গত ৯ জানুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট বিভাগ শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে দেয়। সেখানে আচার, বিস্কুট, কেক, চাটনি, টমেটো পেস্ট, টমেটো কেচাপ, টমেটো সস, আম, আনারস, পেয়ারা ও কলার পাল্প ইত্যাদি পণ্যের ওপর মূসক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে এসব পণ্যের দাম বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। দাম বাড়লে ক্রেতারা সেসব পণ্য কম ভোগ করবেন বা ব্যবহার থেকে বিরত থাকবেন।
Advertisement
ফলে এসব প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরিতে যেসব কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়, তার চাহিদা কমার শঙ্কা রয়েছে। চাহিদা কমলে এসব কৃষিজ পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত কৃষকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাদের দাবি, কৃষকদের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে বর্ধিত ভ্যাট ও শুল্ক প্রত্যাহার করতে হবে। তা না হলে দেশের সাধারণ কৃষকদের পাশাপাশি এদেশের উদীয়মান কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বর্তমানে দেশের বাইরেও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এরই মধ্যে প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যেও রপ্তানি ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে যথাযথ সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ সুবিধার অভাবে প্রতি বছর ৩০-৩৫ শতাংশ ফল ও সবজি নষ্ট হয়। এ কারণে কৃষক তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বাংলাদেশে বহুল উৎপাদিত কিন্তু যথাযথ সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজতকরণের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এমন একটি ফসল হলো টমেটো।
যথাযথ সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজতকরণের অভাবে কৃষিপণ্য যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্য দেশের সর্ববৃহৎ কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান প্রাণ গ্রুপ ২০০২ সাল থেকে টমেটো থেকে নানান ধরনের খাদ্যপণ্য প্রস্তুত করছে। প্রাণ সব সময় পণ্যের গুণগত মানের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করে। পণ্যের গুণগত মান অনেকাংশে নির্ভর করে মানসম্মত কাঁচামালের ওপর। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ২০১০ সালে প্রাণ টমেটোর চুক্তিভিত্তিক চাষ শুরু করে।
Advertisement
প্রাণের প্রায় এক লাখ চুক্তিভিত্তিক কৃষক রয়েছে। যাদের কাছ থেকে টমেটো, আম, বাদাম, দুধ, ডাল, কাসাভাসহ বিভিন্ন কাঁচামাল সংগ্রহ করে প্রাণ। রাজশাহী, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, খুলনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, পঞ্চগড় এবং ঠাকুরগাঁও জেলায় প্রাণের চুক্তিভিত্তিক কৃষকরা টমেটো উৎপাদন করেন। এবার সারাদেশে প্রাণের ১০ হাজার ৫০০ চুক্তিভিত্তিক কৃষক প্রায় ২ হাজার ৮০০ বিঘা জমিতে টমেটো চাষ করেন। চলতি বছর টমেটো সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ২২,০০০ টন।
গত বছর প্রাণের ১০ হাজার চুক্তিভিত্তিক কৃষক প্রায় ২ হাজার ৫০০ বিঘা জমিতে টমেটো চাষ করেছিলেন এবং টমেটো সংগ্রহের পরিমাণ ছিল ২০ হাজার টন। ফলে একদিকে প্রতি বছর প্রাণের চুক্তিভিত্তিক টমেটো চাষে যেমন কৃষক আগ্রহ দেখাচ্ছে, তেমনি প্রাণের চাষিরা প্রতি বছর বিঘাপ্রতি ভালো ফলনও পাচ্ছেন।
গত কয়েক বছরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রাণের চুক্তিভিত্তিক কৃষক বেড়েছে গড়ে প্রায় ১০ শতাংশ হারে। এর পেছনের বড় কারণ হলো উপযুক্ত সময়ে চুক্তিভিত্তিক কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে টমেটো সংগ্রহ এবং অধিক ফলনের জন্য প্রাণের পক্ষ থেকে কৃষকদের সহায়তা।
এক্ষেত্রে প্রাণ কৃষকদের উন্নতজাতের বীজ প্রদান, জমি চাষে প্রশিক্ষণ ও সঠিক সময়ে কীটনাশক প্রয়োগসহ প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করে আসছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের (আইএফসি) সহযোগিতায় ‘প্রাণ অ্যাসিউরড স্কিম’র আওতায় প্রাণ ৫ হাজার চুক্তিভিত্তিক টমেটো চাষিকে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করেছে।
Advertisement
চুক্তিভিত্তিক চাষের আওতায় কৃষকদের আগে থেকেই শতভাগ পণ্য ক্রয়ের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। বাজারমূল্যে কৃষকদের কাছ থেকে প্রাণ টমেটো ক্রয় করে। প্রাণ চুক্তিভিত্তিক চাষিদের কাছ থেকে পণ্য কিনতে বাধ্য থাকলেও চাষিদের ক্ষেত্রে প্রাণের কাছে পণ্য বিক্রয়ের বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে প্রান্তিক চাষিরা প্রাণের চুক্তির অধীনে আসায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সুযোগ নেই। অনেক সময় ন্যায্যমূল্যে টমেটো বিক্রি করতে না পেরে কৃষক তা ফেলে দিতে বাধ্য হতো অথবা পচে যেত। বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকার কৃষকদের এমন পরিস্থিতিতে প্রতি বছরই পড়তে হয়। কিন্তু প্রাণের টমেটো চাষিদের এখন আর টমেটো আবাদ করে উৎপন্ন টমেটো বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না। এ কারণে রাজশাহী অঞ্চলের কৃষকরা এখন প্রাণের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে টমেটো চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে এবং এই এলাকার টমেটোর উৎপাদন আগের তুলনায় বেড়ে গেছে। ফলে এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থারও পরিবর্তন ঘটেছে।
প্রাণের চুক্তিভিত্তিক চাষিরা বিঘাপ্রতি গড়ে ৫-৬ টন টমেটোর ফলন পান। এসব টমেটো তারা চলমান বাজারমূল্যে কয়েক ধাপে বিক্রি করেন। এতে বিঘাপ্রতি তাদের টমেটো বিক্রি হয় ৬০,০০০-৭০,০০০ টাকা দরে। অন্যদিকে তাদের খরচ বিঘাপ্রতি ২৫,০০০-৩০,০০০ টাকা। এতে তাদের বিঘাপ্রতি মুনাফা অন্তত ৩০ হাজার টাকা।
বাংলাদেশে শীতকাল টমেটো চাষের জন্য উপযুক্ত সময়। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চারা রোপণ করা হয়। জাত ও লাগানোর সময়ের ওপর নির্ভর করে দু-চার মাসের মধ্যেই ফসল তোলা যায়। প্রাণের চুক্তিভিত্তিক কৃষকরা সাধারণত ভিএল-৬৪২ জাতের হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করে। হাইব্রিড জাতীয় বীজ ব্যবহারের ফলে প্রাণের কৃষকরা অর্ডিনারি ভ্যারাইটিজ জাতের চেয়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি ফলন পান। এতে সাধারণ চাষির তুলনায় তাদের মুনাফা বেশি থাকে।
বর্তমানে রাজশাহীর বরেন্দ্র ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক-বিআইপি ও নাটোরের প্রাণ এগ্রো কারখানায় টমেটো সংগ্রহ ও পাল্পিং করে প্রাণ গ্রুপ। এবার এ দুটি কারখানায় ১৫ জানুয়ারি থেকে টমেটো সংগ্রহ ও পাল্পিং কার্যক্রম শুরু হয়েছে, যা চলবে টমেটোর সরবরাহ থাকা পর্যন্ত। প্রাণের দুটি কারখানায় এই কর্মযজ্ঞে সরাসরি নিয়োজিত প্রায় ৫০০ স্থানীয় শ্রমিক। এছাড়া টমেটোর সরবরাহসহ বিভিন্ন ধাপে নিয়োজিত-এমন পরোক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে ২ হাজার ৫০০’র বেশি লোকের।
কৃষকদের কাছ থেকে টমেটো কেনার পর প্রাণের কারখানায় প্রথমে গুণগত মান অনুযায়ী বাছাই (সর্টিং) করা হয়। এরপর স্বয়ংক্রিয় মেশিনে এগুলো নেওয়া হয় ওয়াশিং প্ল্যান্টে। সেখানে কয়েক দফায় ওয়াশ করার পর টমেটো চলে যায় ক্রাসিং প্ল্যান্টে। সেখানে টমেটো পেস্ট তৈরি হওয়ার পর সেগুলো অ্যাসেপটিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়। এরপর প্রয়োজন অনুযায়ী পেস্ট থেকে টমেটো সস্ ও কেচাপ তৈরি করা হয়। তাই প্রাণ সস্, কেচাপ এবং টমেটো পেস্ট স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিকর। অ্যাসেপটিক পদ্ধতিতে সংরক্ষিত পেস্ট দুই বছর পর্যন্ত ভালো থাকে।
টমেটো থেকে উৎপাদিত সস-কেচাপ বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক জনপ্রিয় ও প্রচুর চাহিদা রয়েছে। দেশে বর্তমানে সস্, কেচাপ এবং টমেটো পেস্টের বাজার বার্ষিক ৬০০ কোটি টাকা। এই বাজার বছরে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। তবে সম্প্রতি ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর ফলে এসব পণ্যের দাম বাড়লে অনেকেই পণ্য ক্রয় থেকে বিরত থাকবেন। এছাড়া এর প্রভাবে কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে প্রচুর শ্রমিকের জীবনে অনিশ্চয়তা নেমে আসবে।
বর্তমানে সস-কেচাপের বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে প্রাণ। বছরে ৩০ হাজার টন টমেটো সস উৎপাদন করার সক্ষমতা রয়েছে প্রাণ গ্রুপের। বর্তমানে ১১টি ভ্যারিয়েন্টে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। দাম ৩ টাকা থেকে ১ হাজার ৭০ টাকা পর্যন্ত।
দেশের বাইরেও প্রাণের সস্-কেচাপ এর ভালো চাহিদা রয়েছে এবং ক্রমেই বাজার প্রসারিত হচ্ছে। বর্তমানে প্রাণের সস্-কেচাপ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, ফ্রান্স, মালয়েশিয়াসহ ২০টি দেশে নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে। এ বাজার আরও বাড়াতে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে প্রাণের পণ্যসমূহ নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে ১৪৫টি দেশে। সুতরাং আরও ১২৫টি দেশে সস রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। তাই যত বেশি সসের বাজার তৈরি হবে, কৃষক লাভবান হবেন তত বেশি।
এমএইচআর/জিকেএস