রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে নবজাতককে নিয়ে ভর্তি আছেন সুমিত্রা রানী। তার বাড়ি রাজশাহীর কোর্ট এলাকায়। সাত দিন তার ছেলের বয়স। তিন তিন দিন ধরে তার স্বাসকষ্ট। সুমিত্রা ও তার ছেলের জন্য যে বিছানা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেটিতে তার সঙ্গে আরও তিন শিশুকে রাখা হয়েছে। ফলে সুমিত্রা রানীর সময় কাটছে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে। কখনো ছোট একটি টুলে বসে থাকতে হয়।
Advertisement
সুমিত্রা রানী জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনেক কষ্ট হয় দাঁড়িয়ে থাকতে। কয়েকদিন আগেই তো সিজার করে বাচ্চা হয়েছে। এখন আমি নিজেই রোগী। কিন্তু শিশুর জন্য আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। ছোট একটি টুল কিনে এনেছি। সেটিতে মাঝে মধ্যে বসি। শিশুকে খাওয়ানোর সময় বসতে হয়। কিছু করার নেই, সবাই এমনটিই করেছেন। আমাকেও করতে হচ্ছে।’
একই অবস্থা আফজাল হোসেনের। তিনি তার তিন দিনের মেয়েকে খিঁচুনিজনিত সমস্যা নিয়ে একই শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করেছেন। আফজাল হোসেন বলেন, অতিরিক্ত রোগীর কারণে তার মেয়েকে আরও দুটি শিশুর সঙ্গে বিছানায় রাখতে হয়েছে।
রামেক হাসপাতালে এই চিত্র বছরজুড়েই। তবে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এই সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। সারাবছর যখন রামেক হাসপাতালে রোগীর সংকুলান হচ্ছে না, ঠিক তখন রামেক হাসপাতালের অদূরেই অলস পড়ে আছে রাজশাহী শিশু হাসপাতাল। নির্মাণ কাজ শেষে হাসপাতালটির উদ্বোধনের প্রায় দুই বছর পার হলেও এটি এখনো পড়ে আছে।
Advertisement
কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও লোকবলের অভাবে হাসপাতালটি চালু করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে হাসপাতালের ভবন নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, বারবার অনুরোধ করেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাড়া না পেয়ে তারা হতাশ।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. শাহিদা ইয়াসমিন জানান, মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) পর্যন্ত শিশু বিভাগে রোগী ছিল ৪৫০ জন। অথচ এই বিভাগে শয্যা সংখ্যা মাত্র ১৫০। চিকিৎসক সব মিলিয়ে ৪৩ জন। তবে সার্বক্ষণিক থাকেন ১৬ জন। রাতে দুজন ও সন্ধ্যায় চারজন চিকিৎসক সামাল দেন এসব রোগী।
তিনি বলেন, আমাদের এখানে রোগী প্রচুর। এ কারণে বাড়তি চাপ সামলাতে হয়। বিশেষ করে ২৮ দিন পর্যন্ত বয়সী বাচ্চাদের এক বিছানায় ৩-৪ জন করে রাখা হয়। কাজ করতে অসুবিধা হয়। প্রতিবন্ধকতার মাঝেই কাজ করতে হয়।
রাজশাহী শিশু হাসপাতাল প্রসঙ্গে ডা. শাহিদা ইয়াসমিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমিও কমিটিতে আছি। তবে এখনো হ্যান্ডওভার নেওয়া হয়নি। সেখানে মেডিসিন ও সার্জারি আছে, ওয়ার্ড আছে কিন্তু ম্যান পাওয়ার নেই। এখানে আরেকটি হাসপাতাল হলে রামেকে অনেকটা চাপ কমে আসবে।’
Advertisement
রাজশাহী গণপূর্ত বিভাগের তথ্যমতে, ২০১৫ সালে রাজশাহী শহরের টিবি পুকুর এলাকায় ২.৪৪ একর জমিতে ১০ তলাবিশিষ্ট একটি বিশেষায়িত সরকারি শিশু হাসপাতাল নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। রাজশাহী গণপূর্ত অধিদপ্তর-২ এর তত্ত্বাবধানে আনুমানিক ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৬ সালে চার তলাবিশিষ্ট শিশু হাসপাতাল ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। নকশার পরিবর্তন এবং বারবার বর্ধিতকরণের কারণে তিন বছর মেয়াদি প্রকল্প আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২৩ সালের জুনে শেষ হয়। প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী ফরহাদ সরকার বলেন, ২০২৪ সালের জুন মাসে হাসপাতাল ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয়। পরে রাজশাহী পিডব্লিউডি-২-এর কর্মকর্তাদের কাছে একাধিকবার চিঠি দিয়ে ভবনটি হস্তান্তরের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তবে কর্তৃপক্ষ এখনো ভবনটি দখলে নেয়নি। আমরা আমাদের নিজস্ব খরচে সরকারি স্থাপনা পাহারা দিচ্ছি।
জানতে চাইলে রাজশাহী পিডব্লিউডি-২-এর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (সিভিল) কাওসার সরকার জানান, হাসপাতাল ভবনটি হস্তান্তরের জন্য তারা রাজশাহী সিভিল সার্জনকে একাধিক চিঠি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা তাদের ইতিবাচক কিছু জানাননি।
রাজশাহী ডেপুটি সিভিল সার্জন মাহবুবা খাতুন শিশু হাসপাতালের বিষয়ে তেমন কিছু জানেন না জানিয়ে সাবেক সিভিল সার্জন আবু সাঈদ মোহাম্মদ ফারুকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
সাবেক সিভিল সার্জন আবু সাঈদ মোহাম্মদ ফারুক জানান, শিশু হাসপাতালটি চালু করতে কয়েক মাস আগে তারা প্রয়োজনীয় জনবল ও সরঞ্জাম চেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখনো পর্যন্ত কিছু জানায়নি।
সাখাওয়াত হোসেন/এসআর/এমএস