পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে কর্মকর্তা কর্মচারীদের নামে মামলা প্রত্যাহার করে চাকরিতে পুনর্বহালসহ ৫ দফা দাবি জানিয়েছেন তারা। মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১১ টায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানান তারা।
Advertisement
১.মামলা প্রত্যাহারপূর্বক সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিতে পুনর্বহাল করা।
২.দ্বৈতনীতি পরিহারপূর্বক আরইবি-পবিস একীভূতকরণ অথবা অন্যান্য বিতরণ সংস্থার ন্যায় পুনর্গঠন করা।
৩. অবশিষ্ট চুক্তিভিত্তিক/অনিয়মিতদের চাকরি নিয়মিতকরণ করা।
Advertisement
৪.আরইবি কর্তৃক পবিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দমন পীড়ন, হয়রানি ও উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করা।
৫. বিগত সময়ে আরইবির দুর্নীতিবাজদের শাস্তির জন্য নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করা।
আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, দেশের ৮০ ভাগ অঞ্চলে প্রায় ১৪ কোটি মানুষের বিদ্যুৎ সেবায় নিয়োজিত ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ৪৫ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। নিয়ন্ত্রক সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সীমাহীন দুর্নীতি, নিম্নমানের মালামাল ক্রয় ও নন-স্ট্যান্ডার্ড লাইন নির্মাণের কারণে সৃষ্ট গ্রাহক ভোগান্তি, মাঠ পর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও সব ধরনের পলিসি প্রণয়নসহ বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)-পবিস দ্বৈত ব্যবস্থাপনা নিরসনে ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাস থেকে অভিন্ন চাকরিবিধি বাস্তবায়ন এবং জরুরি সেবায় নিয়োজিত চুক্তিভিত্তিক/অনিয়মিত কর্মচারীদের নিয়মিতকরণের ২ দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করা হয়।
তারা বলেন, সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে স্মারকলিপি প্রেরণ, বিভিন্ন দফায় গ্রাহক সেবা চালু রেখে কর্মবিরতি, লং মার্চ টু আরইবি, সারাদেশে একযোগে মানববন্ধন ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করা হয়। যৌক্তিকতা উপলব্ধি করে সরকারের পক্ষ থেকে আগস্ট মাসে বিদ্যুৎ বিভাগ, আরইবি এবং পবিসের সমন্বয়ে ৯ সদস্য বিশিষ্ট একটি সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু সরকারের সংস্কার কার্যক্রমে সহযোগিতা না করে বিদ্যমান কাঠামো বহাল রাখার বিষয়ে মতামত দেয় আরইবি। পরবর্তী সময়ে উক্ত কমিটি বিলুপ্ত করে গত ২৩ অক্টোবর সরকারের পক্ষ থেকে পুনরায় ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। প্রায় সাড়ে ৩ মাস অতিবাহিত হলেও কমিটির প্রতিবেদন সম্পন্ন হয়নি।
Advertisement
তারা বলেন, বর্তমানে এই কমিটির কাজ চলমান। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির পক্ষ থেকে মাঠ পর্যায়ে কোনো ধরনের কর্মসূচি না থাকা সত্ত্বেও আরইবি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে ভুল বার্তা দিয়ে পরিকল্পিতভাবে গত ১৬ অক্টোবর আরইবি কর্তৃক পবিসের ১০ জন কর্মকর্তাকে বিনা নোটিশে চাকরিচ্যুত এবং একই তারিখ দিবাগত রাতে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করা হয়।
তারা বলেন, একই ব্যক্তিদের বিগত সরকারের সময়ে মে মাসে সরকারের উন্নয়নবিরোধী আখ্যা দিয়ে স্ট্যান্ড রিলিজ এবং ওএসডি করা হয়। পরদিন সকাল থেকে পবিসের কর্মকর্তাদের গ্রেফতার এবং আরো ১৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বিনা নোটিশে চাকরিচ্যুত করা এবং যৌথ বাহিনী দ্বারা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেধড়ক মারধর ও ধরপাকড় করা হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে পবিসের কর্মীরা আতঙ্কিত এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলে বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের মতো ঘটনা ঘটে। দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য যা ছিল আরইবির পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। পরবর্তী সময়ে উক্ত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত কমিটির ওপর আস্থা রেখে পবিসের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সব ধরনের কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, প্রায় ৩ মাস কারাভোগের পর বর্তমানে আমরা জামিনে মুক্ত আছি। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এতো বড় ট্রাজেডি ঘটানোর পরও আরইবি থেমে থাকেনি। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাময়িক বরখাস্ত, স্ট্যান্ড রিলিজ, ওএসডি এবং নিজ জেলা থেকে গড়ে ৫০০-৬০০ কিলোমিটার দূরে হয়রানিমূলক বদলিসহ নানান শাস্তিমূলক ব্যবস্থা চলমান রেখেছে। গত ১৫ ডিসেম্বর থেকে এক মাসে প্রায় ৫ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছে। এছাড়া চুক্তিভিত্তিক কর্মচারীদের মধ্যে লাইন ক্রু লেভেল-১ এবং বিলিং সহকারীদের চাকরি নিয়মিত করা হলেও মিটার রিডার কাম মেসেঞ্জার এবং লাইন শ্রমিকদের চাকরি নিয়মিত করা হয়নি। মিটার রিডাররা যদি চুক্তিভিত্তিতে ৩৬ বছর চাকরি করতে পারে তাহলে তাদের নিয়মিত না করা অযৌক্তিক। বেতন-ভাতা বৃদ্ধি না করেও বিদ্যমান কাঠামোতে তাদের চাকরি নিয়মিত করার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া লাইনম্যানের বিকল্প হিসেবে একই কাজ করা সত্ত্বেও লাইন শ্রমিকদের চাকরি নিয়মিত করা হয়নি। কিছু সংখ্যক নিয়মিত করায় বঞ্চিতদের মধ্যে চরম অসন্তুষ্টি বিরাজ করছে। সর্বশেষ গত ৩ ফেব্রুয়ারি পিরোজপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির একজন বিলিং সহকারীকে ফেসবুক পোস্ট/লাইক/কমেন্টের কারণে বিনা নোটিশে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। একটা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে কি পরিমাণ কর্মী নিপীড়ন হতে পারে তার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে যাচ্ছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড।
তারা বলেন, আরইবি-পবিস সংকটকালীন চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেন মেজর জেনারেল জিয়া-উল আযিম। তার অনুরোধ এবং বিদ্যমান সমস্যা দায়িত্ব নিয়ে সমাধানের আশ্বাসে ২৭ আগস্ট পবিসের পূর্বঘোষিত গণছুটি কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হয়। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় পরবর্তী সময়ে নিরপেক্ষভাবে সমস্যা সমাধানে আন্তরিক না হয়ে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মীদের দমন পীড়নের নায়ক হিসেবে তিনি তার ক্ষমতার সর্বোচ্চ অপব্যবহারের নজির স্থাপন করেছেন। পবিসের কর্মীদের বাক স্বাধীনতা পর্যন্ত তিনি কেড়ে নিয়েছেন। বিভিন্ন পবিসে মতবিনিময় সভায় যে সব কর্মী সংস্কার এবং নির্যাতিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে কথা বলেছেন তাদের প্রত্যেককে দূরবর্তী স্থানে বদলি করেছেন।
তারা বলেন, গত ২১ জানুয়ারি ভোলা পবিসে আরইবি চেয়ারম্যান মতবিনিময় সভায় মিটার রিডার কাম মেসেঞ্জারদের নিয়মিতকরণ সংক্রান্ত দাবির কথা বলাকে কেন্দ্র করে ফেসবুক কমেন্ট, শেয়ারের কারণ দেখিয়ে ২ জন এবং পটুয়াখালী পবিসের ১ জন মিটার রিডার কাম মেসেঞ্জারকে বিনা নোটিশে চাকরিচ্যুত করেছেন। অথচ জাতীয় মিডিয়ায় আরইবির দুর্নীতির বিষয়ে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা হলেও, আরইবির সহকারী পরিচালক সমিতির ডিজিএমকে গালিগালাজ করলেও তিনি আরইবির কারো বিরুদ্ধে অদ্যাবধি কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। এছাড়া সংস্কারের জন্য জাতীয় কমিটি কাজ করা সত্ত্বেও আরইবি কমিটির রিপোর্টের তোয়াক্কা না করে একই কাজের জন্য নিজস্ব কমিটি গঠন করে জাতীয় কমিটির কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে নিজে সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের উদ্যোগ না নিয়ে আরইবির চেয়ারম্যান ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অপপ্রয়োগের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্ন, পল্লী বিদ্যুৎ খাতকে পুনরায় অস্থিতিশীল করা এবং সরকারের পল্লী বিদ্যুৎ সিস্টেমের সংস্কার কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা করছে মর্মে প্রতীয়মান হচ্ছে।
তারা অভিযোগ করেন, সরকারের সঙ্গে ইতিপূর্বে বর্ণিত সমস্যা সমূহের বিষয়ে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির পক্ষ থেকে একাধিকবার আলোচনার চেষ্টা করা হলেও কোন ধরনের আন্তরিকতা পরিলক্ষিত হয়নি। দীর্ঘ ৪৭ বছরের পুরানো মডেল সংস্কারপূর্বক দ্বৈতনীতির অবসান চেয়েছি, সরকারের প্রতি আস্থা রেখে সব ধরনের কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছি তথাপি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড কর্তৃক মামলা, চাকরিচ্যুতি, হয়রারিমূলক বদলিসহ দমন পীড়ন ও নির্যাতন অব্যাহত রাখা হয়েছে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলোতে পুনরায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য আরইবির এই ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধ, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুতদের চাকরিতে পুনর্বহাল এর জন্য সরকারের নিকট বিনীতভাবে অনুরোধ করছি। এ বিষয়ে গত ২০ জানুয়ারি বিদ্যুৎ উপদেষ্টা বরাবর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ৩০ হাজার কর্মীর গণস্বাক্ষর সম্বলিত স্মারকলিপি প্রেরণ করা হয়েছে, যার অনুলিপি মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ও বিদ্যুৎ সচিবকে দেওয়া হয়েছে। বিদ্যমান সংকট সমাধানে সাড়ে ৩ মাস পূর্বে জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে, নিরপেক্ষ এবং টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে অবিলম্বে উক্ত কমিটির প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য অনুরোধ করছি। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে সরকারের নিকট
তারা বলেন, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মীরা সার্বক্ষণিক গ্রাহক সেবায় বদ্ধপরিকর। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা কিংবা গ্রাহক সেবা বিঘ্নিত হোক এমন কোনো পরিস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য নয়। রাষ্ট্র তথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলেও প্রত্যাশা করেন তারা৷
সংবাদ সম্মেলনে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির এজিএম (ওএন্ডএম) আব্দুল হাকিম ও মো. সালাহউদ্দিন এবং ডিজিএম মো. রাহাত ও মো.আসাদুজ্জামান ভূঁইয়াসহ ভুক্তভোগী আরো অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন।
এনএস/এসএনআর/জেআইএম