ভ্যাট ও শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাব যথার্থভাবে মূল্যায়ন না করায় সরকারের কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় হবে না। বরং এতে ভোগ কমে যাবে, ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে ও মূল্যস্ফীতি বাড়বে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়বে। জীবন চালানো কঠিন হয়ে পড়বে।
Advertisement
বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) ‘ভোক্তার কাঁধে বাড়তি করের বোঝা: উত্তরণে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এমন অভিমত দেন বক্তারা।
আরও পড়ুন কর-ভ্যাটের হার যুক্তিযুক্ত করা হলে দেশ সুন্দরভাবে চলবে ভুল সময়ে ভুল সিদ্ধান্ত, পরিণতি ভালো হবে না ভ্যাট বৈষম্য দূর করলে সরকারের টাকার অভাব হবে নাএতে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, বছরে কোটি টাকা আয় করেন এমন ৬৭ শতাংশ মানুষ করজালের বাইরে রয়েছে। দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের আয় কোটি টাকার বেশি হলেও তারা করজালে নেই। এমন ফাঁপা করজাল বা ক্ষুদ্র করজাল দিয়ে কর-জিডিপির অনুপাত বাড়ানো যাবে না।
ভ্যাটের রেট না বাড়িয়ে নেট বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়ে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, যারা ট্যাক্স জালের বাইরে তাদের ট্যাক্সের মধ্যে আনতে হবে। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ দরকার। এই সরকার দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের ভিত্তি যেন করে যায়। দেশে আয়বৈষম্য বাড়ছে। সরকারকে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গড়লে রাজস্ব অটোমেটিক্যালি আসবে। আগামী বাজেটে নতুন করে ভ্যাট যেন না বাড়ে।
Advertisement
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসে অর্থনীতিতে সফলতা নেই বললেই চলে। দেশের অর্থনীতি অনেকটাই স্থবির হয়ে গেছে। আমরা সফলতা আনতে পারিনি, ফলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বছরের মাঝপথে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়িয়ে ভুল সময়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর পরিণতি আগামী দিনগুলোতে খুব একটা ভালো হবে বলে আমি মনে করি না।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসরুর রিয়াজ বলেন, ভুল সময়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশেও ভ্যাট সিঙ্গেল রেটে আনতে হবে। কিন্তু এটা করার সময় কী এখন? যখন দুই-আড়াই বছর ধরে মূল্যস্ফীতির অভিঘাত সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে চেপে ধরেছে। ব্যবসায়ীদেরও তাই। এই সময়ে এটা করা ঠিক হয়নি।
মাসরুর রিয়াজ বলেন, করহার পরিবর্তন করতে চাইলে যৌক্তিক রোডম্যাপ দিতে হয়। ব্যবসায়ী ও ভোক্তাকে তৈরি হতে হয়। এটা এখানে হয়নি। উল্টো বছরের মাঝখানে এটা বাড়ানো হয়েছে। ভ্যাটের হার একসময় বাড়াতে হতো। কিন্তু এই সময়ে আইএমএফের চাপে বাড়াতে হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, সরকার ট্রাকসেল বন্ধ করে দিয়েছে। বাজেটের ঘাটতি হবে, এজন্য সামাজিক সুরক্ষার বাজেট তারা দিতে পারবে না। তার মানে রিয়েল ইনকাম ফল করছে। সবাই বলছে আপনি নির্বাচিত সরকার না। সুতরাং আপনি চলে যান, নির্বাচিত সরকারকে (ক্ষমতা) দিয়ে যান। আপনার তো ত্যাগ করারও রাইট নেই, কারণ আপনি তো নির্বাচিত নন। কোনো মৌলিক নীতি নেওয়ার সঠিকতা আপনার নেই। কারণ আপনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। রাজনৈতিক অর্থনীতি ঠিক না হলে অ্যাসেসমেন্ট অব ইমপ্যাক্ট হবে না।
Advertisement
এনবিআরের সাবেক সদস্য (মূসক) রেজাউল হাসান বলেন, আগে মানুষ ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে চাইত না। এখন সেই অবস্থা নেই। মানুষ ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে চায়। এটা ধীরে ধীরে বাড়বে। কিন্তু যে পর্যায়ে যাওয়ার কথা ছিল, সেই পর্যায়ে যায়নি। অর্থাৎ, ভ্যাটের একটা রেট হবে, সেটা ব্যবসাবান্ধব হবে। এই জায়গায় আমরা পৌঁছাতে পারিনি।
কর-ভ্যাটের হার যুক্তিযুক্ত করা হলে দেশ সুন্দরভাবে চলবে বলে মন্তব্য করেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সিইও আহসান খান চৌধুরী। তিনি বলেন, দেশকে এগিয়ে নিতে কর্মসংস্থান ও রাজস্ব বাড়াতে ব্যবসায়ীদের দরকার আছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ বাড়াতে হবে। অনানুষ্ঠানিকভাবে কর না বাড়িয়ে যেভাবে চলছে চলতে দিন। কনসালটেশন শুরু করুন। আমরা এনবিআরের সঙ্গে আরও বেশি আলোচনা করতে চাই। কীভাবে করজাল বাড়ানো যায় সেটা নিয়ে আমরা কাজ করবো।
বিকেএমই’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গণমাধ্যম থেকে শুনেছিলাম প্রতি রাতে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেড় কোটি টাকা চাঁদা পেতেন। এখন তো পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু চাঁদাবাজির কি পরিবর্তন হয়েছে? এখনো যাত্রাবাড়ীসহ অন্য বাজারে চাঁদাবাজি হচ্ছে, কারা করছে, এটা বন্ধ করতে হবে। এটা বন্ধ না হলে মূল্যস্ফীতি কমবে না, কারণ পণ্যের দাম বাড়তি থাকবে।
বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সভাপতি এম এ হাশেম বলেন, কর বৃদ্ধির কারণে ভোক্তাকেও বেশি দামে খাবার কিনতে হবে। কম দামে বিস্কুট, কেকসহ প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য মিলবে না। কৃষকের মতো সাধারণ মানুষও ভুগবে। সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন দেশের শ্রমজীবী, প্রান্তিক কৃষক ও নিম্ন আয়ের মানুষ। সরকারকে এটা চিন্তা করতে হবে।
বাংলাদেশ অটো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, আমরা একমাস ধরে আন্দোলন করছি ভ্যাট কমানোর জন্য। এখনো মাঠে আছি। আশা করেছিলাম ড. ইউনূস সরকার এসে আমাদের বিষয়টা দেখবেন, কিন্তু সে আশাও ফিকে হয়ে যাচ্ছে। খাদ্যপণ্য ভ্যাটমুক্ত থাকা দরকার। অথচ উন্নত দেশ ইংল্যান্ডে খাদ্যপণ্য ভ্যাটমুক্ত।
দেশের সামান্য কিছু উদ্যোক্তা নিয়মিত কর দিচ্ছেন, আর তাদের ওপর চাপ আরও বেড়ে চলেছে বলে মন্তব্য করেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি এবং রিভারস্টোন ক্যাপিটাল লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আশরাফ আহমেদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দেড় কোটি। আর ভ্যাট রেজিস্টার (নিবন্ধন) প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা পাঁচ লাখ। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ৪০ হাজার প্রতিষ্ঠানও ঠিকমতো ভ্যাট দিচ্ছে না। শুধু চার-পাঁচ হাজার প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট এক/দেড়শ কোটি টাকার উপরে।
রমজান মাসে পণ্যের দাম না বাড়াতে ব্যবসায়ীদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে ক্যাবের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, উল্লেখযোগ্য যেসব ভোগ্যপণ্যে শুল্ক-কর বেড়েছে, সেগুলোর অনেকগুলো রমজানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। আমরা সব সময় এগুলোতে ভ্যাট বাড়ানোর বিরোধিতা করেছি। আপনাদের (ব্যবসায়ীদের) প্রতিও আমাদের অনুরোধ, রমজানে যেন এসব পণ্যের সংকট না হয়, দাম যেন না বাড়ে। আপনারা ভোক্তার স্বার্থের বিষয়টি চিন্তা করবেন। তারা যেন এ মাসে স্বস্তিতে থাকতে পারে।
এসিআই ফুডস অ্যান্ড কমোডিটি ব্র্যান্ডসের চিফ বিজনেস অফিসার (সিবিও) ফারিয়া ইয়াসমিন বলেন, বর্তমান সরকার যে হারে ভ্যাট বাড়িয়েছে তাতে বিস্কুট, কেক, জুসের মতো বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে দেশের পুষ্টি নিরাপত্তায়। বিশেষ করে শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করা কঠিন হবে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন এসএমসি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফ উদ্দিন নাসির, বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল ও রাজীব চৌধুরী, ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সভাপতি দৌলত আকতার মালা ও সাবেক ব্যাংকার সাইফুল হোসেন।
জাগো নিউজের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কে এম জিয়াউল হকের পরিচালনায় গোলটেবিল আলোচনা সঞ্চালনা করেন প্রতিষ্ঠানটির চিফ রিপোর্টার ইব্রাহীম হুসাইন অভি।
আরও পড়ুন পরিবহন-বাজারে চাঁদাবাজি বন্ধ হলে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে ভ্যাট-ট্যাক্সের জাঁতাকলে বিস্কুটের প্যাকেট আর কত ছোট হবে বর্ধিত ভ্যাট-শুল্কে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কৃষকরাএসএম/এএসএ/এমএমএআর/জিকেএস