ভূমধ্যসাগরীয় কয়েকটি দেশে ‘ব্ল্যাক লেক ওয়েভার’ নামের এক ধরনের মাকড়সা দেখা যায়। ডিম পাড়ার পর মা মাকড়সাটি সেই ডিমগুলো নিজের দেহে বহন করে। প্রকৃতির নিয়মে ডিমের ভেতরে নতুন প্রাণের স্পন্দন আসে। সময়মতো ডিম ফুটতে শুরু করে। কিন্তু খাদ্য কোথায়? ক্ষুধার জ্বালায় মাকড়সার বাচ্চাগুলো ঠুকরে ঠুকরে খেতে শুরু করে মায়ের দেহ। সন্তানের মুখ চেয়ে মা নীরবে হজম করে কষ্ট-যন্ত্রণা। একসময় মায়ের পুরো দেহই চলে যায় সন্তানদের পেটে। সন্তান নতুন পৃথিবীর দিকে হাঁটতে থাকে। মৃত মা পড়ে থাকে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে। এমনই মাকড়সা মায়ের আত্মত্যাগের কাহিনি।
Advertisement
মানবসন্তান মাকড়সার মতো মায়ের শরীর সাবাড় করে না ঠিকই, তবে বাঁচে মায়ের শক্তিতে। মায়ের গর্ভে সন্তান যেমন রক্ত শুষে নিরাপদে বড় হয়; তেমনই জন্মের পরও মা-ই কেবল তার নাড়িছেঁড়া ধনকে তিলে তিলে বড় করে। আমাদের আশেপাশে এমন অগণিত উদাহরণ আছে। এমন কয়েকজন মায়ের খোঁজ মেলে ঢাকায় ফুল বিক্রেতাদের মধ্যে। জীবনের গল্প শুনতে তাদের কাছে যেতেই বোঝা যায়, ‘জীবন অতটা সহজ নয়। অন্যের হাতে ফুল তুলে দিতে, নিজের ফুলটিকে মাটিতে শোয়াতে হয়।’
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ও মধুময় ডাক হলো ‘মা’। ‘মা’ নামক ওই ছোট্ট সম্পর্কটি একজন সন্তানের কাছে মহাশক্তির মহাউৎস। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘মা হলেন জগজ্জননী। তার চেয়ে শান্তির ঠিকানা আর কোথাও নেই।’ তেমনই একজন শক্তির ঠিকানা ‘হাবিবা বেগম’। পেশায় ফুল বিক্রেতা এই মাকে দেখা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায়। পেটের তাগিদে তাকে প্রতিদিন কাজে বের হতে হয়। তবে ১ বছর বয়সের ছোট সন্তানটিকে রাখতে হয় নিজের কাছে। শিশুটির খাওয়ানো, গোসল করানো, ঘুম পাড়ানো সবই করতে হয় কাজের পাশাপাশি। কাজের সঙ্গেই চলে সন্তান পালন। মায়ের কাজের অঙ্গনেই সৃষ্টি হয় মা-সন্তানের নতুন আরেকটি গল্প।
কাজের মুহূর্তে মাটিতে বিছানো একটি পাটিতে ঘুমাচ্ছিল হাবিবার সন্তান। ঢাকার শব্দদূষণে যখন স্বাভাবিক কারো কানে তালা পড়ছিল, তখনো শিশুটি ঘুমাচ্ছিল বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে। দেখেই বোঝা যায়, ওর ঘুমে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কারণ সে সেখানে-সেভাবে ঘুমে অভ্যস্ত বহুদিন হলো। শিশুটির নিশ্বাস যেন বলছিল, ওর মোটেই ভয় লাগছিল না। কারণ শত কাজের মধ্যেও মা যে ওর পাশেই আছে।
Advertisement
হাবিবা বলেন, ‘সন্তানডারে কোথায় রাইখা আসমু। কারো কাছে রাইখা কাজে আসলেও চিন্তা হয়। সেই চিন্তায় কাজ করতে পারি না। তার থেকে সঙ্গে নিয়ে আসা ভালো। ওর আর আমার দুজনেরই একটু কষ্ট হয়। তবু চিন্তা থেকে তো মুক্ত থাকা যায় বলেই সঙ্গে আনি। ওরে চোখের সামনে না রাখলে আমার কোনো কাজে মন বসে না।’
আসলে মা মানে ব্যস্ততার মধ্যেও সন্তানের প্রতি দায়িত্ব। একজন সন্তানের কাছেও মা মানে আস্থা। কোনো না কোনো কাজ নিয়ে ব্যস্ত থেকেও সন্তানের প্রতি কোনো ধরনের অযত্ন তিনি রাখেন না। সব কাজের মধ্যেও মা পারেন তার সন্তানের সব প্রয়োজন মেটাতে। কারণ মায়ের ভালোবাসায় কোনো স্বার্থ নেই, কোনো প্রাপ্তির প্রত্যাশা নেই। মা তার সন্তানকে বুকভরা ভালোবাসা, প্রাণঢালা আদর বিলিয়েই ধন্য হোন। ইংরেজি কবি রবার্ট ব্রাউনিং বলেছেন, ‘মাতৃত্বেই সব মায়া-মমতা ও ভালোবাসার শুরু এবং শেষ।’
ঢাকা মেডিকেল ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় ফুল বিক্রি করেন ‘মৌসুমি বেগম’। লক্ষ্মীপুরের একটি দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম। সুখ-স্বাচ্ছন্দের প্রত্যাশা নিয়ে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। একটি বেসরকারি হাসপাতালে আয়ার কাজ নিয়েছিলেন। এরপর ভাগ্য তাকে টেনে নিয়েছিল আরেক গরিবের ঘরে। বিয়ে হলো রিকশাচালক বাসেদ মিয়ার সঙ্গে। মহাখালীর সাততলা বস্তিতে ঘর বাঁধেন ওই দম্পতি। পরে ঘটনাচক্রে সংসার সাজাতে হয়েছে চানখারপুলে।
মৌসুমি এখন ফুলের মালা গাঁথেন। রাজধানীর পথে পথে বিক্রি হয় মালাগুলো। আয়ের পাশাপাশি সংসার-সন্তানও সামলাতে হয়। মোট তিন সন্তানের মা মৌসুমি বেগম। বড় ছেলে গাজীপুরে থাকে, মাদরাসায় পড়ে। আর বাকি দুই ছেলে এখনো ছোট-অবুঝ। ওরা দুজন দিনভর মায়ের সঙ্গেই থাকে।
Advertisement
ভরদুপুরে মালা গাঁথছিলেন মৌসুমি। মায়ের পাশেই খুনসুটিতে ব্যস্ত তার ছোট দুই ছেলে। এমন নিয়মে গত কয়েক বছর ধরে চলছে পরিবার। প্রতিদিন ৪০-৫০টি শিউলি-বকুল-নয়নতারা মালা বিক্রি হয় ১০-২০ টাকা দরে। বাসেদ মিয়ার রিকশা আর মৌসুমির ফুল বিক্রির আয়ে ৫ সদস্যের জীবন চলে। এই মা চান তার সন্তানের পূর্ণ শান্তি। তবুও দরিদ্র মায়েদের কষ্টযুদ্ধের প্রভাব পড়ে সন্তানের ওপর। পেটের ক্ষুধা যে বেশ পাষণ্ড। সাধের সন্তানকেও মায়ের বুক থেকে নামিয়ে দেয় মাটির বিছানায়- ধুলোর চাদরে।
মৌসুমি বলেন, ‘ঢাকায় থাকা-খাওয়া, ছেলেপুলে মানুষ করায় যে খরচ, তা পুরুষের একজনের আয়ে হয় না। আমাদেরও কাজ করতে হয়। দৈনিক দেড়শ-দুইশ টাকাও যদি ইনকাম করি, তা সন্তানদের জন্যই। বড় ছেলেকে মাদ্রাসায় পড়াই। বাকি দুটাকেও পড়ালেখা শেখাব। আমি কাজে এলে কেউ ওদের কাছে থাকার মতো নাই, তাই সঙ্গে আনি। আরেকটু বড় হলে আর সঙ্গে আনব না। ওরা পড়ালেখা করে বড় হলে আমার আর এত কষ্ট লাগবে না। সেই দিনের অপেক্ষায় আছি।’
এমন উদাহরণ আরও আছে। অনেক নারীই সংসার-সন্তান সামলানোর পাশাপাশি স্বামীর সমান আয় করেন। তাদের দুঃখগাথা দিনগুলো ফুলের মালায় গাঁথা হয় রাস্তার ধারে। সেই মালাগুলো বিক্রি হলেই তাদের জীবিকা চলে। তবে রোজগারের প্রয়োজনে ঘরের পুরুষটি একা বেড় হলেও সন্তান নিয়ে বাইরে যেতে হয় মায়েদের। অনেক সময় সেই সন্তানটিও কাজ শিখে ফেলে, মায়ের কাজ দেখতে দেখতে।
শাহবাগ মোড়ের পুলিশ বক্সের পাশেই বসেন রানু বেগম। ফুলের মালা গাঁথার কাজ করেন তিনিও। আর মায়ের গাঁথা মালাগুলো বিক্রি করে তার মেয়ে আয়শা মনি। আয়শা বারবার আসে, মায়ের গাঁথা মালাগুলো নিয়ে বিক্রির জন্য ফের ছোটে ক্রেতার কাছে। দিনশেষে মা-মেয়ের আয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। সেই টাকায় পরিবারের সবার পেট চলে।
মায়ের কাছে প্রশ্ন ছিল, ‘আয়শার তো লেখাপড়ার বয়স, ওকে কাজে আনেন কেন?’ বললেন, ‘ওর বাবা মারা গেছে প্রায় ৭ বছর আগে। তখন আয়শা পড়ালেখা করত। পরে করোনা আইল। ঢাকায় কোনো কাজকর্ম না থাকায় বাড়িতে চলে যাই। ২০২২ সালের শুরুতে কাজের প্রয়োজনে ঢাকায় ফিরি। এরপর মেয়েটার আর পড়ালেখা হয়নি। এখন আমার সঙ্গে থেকে ফুলের কাজ করে।’
সূত্র বলছে, ঢাকায় নানা জনবহুল এলাকায় ফুলের মালা তৈরি ও বিক্রির কাজ করেন কমপক্ষে ২০০ নারী। তাদের বেশিরভাগ মা। প্রতিটি মায়ের জীবনেই আছে সন্তান আর কাজ সামলানোর গল্পগাঁথা। কাজের প্রতি সম্মান আর সন্তানের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই এসব কর্মজীবী মায়েরা চালিয়ে যান জীবনযুদ্ধ।
আসলে কোনো উপমাই মায়ের জন্য যথেষ্ট নয়। কোনো কিছুর তুলনা হতে পারে না। মা তো মা-ই। জীবনের চরম সংকটকালে পরম সান্ত্বনার স্থল হিসেবে যার কথা প্রথম মনে পড়ে, তিনি মমতাময়ী মা। মা প্রথম পৃথিবীর রং, রূপ, শব্দ, গন্ধ চেনান, দেখান এবং শেখান। অবশ্য যার মা নেই; সে-ই বোঝেন মা হারানোর যন্ত্রণা। আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন, ‘যার মা আছে, সে কখনোই গরিব নয়।’
এসইউ/এমএস