‘তেলেসমাতি’ শব্দটার ভেতরেই ‘তেল’ আছে। বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে (২০১২) ‘তেলেসমাতি’ শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে ঐন্দ্রজালিক বা জাদুসম্বন্ধীয়। উদাহরণ হিসেবে ব্র্যাকেটে লেখা হয়েছে ‘তেলেসমাতি কারবার’। তার মানে তেলেসমাতির সঙ্গে কারবার বা ব্যবসার একটা সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে যে ধরনের তেলেসমাতি কারবার করেন—সেটি সারা বিশ্বেই বিরল।
Advertisement
গত শনিবারই জাগো নিউজের একটি খবরের শিরোনাম: ‘চাল-চা-আটা ছাড়া মিলছে না সয়াবিন তেল।’ খবরে বলা হয়, রোজার আগে এবারও বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশিতে বিক্রি করা হচ্ছে সয়াবিন তেল। আবার সেই তেল কিনতে সঙ্গে নির্ধারিত অন্য পণ্যও নেওয়া করা হয়েছে বাধ্যতামূলক।
কয়েকটি বাজার ঘুরে এসে রিপোর্টার লিখেছেন, প্রায় সব কোম্পানিই ডিলারদের শর্ত দিয়েছে, তেলের সঙ্গে স্লো আইটেম নিতে হবে। কোম্পানিভেদে প্রত্যেকের অন্য প্রোডাক্ট চাল, চা-পাতা, সরিষার তেল, মুড়ি, পানি রয়েছে। তাদের কাছ থেকে তেল নিতে হলে এসব স্লো আইটেম নিতে হচ্ছে।
প্রশ্ন হলো, যার চাল, চা-পাতা, সরিষার তেল বা পানি প্রয়োজন নেই, সেক্ষেত্রে তিনি সয়াবিন তেল কিনতে পারবেন না? বাংলাদেশের কতজন মানুষ মুদি দোকানে সয়াবিন তেল কিনতে গিয়ে বোতলজাত পানি কেনে? কতজন মানুষ বোতলজাত পানি পান করে? সয়াবিন তেল কিনতে হবে বলে এখন তার সঙ্গে বোতলের পানি কিনতে হবে—এমন অদ্ভুত বাজারব্যবস্থা পৃথিবীর কোন দেশে আছে? অর্থনীতির ভাষায় এই ঘটনাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে?
Advertisement
তেল নিয়ে, বিশেষ করে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ রান্নার কাজে যে সয়াবিন তেল সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে, সেই তেল নিয়ে তেলেসমাতির খবর প্রায়শই গণমাধ্যমের শিরোনাম হয় এবং তার প্রতিটি ঘটনারই যবনিকাপাত ঘটে তেলের দাম বাড়ানোর মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ একেকবার বাজার থেকে তেল হাওয়া হয়ে যায় বা হাওয়া করে দেওয়া হয় এবং তারপর সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গ বৈঠক শেষে তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেন ব্যবসায়ীরা।
সবশেষ গত বছরের ৯ ডিসেম্বর লিটারে ৮ টাকা বাড়ানো হয় সয়াবিন তেলের দাম। এর আগের মাসেই অর্থাৎ নভেম্বরের শুরুতে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে প্রতি লিটার ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকা এবং খোলা সয়াবিন বিক্রি হয় ১৮৫ টাকায়। প্রথম দফায় ১৭ অক্টোবর এবং দ্বিতীয় দফায় ১৯ নভেম্বর শুল্ক-কর কমিয়ে তা নামানো হয় ৫ শতাংশে। এতে বাজারে সামান্য কমে ভোজ্যতেলের দাম। কিন্তু নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে এসে বাজার থেকে তেল উধাও হতে শুরু করে। বিশেষ করে এক ও দুই লিটারের বোতল। অবশেষে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে লিটারে ৮ টাকা দাম বাড়ায় সরকার। আর দাম বাড়ানোর ঘোষণার সাথে সাথে প্রতিটি দোকানে দেখা গেলো তেলের অভাব নেই। তার মানে সবার কাছেই তেল মজুত করা ছিল এবং বাড়তি দামে বিক্রির জন্য কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছিলেন।
রোজার মাস সামনে রেখে আবারও দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারে তেল ছাড়ছে না। ফলে আগের দামে কেনা তেলও এখন লিটারে ২৫ থেকে ৩০ টাকা বেশি দরে বিক্রির খবর গণমাধ্যমে আসছে। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, কোম্পানিগুলো সরকারের পক্ষ থেকে দাম বাড়িয়ে নিলেও বাজারে সরবরাহ বাড়ায়নি। রোজার আগে আরেক দফা দাম বাড়াতে এমন সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। এছাড়া সয়াবিন তেলের সংকট তৈরি শুরুর থেকে রাইস ব্রান তেলেও কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে। বর্তমানেও বাজারের মুদি দোকানে রাইস ব্রান তেল নেই।
ব্যবসায়ীদের কথায় চলবে?
Advertisement
প্রশ্ন হলো, ব্যবসায়ীরা যা চাইবে, যেভাবে চাইবে সরকার সেটি মেনে নেবে? ব্যবসায়ীরা যেসব যুক্তি তুলে ধরবে, সরকার নিঃশর্তভাবে তা মেনে নেবে? কোম্পানিগুলো চাইলেই সরকারকে চাপে ফেলে বা ভোক্তাদের জিম্মি করে দাম বাড়িয়ে নিতে পারবে? এই অভিযোগ বেশ পুরোনো যে, দেশের পুরো বাজার ব্যবস্থাপনা সিন্ডিকেটের দখলে। এখানে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনো সরকারের আমলেই শক্ত কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। বরং বারবারই মনে হয়েছে, সরকার বোধহয় একধরনের আপসকামিতার পথেই হাঁটতে চায়। তারা হয়তো ভাবে বা বিশ্বাস করে যে, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিলে বাজার আরও বেশি অস্থির হয়ে যাবে।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে যেহেতু যে কোনো ফসলের উৎপাদনই ভালো হয়, ফলে পাম ও সয়াবিন তেলের আমদানিনির্ভরতা কমাতে বা শূন্যে নামিয়ে আনতে সয়াবিন, সরিষা, তিল, বাদাম ইত্যাদির আবাদ বাড়াতে হবে। একসময় দেশের বিরাট অংশের জমি ছিল একফসলি। এখন সেসব জমিতেও তিন ফসল হয়। শুধু তাই নয়, এখন খরাসহিষ্ণু, লবণসহিষ্ণু ধানও আবাদ হচ্ছে। এমনকি পানিতেও ভাসমান সবজির বাগানও হচ্ছে। সুতরাং কৃষির এই সাফল্য কাজে লাগিয়ে আমদানিনির্ভর খাদ্যপণ্য অধিক পরিমাণে উৎপাদন করার ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
যদিও কাঁচাবাজারে কোনো সিন্ডিকেট করেও লাভ হয় না। কারণ এগুলো পচনশীল। এখন যেমন শীতের সবজির ভরা মৌসুম। কেউ সিন্ডিকেট করে চাইলেই শিমের কেজি একশ টাকা করতে পারবে না। ফুলকপি বা বাঁধাকপির পিস ৫০ টাকা করতে পারবে না। কারণ বাজারে বাজারে এসব পণ্যের সরবরাহ ব্যাপক। বরং রাজধানীর বড় বাজারগুলোয় দোকানিরা রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে কম দামে সবজি বিক্রি করছেন। কারণ সবজি বেশিদিন সংরক্ষণ করে রাখা বা মজুত করে রাখার সুযোগ নেই। কিন্তু ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে বিষয়টা ভিন্ন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস মজুত করে রাখা যায়। ফলে এখানে সহজেই সিন্ডিকেট কার্যকর হয়। দ্বিতীয়ত, সয়াবিন যেহেতু আমদানিনির্ভর এবং সয়াবিনের বিকল্প তেলও বাজারে খুব সহজলভ্য নয়, ফলে ব্যবসায়ীরা সহজেই সিন্ডিকেট করে, সরকারকে চাপে ফেলে, ভোক্তাদের জিম্মি করে তেলে দাম বাড়াতে পারেন। অস্থিরতা এড়াতে সরকারও তাদের সঙ্গে সেভাবে খুব কঠোর হতে চায় না।
বাংলাদেশের বাজারব্যবস্থা বড়ই অদ্ভুত। এখানে যে কেউ যে কোনো সময় যে কোনো জিনিসের দাম বাড়িয়ে দিতে পারেন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানের ফলে কিছু কিছু জায়গায় দোকানদাররা নাজেহাল ও জরিমানার শিকার হলেও আখেরে পুরো বাজারব্যবস্থায় এর প্রভাব কতটুকু পড়ে—তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
আবার এও ঠিক যে, শুধু অভিযান বা পুলিশিং দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং গণমাধ্যমে কিছু সংবাদ শিরোনাম হয়। সংকট সমাধানে কতটুকু ভূমিকা রাখে—সেটিই বড় প্রশ্ন। তারচেয়েও বড় প্রশ্ন, বাংলাদেশের মানুষ কেন আমদানিনির্ভর সয়াবিন তেলের ওপর এতটা নির্ভরশীল হয়ে গেলো এবং সয়াবিনের বিকল্প উৎসগুলো কেন কমতে থাকলো? এখানে ‘পলিটিক্স অব মার্কেট ইকোনমি’ বা ‘বাজার অর্থনীতির রাজনীতি’র ভূমিকা কতটুকু?
বিকল্প কোথায়?
বাংলাদেশের মানুষ একসময় স্বাস্থ্যকর সরিষার তেলের ওপরই নির্ভরশীল ছিল। এরকম একটি ভালো উৎসের জায়গাটি সয়াবিন ও পাম তেলের মতো অত্যন্ত ক্ষতিকর পণ্যটি কী করে কোটি কোটি মানুষের হেঁশেলে ঢুকে পড়লো? সরিষার বাইরেও বাদামের তেল, ভেরেন্ডার তেল, তিল তেল, সূর্যমুখীর তেল—এসব উত্তম বিকল্পগুলো কেন ধীরে ধীরে হাওয়া গেলো বা সয়াবিনের দাপটে এসব তেলের দাম কেন আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়ে গেলো?
সয়াবিন, সরিষা, সূর্যমুখীসহ কোনো ভোজ্যতেলের কাঁচামালেই বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। একসময় বাংলাদেশের মানুষের প্রধান ভোজ্যতেল ছিল যে সরিষা, সেটির উৎপাদন চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট কম। অথচ রান্নায় সয়াবিনের চেয়ে সরিষার তেল পরিমাণে কম লাগে। এটি সুস্বাদু এবং স্বাস্থ্যসম্মত। সুতরাং, দেশে সরিষার আবাদ এবং সরিষার তেলের উৎপাদন পর্যাপ্ত হলে সয়াবিন বা পামতেল নিয়ে তেলেসমাতি নিয়ন্ত্রণ করা যেত।
বলা হয়, খাদ্যাভাস পরিবর্তনের ফলেও তেলের চাহিদা বেড়েছে। আগে গ্রামের নারীরা এক লিটার তেল দিয়ে মাস চালাতেন। কিন্তু এখন তিনজনের পরিবারেও এক মাসে ৫ লিটার তেল লাগে। আগের রান্না কি এখনকার চেয়ে কম সুস্বাদু ছিল? তার মানে যখনই ভোজ্যতেলের চাহিদা বেড়েছে, অর্থনীতির সহজ সূত্র অনুযায়ী তখনই এর দাম বাড়তে শুরু করেছে। বাড়তে বাড়তে এখন সবচেয়ে কম দামি পাম তেলও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।
পরিশেষে, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে যেহেতু যে কোনো ফসলের উৎপাদনই ভালো হয়, ফলে পাম ও সয়াবিন তেলের আমদানিনির্ভরতা কমাতে বা শূন্যে নামিয়ে আনতে সয়াবিন, সরিষা, তিল, বাদাম ইত্যাদির আবাদ বাড়াতে হবে। একসময় দেশের বিরাট অংশের জমি ছিল একফসলি। এখন সেসব জমিতেও তিন ফসল হয়। শুধু তাই নয়, এখন খরাসহিষ্ণু, লবণসহিষ্ণু ধানও আবাদ হচ্ছে। এমনকি পানিতেও ভাসমান সবজির বাগানও হচ্ছে। সুতরাং কৃষির এই সাফল্য কাজে লাগিয়ে আমদানিনির্ভর খাদ্যপণ্য অধিক পরিমাণে উৎপাদন করার ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। সরিষা, তিল, বাদাম ইত্যাদির আবাদ বাড়ানো দরকার। রান্নায় তেলের ব্যবহার কমিয়ে এর চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। সেই সাথে যে বাজার অর্থনীতির রাজনীতির পাকে পড়ে পুরো ভোজ্যতেলের বাজার একটি বিরাট সিন্ডিকেটের দখলে চলে গেলো, তাদের বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রের নিরাপোস হওয়া দরকার।
লেখক : সাংবাদিক ও লেখক।
এইচআর/জেআইএম/ফারুক