মতামত

যে মিছিল বারবার থেমে যায়

একাত্তর আমাদের জাতীয় জীবনে বাঁক পরিবর্তনের গর্বিত অধ্যায়, যে অধ্যায়ের প্রেক্ষাপট রচিত হয় দীর্ঘ সময়ের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায়। অনেকগুলো অঙ্গীকার ধারণ করেই একাত্তরের মহান অধ্যায় । এর মধ্যে অন্যতম ছিল মুক্তি ও সমাজ বিনির্মাণ। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করলেও আজ পর্যন্ত এই দুটির কোনোটিরই সফলতা সর্বজনের ক্ষেত্রে অর্জিত হয়নি। আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ওই মুক্তি এখনো বহুদূর তা অনস্বীকার্য। মানুষের অধিকারের মাঠ আজও সমতল, উপরুন্ত তা যেন আরও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে ক্রমাগত। একাত্তরে সাম্য প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে তা ক্রমেই ফিকে হতে থাকলো। বৈষম্য আরও গভীর হলো যা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত।

Advertisement

বৈষম্য, নিপীড়ন ও শ্রেণিস্বার্থভিত্তিক ব্যবস্থা থেকে পৃথিবীব্যাপী মুক্তির লড়াই মানুষের নতুন নয়, বরং দীর্ঘকালের। বিভিন্ন পর্বে এর সুদূরপ্রসারী সাফল্য আছে বটে কিন্তু এও তো সত্য, আছে পশ্চাদপসরণও। এই যাত্রা সরলরৈখিক নয়, অনেক আঁকাবাঁকা। মানুষ যদি রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, রাষ্ট্র যদি কর্তৃত্বমুখী হয়, আমলাতন্ত্র দিয়ে যদি রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্র পরিচালিত হয়, তাহলে সেখানে গণমুক্তির বিরুদ্ধ শক্তির বিকাশ ঘটতে বাধ্য। রাজনীতি ও সমাজে যথাযথ মতাদর্শিক ও সাংস্কৃতিক লড়াই দুর্বল হয়ে যাওয়াও খুব স্বাভাবিক। এর নজির আমাদের সামনে আছেও এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে তা-ই হয়েছে। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে আন্দোলন-সংগ্রামে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ অবশ্যই স্মরণযোগ্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে রাজনৈতিক মেরুকরণের রাজনীতিকদের বহুমাত্রিক স্বার্থবাদী সমীকরণে সাধারণ মানুষ ছিটকে পড়েছে। মহল কিংবা ব্যক্তি বিশেষের হীনস্বার্থ চরিতার্থকরণের অশুভ প্রতিযোগিতার নানামাত্রিক বিরূপ প্রভাব গণমানুষের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে অহিতকর।

মুক্তির লক্ষ্যে কিংবা অধিকারের সমতল মাঠ নিশ্চিত করতে কিংবা সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য ৫৩ বছরের এই বাংলাদেশেও (আগের অধ্যায়গুলো বাদ দিলেও ) আন্দোলন-সংগ্রাম কম হয়নি। রাজপথে মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে কিন্তু অনেক মিছিলই গন্তব্য পৌঁছতে পারেনি , এক পর্যায়ে থেমে গেছে। এর জন্য যে রাজনৈতিক স্বচ্ছতা-দায়বদ্ধতা-জবাবদিহি দরকার , খুব দরকার ; এর ব্যাপক ঘাটতিও ফিরে ফিরে দৃশ্যমান হয়েছে।

আমাদের ভাঙাচোরা ভাবমূর্তি যে মেরামতে উজ্জ্বল হবে- এই প্রত্যাশা বাদ দিয়ে এটা ভেঙে ফেলে নতুন ভাবমূর্তি গড়ায় মনোনিবেশ করা জরুরি। ভেতর থেকে নতুন ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে হবে। তবে সেটি এমনি এমনি ঘটবে না। এর জন্য রাষ্ট্র ও সমাজে মৌলিক পরিবর্তন আনা জরুরি। এই অমানবিক সমাজকে বদলাতে হলে দেশপ্রেমিক মানুষদের কার্যকর ঐক্য চাই।

Advertisement

মিছিলকারীরা থেমে গেছেন , আবার মিছিলে শরিক হয়েছেন কিন্তু ফের দেখা গেছে একই দৃশ্য। এই ব্যর্থতার দায় কার জটিল এ প্রশ্নের উত্তর কঠিন নয় । সর্বপ্রথম এর জন্য রাজনীতির নীতিনির্ধারকরা দায়ী। রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনেকের মধ্যেই কখনও কখনও নেতিবাচকতার উৎকট অপচ্ছায়া পরিলক্ষিত হয়েছে।

অনেকেই বলেন, জনগণ সচেতন নয় বিধায় এমনটি ঘটেছে। জনগণের উপর দায় চাপানোর আগে ভাবা বাঞ্ছনীয় তারা আশা কিংবা বিশ্বাস করে কীভাবে ঠকেছে। যদি ঘটনাবলীর উৎসে নজর দেওয়া যায় তাহলে বহু ক্ষেত্রেই এমন অনেক নজির স্পষ্ট হয়ে উঠে। বাংলাদেশকে যারা সোনার বাংলা বানাবেন বলে বহু হম্বিতম্বি করেছেন তাদের অনেকেই নিজেরা সোনাদার হয়েছেন সিংহভাগ মানুষকে বৈষম্যের গাঢ় ছায়ায় ঢেকে দিয়ে। বেশিরভাগ মানুষই এখন দেনাদার, বিশ্বব্যাংক থেকে শুরু করে ঋণদাতা বিভিন্ন ধরনের মহাজনের কাছে। যে উন্নতি প্রাণঘাতী হয়ে পড়েছে এটা না বুঝলে অবস্থারও উন্নতি দুরাশারই নামান্তর। স্বাধীন বাংলাদেশেই তো ক্ষমতার রাজকীয় প্রদর্শনের কত দুঃসহ উদাহরণই আছে। রাজতন্ত্রের ইতিহাস নানাভাবেই রক্তরঞ্জিত ও কলঙ্কিত। অত্যাচারটা যে শুধু ভেতর থেকেই ঘটে তাই নয় , বাইরে থেকেও আসতে পারে এবং আসেও। যেমনটা ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের ' মুক্তধারা ' নাটকের শিবতরাইয়ের মানুষদের ক্ষেত্রে। ক্ষমতা সর্বদাই চায় আত্মপ্রকাশ করতে এবং শাসন করতে চায় জয় দেখিয়ে নয় , ভয় দেখিয়ে। এই অবস্থায় মানুষের মুক্তির পথ মসৃণ তো নয়ই, আরও বেশি অমসৃণ হয়ে পরে।

শুরু করেছিলাম মিছিলের প্রসঙ্গ টেনে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় মিছিল কিংবা অহিংস আন্দোলন-সংগ্রাম অসিদ্ধ নয়। কিন্তু যে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংজ্ঞা-সূত্রে মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামের অধিকার স্বীকৃত হলেও সেই রাজনৈতিক ব্যবস্থাটা কতটা প্রশ্নমুক্ত? এ প্রশ্নের উত্তর প্রীতিকর নয়। এ অবস্থায় কোনো মিছিলই গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া সহজ তো নয়ই, বরং দুরূহ। এ জন্যই মুক্তির মিছিল কিংবা অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার মিছিল এ পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। ভবিষ্যতে কতটা সফল হবে তা ভবিতব্য। অসত্য নয় যে , প্রতিমুহূর্তে মানুষের চিন্তা ও সক্রিয়তায় লড়াইয়ে নতুন শক্তি যোগ হচ্ছে। এর মধ্য দিয়েই ভবিষ্যতের মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজের জমিন তৈরি হচ্ছে এবং এই পথে যাত্রার পদরেখা অঙ্কিত হচ্ছে। মুক্তিকামী মানুষের এই প্রত্যাশা জারি আছে এবং থাকবেও যে , বৈষম্য থাকবে না ও মানুষ পারবে নিজের মনুষ্যত্বকে রক্ষা করতে। তেমন ব্যবস্থার স্বপ্ন অনেকের প্রাণের ভেতর আছে হয়তো , কিন্তু তাকে বাস্তবিক করে তোলার চেষ্টাটা তেমন ভাবে হচ্ছে না যেমন ভাবে হওয়া দরকার। রবীন্দ্রনাথের ওই সতর্কবাণীটি যেন আমরা না ভুলি- ' অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে / তবে ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।'

যে কোনো দেশে যৌবন কিংবা তারুণ্য বড় সম্পদ। মুক্তির লক্ষ্যে আমাদের যত লড়াই-সংগ্রাম হয়েছে প্রত্যেকটিতে যৌবনের কিংবা তারুণ্যের অংশগ্রহণ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। রাষ্ট্র কি যৌবন কিংবা তারুণ্যের শক্তি যথাযথভাবে কাজে লাগাতে চেয়েছে ? রাজনীতির নীতিনির্ধারকরা কি তাদের সৃজনী শক্তির মূল্য দিয়েছেন। নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে অথবা মিছিলের সারি দীর্ঘ করতে তাদের কদর করেছেন , কিন্তু এরপরের উদাহরণ অনেক ক্ষেত্রেই বড় বেশি কদর্য । জীবনের গলিতে যৌবনের ক্ষয় নিশ্চয় আমাদের জন্য কোনো সুখকর বার্তা নয়। যৌবন অথবা তারুণ্যের সামনে এমন কি স্বপ্ন আছে যে স্বপ্ন তাকে মুক্তির ও অধিকারের সাম্য প্রতিষ্ঠার মিছিলটিকে অবিচল রাখবে রাখবে ? স্বপ্ন তো জরুরি, খুব জরুরি; দুঃস্বপ্নের গ্রাস থেকে মুক্ত থাকতে। প্রায় সব কিছুই এখন পণ্য হিসাবে বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। টাকা ফেললেই হলো। খুনি থাকে শুরু করে ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পর্যন্ত প্রায় সব কিছুই যেন কেনাবেচার ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।

Advertisement

আমাদের ভাঙাচোরা ভাবমূর্তি যে মেরামতে উজ্জ্বল হবে- এই প্রত্যাশা বাদ দিয়ে এটা ভেঙে ফেলে নতুন ভাবমূর্তি গড়ায় মনোনিবেশ করা জরুরি। ভেতর থেকে নতুন ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে হবে। তবে সেটি এমনি এমনি ঘটবে না। এর জন্য রাষ্ট্র ও সমাজে মৌলিক পরিবর্তন আনা জরুরি। এই অমানবিক সমাজকে বদলাতে হলে দেশপ্রেমিক মানুষদের কার্যকর ঐক্য চাই। তারা সংঘবদ্ধ হবেন এবং মিছিলকে গন্তব্যে নিয়ে যাবেন। সমাজ পরিবর্তনের কাজটা রাজনৈতিক,সামাজিক ও সাংস্কৃতিক। আমাদের যে রাজনীতি প্রয়োজন, সেটা প্রচলিত রাজনীতির সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সবকিছু মিলিয়ে গোটা ব্যবস্থা মানুষের কল্যাণে নিশ্চিত করা চাই।

ইতিহাসবিদ হোয়ারড বলেছেন, ‘গুরুতর সমস্যাগুলো ধীরেসুস্থে সমাধানের জন্য ফেলে রাখা ঠিক হবে না। বর্তমান সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করতে হবে এবং ইতিহাস থেকে আমরা জেনেছি যে, এ ক্ষেত্রে আন্দোলন অনেকাংশেই কাজ করে। তবে সেই আন্দোলন হতে হবে গঠনমূলক ও সমাজের মূল সমস্যাগুলোকে ধারণ করে সর্বজনকে প্রাধান্য দিয়ে।’ সমাজ প্রতিনিধি কিংবা রাজনীতিকরা যেন এগুলো স্মরণে রাখেন। তা হলেই মুক্তি বা অধিকার প্রতিষ্ঠার মিছিল গন্তব্যের দিকে এগোতে পারবে।

লেখক : সাংবাদিক, কবি ও গল্পকার ।

এইচআর/এএসএম