মতামত

ব্যাংক খাত পুনরুদ্ধার জরুরি

বর্তমানে দেশের আর্থিক খাত চরম সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এ সংকট সৃষ্টি করেছে বিগত সরকার এর পৃষ্টপোষকতায় থাকা কিছু ব্যবসায়ী। সংকট গভীর হচ্ছে। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে দেশের আর্থিক খাত। মূলধনের অপর্যাপ্ততা, তারল্য সংকট, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, সুশাসনের অভাব, খেলাপি ঋণ, গ্রাহকের আস্থা নষ্ট হওয়ার মধ্যে দিয়ে সময় পার করছে আর্থিক খাত। ব্যাংক ব্যবস্থা হলো অর্থনীতির হৃৎপিন্ড। ব্যাংক ব্যবস্থা সচল না থাকলে পুরো অর্থনীতির চাকা মুহূর্তের মধ্যে থেমে যাবে। এখন অর্থনীতির চাকা খুবই ধীরে ধীরে ঘুরছে। তার কারণ হলো ব্যাংক খাতের অস্থিরতা এবং স্থবিরতা। ২০০৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ব্যাংক খাতে ২৪টি বড় বড় ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে ৯২ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয় । বাংলাদেশ ব্যাংক এর তথ্য মতে, ২০০৯ সালে খেলাপী ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার কেটি টাকা যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। রাষ্ট্রায়াত্ত্ব ব্যাংকের খেলাপী ঋণের হার এখন ৪০ দশমিক ৩৫ শতাংশ। অন্যদিকে বেসরকারী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। তবে এখন পুনঃতফসিল করা ঋণ, আদালতের আদেশে স্থগিত করা ঋণ মিলিয়ে খেলাপি ঋণ প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের বৃদ্ধির ফলে ব্যাংক খাতের প্রভিশন ঘাটতি বেড়েই চলেছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৫ হাজার কোটি টাকার প্রভিশনিং ঘাটতি রেকর্ড করা হয়েছে। প্রভিশন ঘাটতি থাকলে ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতির ঝুঁকিতে পড়ে যায়। ব্যাংকগুলো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না। ব্যাসেল নীতি -৩ অনুযায়ী, মূলধন পর্যাপ্ততার দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিন্মে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। বিশ্বখ্যাত ক্রেডিট রেটিং কোম্পানি ২০২৩ এর গবেষণা রিপোর্টে বলেছে যে, বাংলাদেশকে দুর্বলতম ব্যাংকিং ব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে খেলাপি ঋণের হার বেশি ( ১৫ শতাংশ)। বিশ্বব্যাংক আরো বলেছে যে, বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশের আর্থিক খাত ক্রমশ দুর্বল হয়েছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো বিগত সরকারের পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত। ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা শিথিল করা হয়। ২০১৯ সালে মাত্র ২ শতাংশ অর্থ দিয়ে ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হয়। এক সময় ঋণগ্রহীতা ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ দিয়ে ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ পেত। উল্লেখ্য খেলাপি ঋণ পরিশোধের জন্য এক সময় দুই বছর সময় দেওয়া হতো। বিগত সরকার সময় খেলাপি ঋণ পরিশোধের জন্য পাঁচ থেকে আট বছর সময় বাড়িয়ে দেয়।

Advertisement

মূলধন ঘাটটিতে পড়ে গেছে প্রায় ১৫টি ব্যাংক। বর্তমানে ৯টি ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতি ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি । সম্প্রতি, “ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে করণীয়” শীর্ষক আলোচনায় উঠে এসেছে অনেক বিষয়। আলোচনায় বলা হয় যে, বিগত ১৫ বছর ধরে যে সব গভর্নর ছিলেন তারা যে নীতিমালা গ্রহণ করেছেন সেগুলো ব্যাংকিং নর্মসের সাথে সাংঘর্ষিক। এসব নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছিল বিশেষ ব্যক্তির স্বার্থে। গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার যোগদানের পর থেকে ঋণ খেলাপিদের স্বার্থে নতুন নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করা শুরু করে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গণমাধ্যম স্বাধীনতা (প্রেস ফ্রিডম) খর্ব করে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এর ফলে ব্যাংক খাতে বাড়তে থাকে সীমাহীন দুর্নীতি। এছাড়াও, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল এর মাধ্যমে ডলার ধার দিয়েছে প্রভাবশালী কিছু ব্যবসায়ীদের। ডলারে ঋণও খেলাপি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নথিতে দেখা গেছে, ২০ গ্রাহকের কাছেই আটকে আছে প্রায় সাত কোটি ডলার। দুঃখজনক যে, ব্যাংক খাত থেকে লুন্ঠিত অর্থ পাচার হয়ে গেছে। গত দেড় দশকে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ১৪ হাজার ৯২০ কোটি বা ১৮৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।

আমি প্রথমে বলবো ব্যাংক খাতকে গভীর সংকটে ফেলার জন্য দায়ী হলো নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং অর্থমন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। মূলত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কর্তৃক জারীকৃত নির্দেশনা মেনে চলতো ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক- বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিদ্যমান ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ অনুযায়ী, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে যে কোনো নির্দেশনা দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ। দুঃখজনক যে, বিগত ১৫ বছরে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এর ইউনিট অফিস হিসেবে কাজ করেছে। পূর্ণ স্বাধীনতার সাথে কাজ করতে ব্যর্থ হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর খেসারত এখন দিতে হচ্ছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথমে নজর দেয় আর্থিক খাতের দিকে। সুশাসন ফিরিয়ে আনার জন্য বহুল আলোচিত ১১ ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। পর্ষদ ভেঙে দেওয়া ব্যাংকগুলোতে বাড়তে থাকে তারল্য সংকট। গ্রাহকরা সবাই একসাথে চলে আসে তাদের টাকা উত্তোলন করার জন্য। গ্রাকদের দুর্দশা দেখে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্যারান্টর হয়ে ভালো অবস্থানে থাকা ব্যাংকগুলো থেকে টাকার ব্যবস্থা করে দেয় দুর্বল ব্যাংকগুলোকে। বাংলাদেশ ব্যাংক গ্যারান্টর হয়ে এ পর্যন্ত ৭ হাজার কোটি টাকার সহায়তা করে। উল্লেখ্য, বিগত সরকারের আমলে এ ব্যাংকগুলোতে টাকা ছাপিয়ে নিয়মিত সহায়তা দেওয়া হতো। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য টাকা ছাপিয়ে সহায়তা বন্ধ রেখেছে। এখন সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি। খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও বেশি। অর্থনীতির বৃহৎ স্বার্থে প্রধান উপদেষ্টা দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা এবং গভর্নর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে। ব্যাংক খাত সংস্কারে জন্য ব্যাংকিং টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। টাস্কফোর্স মূলত তিনটি কাজ প্রথমে করবে- (১) ব্যাংকগুলোর ক্ষতিগ্রস্ত সম্পদ নির্ণয় করবে (২) ব্যাংকগুলোর সম্পদ চিহ্নিত করবে (৩) ব্যাংকগুলোর সম্পদ পুনরুদ্ধার করবে।

Advertisement

ইতোমধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছুটা নমনীয় হয়েছে। গ্রাহকদের স্বার্থে নমনীয় হতে হয়েছে। কারণ গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইনগত দায়িত্ব। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে ছয় দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দিতে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতির কথা মাথায় রেখে এতদিন টাকা ছাপানোর সিদ্ধান্ত স্থগিত ছিল। এখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। কারণ, ডিসেম্বর পর্যন্ত যে পরিমাণ রিজার্ভ মুদ্রা থাকার কথা তার চেয়ে কম আছে। ঋণ কর্মসূচির শর্ত হিসেবে মুদ্রা বাজারে থাকা তারল্যের সীমা বেঁধে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ( আইএমএফ)। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, আইএমএফ এর বেঁধে দেওয়া রিজার্ভ মুদ্রার সীমা ছিল ৪ লাখ ১৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এ সময়ে প্রকৃত রিজার্ভ মুদ্রার পরিমাণ হলো ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ, সর্বোচ্চ সীমার তুলনায় রিজার্ভ মুদ্রা কম আছে ৬০ হাজার ৮১১ কোটি টাকা । রিজার্ভ মুদ্রা মুদ্রা বাজারে প্রয়োজনের তুলনায় কম থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ইস্যুকৃত নোট ও বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা থাকা ব্যাংকগুলোর নগদ অর্থ হলো রিজার্ভ মুদ্রা। বাজারে টাকা উদ্বৃত্ত হলে সেটা বাংলাদেশ ব্যাংক বন্ড ছেড়ে টাকা উঠিয়ে নেবে। অর্থাৎ ভারসাম্য নীতি গ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকার যোগান নিয়ন্ত্রণ করবে। এতে মূল্যস্ফীতির উপর চাপ বাড়বে না। যদি বাংলাদেশ ব্যাংক ভারসাম্য নীতি অবলম্বন করে ব্যাংক খাতকে পুনরুদ্ধার করতে পারে , এটা হবে অর্থনীতির জন্য অতীব কল্যাণকর।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর সদস্য।

এইচআর/এএসএম

Advertisement