ড. ফোরকান আলী
Advertisement
মানুষের সভ্য চাপে পৃথিবী আজ বড়ই বিপন্ন। গোটা পৃথিবীর আজ এক কঠিন সংকটে নিপতিত। যে সংকট মানুষ নিজেই সৃষ্টি করেছে। প্রতিদিন সংকটকে আরও ঘনীভূত করে চলেছে। বন উজাড় করে, পাহাড়ের মাটি, কাঠ পুড়িয়ে মানুষ প্রতিনিয়ত পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। নদ-নদীর গতি পথ যথোচ্ছভাবে পরিবর্তন করে চলছি আমরা। দূষণের মাত্রা এতটা বাড়িয়ে দিয়েছে যে পর্বত শীর্ষেও মেরু এলাকায় জমে থাকা বরফ গলছে অতি দ্রুততায়। ফলে বেড়ে যাচ্ছে সমুদ্রের পানির উচ্চতা।
পরিবেশ বিজ্ঞানীগণ সতর্ক করে আসছেন, এভাবে বিশ্বের উষ্ণতা আর দুই ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়ে গেলে পৃথিবীর বহু ভূ-ভাগ পানির নিচে চলে যাবে। এ তালিকায় আছে বাংলাদেশও। বলা হচ্ছে, বর্তমান হারে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে আর মাত্র ১৫-২০ বছরেই বাংলাদেশের পাঁচ ভাগের এক ভাগ এলাকা পানির নিচে চলে যাবে। লবণাক্ততা গ্রাস করবে প্রায় সমগ্র বাংলাদেশকে। আর ভূমিকম্প, প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা, নদী ভাঙনসহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মানুষের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হবে। এর ফলে বাংলাদেশ হয়তো একদিন বসবাসেরই অযোগ্য হয়ে উঠবে। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ জীবনকেন্দ্রিক আবহের মধ্য দিয়ে যায়। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের জন্যই এখানকার প্রকৃতি এত বেশি বৈচিত্র্যময়। হিমালয় আর বঙ্গোপসাগরের মধ্যবর্তী এ ব-দ্বীপ তাই প্রকৃতির তাণ্ডব চলতেই থাকে। ঋতুবৈচিত্র্যের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিয়ত মানুষের সঙ্গী হচ্ছে নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতকি দুর্যোগে বালাদেশের অতিমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দুই কারণে। ভৌগোলিক অবস্থান ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া মোকাবিলায় নিজস্ব অক্ষমতা।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ
Advertisement
মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর প্রতিকূল প্রভাব রয়েছে এমন যে কোনো প্রাকৃতিক ঘটনাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ। অন্যভাবে বলা যায়, মানবসৃষ্ট নয় এমন দুর্ঘটনা, যেমন- ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রাকৃতিকভাবে সংঘটিত ঘটনাবলী যা শুধু মানবসৃষ্ট ভৌত ব্যবস্থাদির উপস্থিতির কারণেই ক্ষতিকারক বলে বিবেচিত হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিস্তার এবং প্রভাব পৃথিবীর সব দেশে সমান নয়। প্রাকৃতিক কারণে যেসব দুর্যোগ সংঘঠিত হয় সেগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। উন্নত দেশের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশসমূহে সৃষ্ট দুর্যোগে জীবন ও সম্পদহানির পরিমাণ অনেক বেশি। এর কারণ উন্নয়নশীল দেশে দুর্যোগ সংঘঠনের বৃহত্তর সংখ্যার দিকটি নয় বরং বৃহত্তর ধ্বংসযোগ্য ভেদ্যতা রয়েছে। স্বভাবতই উন্নয়নশীল দেশসমূহের অধিবাসীদের ঝুঁকির মাত্রা তুলনামূলক বেশি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে যেসব বিষয় ক্রিয়াশীল, তার মধ্যে রয়েছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দ্রুত শহরায়ন এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার ক্রমাগত বৃদ্ধি।
আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের তিনটি বৃহৎ শ্রেণীর মধ্যে মুখোমুখি থাকি। এর মধ্যে বায়ুন্ডলীর প্রক্রিয়াসৃষ্ট বায়ুমন্ডলীর দুর্যোগ, ভূ-পৃষ্ঠের প্রক্রিয়াসৃষ্ঠ দুর্যোগ ও পৃথিবী-পৃষ্ঠের অভ্যন্তরস্থ প্রক্রিয়াসৃষ্ট ভূ-গর্ভস্থ দুর্যোগ আমাদের পিছু ছাড়ছেনা। বায়ুমন্ডলীর প্রক্রিয়াসৃষ্ট বায়ুমন্ডলীর দুর্যোগসমূহের কারণে ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, কালবৈশাখী, হারিকেন, টর্নেডো, খরা ইত্যাদি লেগেই থাকে। ভূ-পৃষ্ঠের প্রক্রিয়াসৃষ্ট দুর্যোগসমূহের কারণে বন্যা, নদীভাঙন, ভূমিধস, উপকূলীয় ভাঙন এবং প্রাকৃতিক ভূ-গর্ভস্থ পানি দূষণ বাড়ছে। পৃথিবী-পৃষ্ঠের অভ্যন্তরস্থ প্রক্রিয়াসৃষ্ঠ ভূ-গর্ভস্থ দুর্যোগগুলোই আমাদের ভূমিকম্প এবং অগ্ন্যুৎপাতের সম্মুখীন করে। বাংলাদেশে বায়ুমন্ডলীর দুর্যোগ এবং দুর্যোগের ঝুঁকি অধিক এবং এখানে ভূ-গর্ভস্থ দুর্যোগের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন, উপকূলীয় ভাঙন, ভূমিধস, প্রাকৃতিক কারণে ভূগর্ভস্থ পানি দূষণ প্রভৃতি বাংলাদেশের প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ভূগর্ভের প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহের মধ্যে এখানে কেবল ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে; অগ্ন্যুৎপাতের সম্ভাবনা কম।
ঘূর্ণিঝড়
বাংলাদেশের ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ এটি তীব্র বাতাস, প্রায়শই ভারী বৃষ্টিপাত আর বজ্র বিদ্যুৎ, সমুদ্রে ফুসে ওঠা উঁচু ঢেউয়ের উত্তাল অবস্থা সবমিলে এই হলো ঘূর্ণিঝড়ের চিত্র। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল বঙ্গোপসাগরে প্রায়শই ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির ভূগত কারণ হিসেবে চিহ্নিত। বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণ বিস্তৃৃত নিম্ন সমতল ভূমি, জনসংখ্যার ঘনত্বের উচ্চমাত্রা এবং ঘরবাড়ির দুর্বল নির্মাণ কাঠামো। জলবায়ু বিশেষজ্ঞগণ ঘুর্ণিঝড়ের প্রবণতা সম্পর্কে বলেন, একটা বিষয় লক্ষনীয় যে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। আজ থেকে ৭০-৮০ বছর আগে এদেশে এত ঘূর্ণিঝড় হতো না। ১৯২০ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত একটা ঘূর্ণিঝড়ও হয়নি। ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়েছে ১৯৬০ সাল থেকে। বছরের দুটো বিশেষ সময়ে স্বাভাবিকভাবে বাতাসের দিক পরিবর্তন এবং তার ফলে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। তখন ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা থাকে। তত্ত্বগত দিক থেকে বলা হয়-পানির তাপমাত্রা যদি ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হয় তখন কোনো নিম্নচাপের সৃষ্টি হলে সেটা শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। এখন বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। যে কারণে সারাবছরই নিম্নচাপ থাকছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগ ঘন ঘন হতে থাকবে। ঘূর্ণিঝড়, উত্তাল, সমুদ্র, ফুঁসে ওঠা উপকূল ও মোহনার নদীর সঙ্গে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড় মূলত দুটি মৌসুমে ঘটে থাকে, এপ্রিল-মে এবং অক্টোবর-নভেম্বর।
Advertisement
টর্নেডো ও কালবৈশাখী
টর্নেডো বাংলাদেশ প্রাকবর্ষা উষ্ণ মৌসুমে আকস্মিকভাবে ঘটে। বিশেষত এপ্রিল মাসে যখন তাপমাত্রা সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে। একটি টর্নেডোর ব্যাস কয়েক মিটার থেকে প্রায় দুই কিলোমিটারের মতো হতে পারে। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে টর্নেডো তুলনামূলকভাবে অধিক সংঘঠিত হয়। সাধারণত এপ্রিল-মে মৌসুমে বাংলাদেশর ওপর দিয়ে বয়ে যায় উত্তর-পশ্চিমাভিমুখী প্রচন্ড ঝড়, স্থানীয়ভাবে বা কালবৈশাখী নামে পরিচিত। কালবৈশাখীর সঙ্গে সাধারণভাবে শিলাবৃষ্টি দেখা যায়। বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে কালবৈশাখী শেষ বিকেলে অধিক হারে ঘটে থাকে। কারণ ঐ সময় ভূ-পৃষ্ঠের বিকিরণকৃত তাপপ্রবাহ বায়ুমন্ডলে সঞ্চারিত হয়। যে কারণে সন্ধ্যাকালে এ ঝড়ের প্রাদুর্ভাব ঘটে।
জলোচ্ছ্বাস
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে ঝড়ো জলোচ্ছ্বাস এবং জোয়ার জলোচ্ছ্বাসেরও সৃষ্টি হয়। যা ঘূর্ণিঝড়ের প্রচন্ড শক্তিশালী বাতাস উপেক্ষা অনেক বেশি ধ্বংসলীলা সম্পাদন করে। বাংলাদেশে এপ্রিল-মে মাসে এবং সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর মাসের মধ্যে মেঘনা মোহনা ও অন্যান্য দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকুল এলাকায় জোয়ার জলোচ্ছ্বাস দেখা যায়।
বন্যা
প্রচুর বৃষ্টিপাত অথবা নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে ভূভাগ প্লাবিত হয়ে হচ্ছে বন্যা। সাধারণত ভারি বৃষ্টিপাত, বরফ অথবা তুষার গলা পানি অথবা এদের মিলিত পানি নদী প্রণালীর ধারণ কক্ষমতাকে ছাড়িয়ে গেলে বন্যা সংঘটিত হয়। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, ভূ-কাঠামো, ভূ-প্রকৃতি এবং ভূমিরূপ বন্যা সংঘটনের জন্য দায়ী। বাংলাদেশে সাধারণত মৌসুমী বন্যা, জোয়ার সৃষ্ট বন্যা, আকস্মিক বন্যা দেখা যায়।
১. সাধারণত নিম্ন উচ্চতাবিশিস্ট ভূ-সংস্থান যার ওপর দিয়ে প্রবহমান প্রধান প্রধান নদী এবং তাদের শাখ-প্রশাখা ও উপনদীর সমন্বয়ে ঘন বিন্যস্ত নিস্কাশন জালিকা গড়ে উঠেছে। ২. দেশের বাইরে নদ-নদীর উজান এলাকায় এবং দেশের অভ্যন্তরে ভারি বৃষ্টিপাত। ৩. হিমালয় পর্বতে তুষার গলন এবং প্রাকৃতিকভাবে হিমবাহের স্থানান্তর সংঘটন। ৪. পলি সঞ্চয়নের ফলে নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া/ভূমিধস সংঘটন। ৫. প্রকৃতির ওপর মানবীয় হস্তক্ষেপ। ৬. প্রধান প্রধান নদীসমূহে একসঙ্গে পানি বৃদ্ধি এবং এক নদীর ওপর অন্য নদীর প্রভাব বিস্তার করা। ৭. সমুদ্র-পৃষ্ঠের পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া। ৮. সম্ভাব্য গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া। ৯. ভূ-গাঠনিক বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি। আশার কথা, দুর্যোগের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি থেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে অর্থায়ন ও কভারেজ ঘাটতি মোকাবেলায় জুরুরি প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি ‘অ্যান্টিসিপেটরি অ্যাকশন ২০২৪’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে এ আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য প্রতিবেদনটিতে ঝুঁকি কমিয়ে আনা, অ্যান্টিসিপেটরি অ্যাকশন বীমা এবং বহু-বছরের অর্থায়ন প্রতিশ্রæতি অনুসন্ধানের পরামর্শ দেয়, যাতে দীর্ঘমেয়াদী টেকসই নিশ্চিত করা যায়।
আরও পড়ুন সবচেয়ে দুর্গন্ধময় যেসব জিনিস স্থান পেয়েছে গিনেস রেকর্ডে ৮৭ সন্তানের বাবা এক কৃষক, গড়েছেন বিশ্বরেকর্ডলেখক: গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ
কেএসকে/জিকেএস