ভ্রমণ

নীলগিরি-নীলাচলের মেঘে যাই মিলেমিশে

ফাতেমাতুজ জোহুরা তানিয়া

Advertisement

সকাল তখন ঠিক ৫টা। শহরের রাস্তাগুলো তখনো ঘুমিয়ে। কুয়াশার চাদরে মোড়া চারপাশ আর হালকা ঠান্ডা বাতাস যেন এক অদ্ভুত রোমাঞ্চের পূর্বাভাস দিচ্ছিল। ভোরের আলো তখনো ঠিকমতো ফোটেনি। জানালার ফাঁক গলে আসা হিমেল বাতাস যেন শহরের অলসতা ভাঙতে চাইছিল। সবার ফোনে বারবার নোটিফিকেশন আসছিল—‘দেরি করিস না, রেডি হয়ে যা!’ তবু তানি আর নিহা ছাড়া কেউ তখনো পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। শহরের কোলাহল থেকে দূরে এক নতুন অভিযানের ডাক আমাদের সবাইকে একত্র করেছিল। গন্তব্য—নীলগিরি আর নীলাচলের স্বপ্নময় সৌন্দর্য।

বন্ধুদের সঙ্গে বান্দরবানের নীলগিরি যাওয়ার পরিকল্পনাটা একেবারে হুট করেই হয়েছিল। নয়নের ছিল ঘোরার পাগলামি আর আনসারের ছিল খোঁজ-খবর নেওয়ার দায়িত্ব। লাহা আর হিমু সব সময় যেমন তেমন, জমিরের ছিল হাসি-ঠাট্টার ভান্ডার। আর সুহানা? আমাদের দলের প্রাণ! গাড়ির ব্যবস্থা করা প্রথম চ্যালেঞ্জ। কয়েকজন মাইক্রোবাস চালকের সঙ্গে কথা বললাম কিন্তু বাজেটের সঙ্গে মিলছিল না। কেউ সাত হাজার, কেউ আট হাজার টাকা চাইছিল। শেষমেশ এক চালক রাজি হলেন ছয় হাজার টাকায়। গাড়িটা টয়োটা নোহা, আটজনের বসার মতো জায়গা ছিল।

শহরের যাত্রা শুরু করতে সকাল থেকেই আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তবে দেরী যেন সবার সঙ্গী হয়ে গিয়েছিল! লাহা ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত, আনসার কিছু না কিছু ভুলে যাচ্ছিল আর নয়ন তো মজা করেই সময় পার করছিল। তবে তানি আর নিহা! ওরা ঠিকই সময়মতো হাজির। তানি বলল, ‘যতই তাড়া দাও, এদের কিছুতেই সময়মতো নিয়ে আসা যাবে না!’ নিহা তখন মজা করে বলল, ‘আমরাই আগে পৌঁছে গেলে কেমন হয়?’ আমরা হাসতে হাসতে ওদের নিয়ে গাড়িতে উঠলাম।

Advertisement

গাড়ি প্রায় আধা পথ পাড়ি দিয়েছে, এমন সময় আনসার হঠাৎ বলল, ‘না রে, আমার তো ক্ষুধা লেগে গেছে। একটু নাস্তা নেওয়া দরকার।’ আমরা সবাই হেসে বললাম, ‘তোর পেট কি চান্দের গাড়ির মতো? থামলেই ক্ষুধা লাগে!’ তবে আনসার তো নাছোড়বান্দা। গাড়ি এক দোকানের সামনে থামতেই সে নেমে পড়ল। আমরা অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হচ্ছি আর নয়ন গান ধরল, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়...’। এবার তানি বলল, ‘নয়ন, গান থামাও। আনসারকে গিয়ে ধরো!’

আনসার যখন ফিরল, তার হাতে একগাদা খাবার। সে হেসে বলল, ‘সবাই ভাগ করে খাও। দেরী করে হলেও তোমাদের জন্য কিছু আনলাম!’ গাড়ি ছুটছে আর আমাদের মেজাজ তুঙ্গে। নয়ন গান ধরেছে, আনসার তার চিরকালের মতো গল্প নিয়ে ব্যস্ত আর আমরা পাহাড়ের রাস্তায় হারিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ লাহা চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘আরে! সুহানা কোথায়?’

সবাই চুপ। কিছুক্ষণ পর তানি বলল, ‘সোহানা তো পটিয়া থেকে ওঠার কথা ছিল, তাই না?’ আমরা মাথা চুলকাতে চুলকাতে বুঝতে পারলাম, আমরা পটিয়া পেরিয়ে চন্দনাইশ চলে এসেছি। সুহানাকে পুরোপুরি ভুলে গেছি! হিমু তখন হেসে বলল, ‘দেখলি? যদি তোর ক্ষুধা না লাগতো আনসার, তবে ঠিক সময়ে সুহানাকে তুলে নিতাম!’ আনসার তার ডাবের পানি ফেলে দিয়ে বলল, ‘সব দোষ আমার, বুঝি। এবার চুপ কর!’

চালক গাড়ি ঘুরিয়ে বলল, ‘আপনাদের বন্ধুরা তো সত্যিই দারুণ! বন্ধুকে ভুলে গিয়ে সামনে চলে গেছেন!’ আমরা তখন সুহানার কথা ভেবে ফোন দিলাম। সুহানা রাগে বলল, ‘আমার পটিয়ায় বসে থেকে পাহাড় দেখার শখ নেই। আমাকে তুলো না, আমি নিজেই আসব!’ আমরা সবাই একসঙ্গে হাসতে লাগলাম। বুঝলাম যে ভ্রমণের মজাটা এমন ভুল-ভ্রান্তি আর বন্ধুত্বের কারণেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। যখন পটিয়ায় সুহানাকে ফেলে আমরা চন্দনাইশ চলে গেলাম। সুহানা ফোন করে রাগে ফেটে পড়ল। ‘তোমরা তো বন্ধুর নামের কলঙ্ক! আমাকে ফেলে রেখে চলে গেছ?’

Advertisement

আমরা দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে পটিয়ার দিকে রওয়ানা দিলাম। গাড়ি থেকে নামতেই সুহানার ভ্রূ কুঁচকে ছিল। কেউ কথা বলার সাহস পাচ্ছিল না। তখন নয়ন হাসিমুখে বলল, ‘আচ্ছা সুহানা, তুমি জানো তুমি আমাদের দলের সবচেয়ে সুন্দর?’ লাহা যোগ দিলো, ‘আরে, তুমিই তো আমাদের দলের প্রাণ!’ আনসার আরও যোগ করল, ‘সোহানা, তুমি না থাকলে আমাদের ভ্রমণই ফিকে হয়ে যেত!’ হিমু বলল, ‘তুমি রেগে গেলে তো পুরো পাহাড়ই কাঁপবে!’

সুহানা একটুও পাত্তা না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে রাখল। আমরা যে একেকজন একেকটা কথা বলছিলাম, তা শুনে সে হেসে ফেলল। বলল, ‘ঠিক আছে, তোমাদের মাফ করলাম। তবে এই কাণ্ড আর যেন না হয়!’ আমরা সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ভ্রমণটা আবার মজার হয়ে উঠল। পথ ধরে এগোতেই হঠাৎ দেখি সামনে ক্যান্টনমেন্টের চেকপোস্ট। গাড়ি থামানো হলো। একজন দায়িত্বশীল সেনা সদস্য এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনাদের কোথায় যাওয়ার প্ল্যান?’ নয়ন মজা করে বলল, ‘ভাই, আমরা পাহাড়ে মেঘ ধরতে যাচ্ছি!’ সেই সেনা সদস্যও হেসে বললেন, ‘মেঘ ধরা সহজ নয়, ভাই। তবে আপনারা চেষ্টা করতে পারেন।’

এরপর আমাদের ব্যাগপত্র আর পরিচয়পত্র চেক করা হলো। হিমু মৃদুস্বরে বলল, ‘আরে, এমন চেকিং দেখতে তো দারুণ লাগে!’ আনসার কানে কানে বলল, ‘কী জানি, যদি কোনো ভুল হয়ে যায়!’ সব চেকিং শেষে আমাদের যেতে দেওয়া হলো। সেনা সদস্য হাসিমুখে বললেন, ‘আপনারা সাবধানে ঘুরবেন আর পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করবেন।’ আমরা হাসিমুখে বিদায় নিয়ে আবার রওয়ানা দিলাম।’ চেকপোস্ট পেরিয়ে আমরা একেবারে ঢুকে পড়লাম পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে। চারদিকে যেন সবুজের ঢেউ, সেই পথের প্রতিটি বাঁক আমাদের আরও গভীরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। নয়ন জানালার পাশ দিয়ে মাথা বের করে বলল, ‘এটা তো অন্য জগৎ! এখানে সব কিছু অন্যরকম সুন্দর।’

নীলগিরির পথে আমাদের যাত্রা শুরু করার আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল চান্দের গাড়ি ভাড়া করা। নীলগিরির পথে যাওয়ার জন্য আমাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল একটা ভালো চান্দের গাড়ি খুঁজে বের করা। শহরের মোড়ে মোড়ে কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। চালকদের মধ্যে কেউ বসে পান চিবোচ্ছেন। কেউবা অলস চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমরা এগিয়ে গিয়ে দরদাম শুরু করলাম। ‘ভাই, নীলগিরি পর্যন্ত কত নেবেন?’ নয়ন প্রশ্ন করল। চালক একটু হিসাব করে বলল, ‘সাত হাজার লাগবে, ভাই। রাস্তা খারাপ, গাড়িরও মেইনটেন্যান্স আছে।’ আনসার সঙ্গে সঙ্গেই মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘না, ভাই, এত নেওয়া সম্ভব না! পাঁচ হাজার দিব, চলবে?’ চালক মাথা চুলকে বলল, ‘পাঁচ হাজার তো খুব কম হয়, ভাই!’ আমি যোগ দিলাম, ‘ভাই, আমরা তো বন্ধু-বান্ধব মিলে ঘুরতে যাচ্ছি, বাজেট কম। তাছাড়া, চান্দের গাড়ির এই রাইডটা তো আমাদের জন্য একদম নতুন অভিজ্ঞতা!’

শহরের ব্যস্ত রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে আমরা দরদাম করতে লাগলাম। চালক প্রথমেই একটু বেশি দাম হাঁকালেন। তবে নয়ন আর আনসার দুজনেই নিজেদের দর কষাকষির দক্ষতা দেখিয়ে কিছুটা কমিয়ে নিলো। ‘ভাই, এত বেশি নিলে তো আমরা নীলগিরি পৌঁছানোর আগেই পকেট ফাঁকা হয়ে যাব!’ আনসার মজার ছলে বলল। চালক হেসে বলল, ‘আপনাদের জন্যই তো পাহাড়ি রাস্তায় জীবন বাজি রেখে গাড়ি চালাই। একটু বেশি না নিলে চলবে?’ অবশেষে কিছুটা দরদাম করে আমরা এক মনে গাড়িতে উঠে পড়লাম। চান্দের গাড়ির খোলা পেছনের অংশে বসে বাতাসের ছোঁয়া নিতে নিতে মনে হলো, সত্যিকারের অ্যাডভেঞ্চার তো এখনই শুরু হলো!

চান্দের গাড়িটা পাহাড়ি পথ ধরে এগিয়ে চলছিল। ঝাঁকি খেতে খেতে সবাই হাসাহাসিতে ব্যস্ত। বাতাসে পাহাড়ের শীতল গন্ধ। সেই সঙ্গে হিমুর ছোট্ট মেয়ে অভ্রির একটানা প্রশ্ন—‘আন্টিরা, বানর কই?’ হিমুর ছোট্ট মেয়ে অভ্রি সবার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে। সে তো আসার আগেই ঠিক করে ফেলেছিল, বান্দরবানে বানর দেখবেই! কিন্তু এতদূর এসে একটাও বানরের দেখা নেই! সোহানা হাসতে হাসতে বলল, ‘বান্দরবানে আসলাম আর একটা বানরও নেই, এটা কেমন কথা?’ নয়ন ফিসফিস করে আনসারের কানে কিছু বলল। দুজনের মুখে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল। তারপর হুট করে তারা দুজন লাফিয়ে উঠে বসে পড়ল সিটে। নয়ন দু’হাত মাথার পাশে তুলে অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঝাঁকি দিচ্ছে আর আনসার মুখ বাঁকিয়ে একদম বানরের মতো আওয়াজ করছে—‘উহ! আহ! ক্যাঁচ ক্যাঁচ!’ চান্দের গাড়ির ভেতর সবাই প্রথমে চমকে গেল, তারপর হেসে কুঁকড়ে গেল! অভ্রি বিস্ময়ের দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ দেখল। তারপর খিলখিলিয়ে হেসে উঠল—‘হে হে হে! তোমরা তো আসলেই বানর!’

চান্দের গাড়ি তখনো চলছিল, পাহাড়ি পথ ধরে। বাতাসে ভেসে যাচ্ছিল সবার হাসির শব্দ। অভ্রির আনন্দে উচ্ছ্বসিত মুখ দেখে নয়ন-আনসার আরও নাটকীয় ভঙ্গিতে বানরের নকল করতে লাগল। সড়কের বাঁকগুলো এমনভাবে ঘুরছিল যে, মনে হচ্ছিল আমরা কোনো মেঘের মধ্য দিয়ে চলছি। রাস্তার ধারে কখনো ছোট ছোট ঝরনা দেখা যাচ্ছে। কখনো আবার নিচে গভীর উপত্যকা। লাহা বলল, ‘এখানে যদি হারিয়ে যাই। তা-ও কোনো আফসোস থাকবে না!’ গাড়ি থেমে গেলে আমরা একটু হেঁটে নেমে পড়লাম। ঠান্ডা বাতাস আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষকে সতেজ করে দিলো। আনসার হাসতে হাসতে বলল, ‘আরে, মেঘ তো আর ছুঁতে হবে না, মেঘই আমাদের জড়িয়ে ধরছে।’ নীলগিরির রাস্তাটা আমাদের কাছে শুধু একটা ভ্রমণ নয়, এক টুকরো স্বপ্নের মতো ছিল। প্রকৃতির এই সৌন্দর্যের তুলনা হয় না।

চলবে...

আরও পড়ুন নীলা মার্কেটে একদিন  একদিনের ময়মনসিংহ ট্যুরে যা কিছু আছে দেখার 

এসইউ/জিকেএস