না। প্রজারা খাজনা দিতে না পারলে তাদের ওপর অত্যাচার করত। একই সাথে হীরক রাজা প্রজাদের ‘মগজ ধোলাই’ করত ‘যন্তর-মন্তর’ ঘরে। প্রজাদের ‘যন্তর-মন্তর’ ঘরে পুরে রাজার গুণগান গাওয়া কোনো মন্ত্র দিয়ে তাদের মগজ ধোলাই করে ছেড়ে দেওয়া হত যেন সারা জীবন তারা রাজার সব অত্যাচার-অনাচার ভুলে গিয়ে কেবল তার গুণগান করে বেড়ায়। এমনকি সত্যবাদী স্পষ্টবক্তা মানুষদের মগজ ধোলাই করে, তার বিচার করার ক্ষমতা নষ্ট করে, শুধু ভুল তথ্য দিয়ে নিজের গুণগান গাইবার জন্য তাদের বাঁচিয়ে রাখত। এমনই পরিস্থিতিতে একজন উদয়ন মাস্টারের নেতৃত্বে হীরক রাজার পতন ঘটে।
মাননীয় উপদেষ্টা, গত ১৬ বছরে আমাদের দেশেও ফ্যাসিস্ট সরকার হীরক রাজার মত এমন এক ব্যবস্থা এবং চেতনা এই দেশের মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, দেশে এমন কোনো স্তর নেই যেখানে তার গুণগান এবং পূজা করার লোক নেই। বিপ্লবের মাধ্যমে আমরা ফ্যাসিস্টকে হটিয়েছি- দেশ গঠনের পাশাপাশি এখন দরকার পরিশুদ্ধি অভিযান। কিন্তু ‘মগজ ধোলাই’ হওয়া মানুষগুলি এখনও সমাজের সর্বস্তরে বিরাজমান। আমাদের এই পরিস্থিতি থেকে দ্রুত বের হতে হবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার মাধ্যমে; আর সে চিকিৎসা হল বিপ্লবের চেতনায় নতুন ধারা সৃষ্টি করে এই সব মগজধোলাই হয়ে যাওয়া মানুষ গুলিকে পরিপূর্ণভাবে আজীবন নিষ্ক্রিয় করে দেয়া।
দেশ পরিচালনায় স্রষ্টা আপনাকে আরও বেশি শক্তিশালী করুন এই কামনা করছি। ইতি-এক নগণ্য নাগরিক। ২৪.২.২৫
লেখক : সাবেক সামরিক কর্মকর্তা।
এইচআর/এএসএম