সাংবিধানিক ও আইনগত ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুস লেনদেনকে অবৈধ ঘোষণা এবং কালো টাকা সাদা করার বৈধতা স্থায়ীভাবে বন্ধ করাসহ ৪৭ দফা সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার কমিশন।
Advertisement
বুধবার (১৫ জানুয়ারি) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে কমিশন এসব সুপারিশ করেছে। পরে বিকেলে ধানমন্ডির টিআইবি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত তুলে ধরেন দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ও টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
প্রতিবেদনে দুর্নীতি দমন কমিশনের কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তনের সুপারিশ রাখা হয়েছে। কমিশনারদের সংখ্যা তিনজন থেকে বাড়িয়ে পাঁচজন এবং দুদককে বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরামর্শও দিয়েছে কমিশন।
দুদককে শক্তিশালী, কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে কমিশনারদের পদ বাড়ানো, নিয়োগ, সার্চ কমিটি, আইনের সংস্কার, বেতন বৃদ্ধি ও প্রণোদনার জন্য সুপারিশও করা হয়েছে।
Advertisement
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ গুলোর মধ্যে রয়েছে- দুদকের সার্বিক কার্যক্রম বিশেষত অভিযোগ ব্যবস্থাপনা, তদন্ত, গোপন অনুসন্ধান, ও প্রসিকিউশন সংক্রান্ত কার্যাদি অ্যান্ড-টু-অ্যান্ড অটোমেশনের আওতায় আনা, ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবের সক্ষমতা বাড়ানো ও দুদকের নিজস্ব প্রশিক্ষণ একাডেমি স্থাপন করা।
আরও পড়ুন
এক ব্যক্তি দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনের সুপারিশএছাড়া বিতর্কিত দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধি ৫৪(২) বিলুপ্ত করা, দুদকের নিজস্ব তহবিলের (ফান্ড) ব্যবস্থা করা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আর্থিক প্রণোদনা বা পারফরম্যান্স বোনাস দেওয়া, নিজস্ব বেতন কাঠামোর তৈরি করার সুপারিশ করা হয়েছে। দুদকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করতে সরকারের সহযোগিতায় বিভিন্ন তদন্ত বা গোয়েন্দা এজেন্সির সমন্বয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চিহ্নিত করা, বিভাগীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে চাকরি থেকে বহিষ্কার করে ফৌজদারি বিচারে সোপর্দ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
দুদকের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি দমন কমিটি বিলুপ্ত করে একটি স্বতন্ত্র অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা অনুবিভাগ গঠন করা, পরিচালিত প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমের সাফল্য ও ব্যর্থতার নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় দুদককে একটি দুর্নীতি প্রতিরোধী কর্মকৌশল প্রণয়ন করতে হবে এবং তদনুযায়ী স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে।
Advertisement
দুদক চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মকর্তা পর্যন্ত নিয়োগের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুসরণের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। কমিশনারদের যোগ্যতার ক্ষেত্রে বর্তমানে আইন পেশা, শিক্ষা, প্রশাসন, বিচার বিভাগ বা শৃঙ্খলা বাহিনীতে ন্যূনতম ২০ বছরের অভিজ্ঞতার কথা বলা আছে।
এছাড়া অতি উচ্চমাত্রার দুর্নীতি বা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের দুর্নীতি, বিশেষত অর্থপাচার তদন্তের ক্ষেত্রে দুদক কর্তৃক প্রতিটি অভিযোগের জন্য দুদকের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন এজেন্সির উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে আলাদা টাস্কফোর্স গঠন করা, আয়কর আইন, ২০২৩-এর ধারা ৩০৯ সংশোধনের কথা বলা হয়েছে।
দুদক মহাপরিচালকের সংখ্যা ৮ থেকে ১২ জনে উন্নীত করে তাদের অধীনে নিম্নোক্ত ১২টি অনুবিভাগ গঠন করা উচিত বলে মনে করে সংস্কার কমিশন।
সেগুলো হল- (১) প্রশাসন, অর্থ ও মানবসম্পদ (২) প্রতিরোধ ও গণযোগাযোগ (৩) তথ্য প্রযুক্তি (৪) প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও উন্নয়ন (৫) লিগ্যাল ও প্রসিকিউশন (৬) তদন্ত-১ (৭) তদন্ত-২, (৮) বিশেষ তদন্ত (৯) মানিলন্ডারিং (১০) গোপন অনুসন্ধান-১ (১১) গোপন অনুসন্ধান-২ এবং (১২) অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা।
বর্তমানে শূন্য পদসমূহে অবিলম্বে নিয়োগের ব্যবস্থা করা, দেশের প্রতিটি জেলায় পর্যায়ক্রমে পর্যাপ্ত লজিস্টিক সক্ষমতাসহ দুদকের জেলা কার্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক ও উন্মুক্ত প্রক্রিয়ায় সচিব নিয়োগের বিধান করা, মহাপরিচালক ও পরিচালক পদসমূহের (প্রেষণে বদলির মাধ্যমে নিযুক্ত মহাপরিচালক ও পরিচালক ব্যতীত) সব নিয়োগ বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক ও উন্মুক্ত প্রক্রিয়ায় করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে উল্লিখিত স্থায়ী প্রসিকিউশন ইউনিট গঠনের জন্য অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া কমিশন গঠনে যে দুদক আইনে সার্চ কমিটির কথা বলা রয়েছে সেটি পরিবর্তন করে ‘বাছাই এবং পর্যবেক্ষক কমিটি’ করার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। এই কমিটি কমিশন যাচাই- বাছাই করে দেবে। পাশাপাশি কমিশন কী কাজ করছে তা ৬ মাস পর পর পর্যবেক্ষণ করবে। এর জন্য সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিও প্রতিবেদনে সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।
দুদক কমিশন গঠনে বিতর্কিত ‘সার্চ’ কমিটি ও দলীয় রাজনৈতিক বিবেচনা এড়াতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বাদ দিয়ে তার পরে যিনি সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ তিনি হবেন বাছাই কমিটির প্রধান। হাইকোর্টের সবেচেয়ে জ্যেষ্ঠ একজন সদস্য হবেন। একজন থাকবেন প্রধান বিচারপতির নিযুক্ত, একজন যিনি বাংলাদেশের শাসন সম্পর্কে জানেন, মহা হিসাব নিরীক্ষক, পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে একজন, সংসদ নেতা থেকে মনোনীত একজন সদস্য ও প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা থেকে মনোনীত একজন সদস্য।
কমিশন নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে নিয়োগ দেওয়ার একটি পদ্ধতিও সংস্কার কমিশনের সুপারিশে তুলে ধরা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে ‘যোগ্যতা’ ও ‘শর্ত’ পূরণ সাপেক্ষে যে কেউ চাইলে কমিশনার হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে কমিশন ‘বাছাই ও পর্যবেক্ষক’ কমিটির বাছাই প্রক্রিয়া অংশ নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে।
আরও পড়ুন
বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন নয়, পড়তে হবে ৪০ শতাংশ ভোট র্যাব নিয়ে যা সুপারিশ করলো পুলিশ সংস্কার কমিশনকমিশন গঠন প্রক্রিয়া উন্মুক্ত করার প্রস্তাব সংস্কার কমিশনের: দুদক কমিশন গঠনের বিষয়টি এত দিন গোপন থাকলেও এবার এটা সবার জন্য উন্মুক্ত করার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।
এক্ষেত্রে সংস্কার কমিশন তিনটি পদ্ধতির সুপারিশ করেছে, প্রথমটি হলো অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ‘শর্ত পূরণ’ সাপেক্ষে যে কেউ চাইলে কমিশনার হতে আবেদন করতে পারেবন বা ইছা প্রকাশ করতে পারেবন। দ্বিতীয়টি হলো- ‘বাছাই ও পর্যবেক্ষক’ কমিটি চাইলে বাছাই করে প্রার্থী তালিকা তৈরি করতে পারে। তৃতীয়টি হলো- কেউ কাউকে চাইলে মনোনীত করতে পারে।
প্রত্যেক প্রার্থীর জীবনবৃত্তান্তের পাশাপাশি দুদক সম্পর্কে তার জানাশোনা, জ্ঞান, চিন্তাভাবনা, দুদক সম্পর্কে তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জেনে নিয়ে প্রাথমিকভাবে তাদের তালিকা করা। এভাবে যোগ্য ও মেধাবীদের তালিকাভুক্ত করে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হবে।
প্রাথমিক তালিকা থেকে প্রতিটি শূন্য পদের বিপররীতে তিনজন করে ১৫ জন বাছাই করবে কমিটি। পরে এই নামগুলো এক সপ্তাহের জন্য পাবলিক করে দেওয়া হবে। এক সপ্তাহ পর সেই তালিকা থেকে ১০ জনকে বাছাই করা হবে। রাষ্ট্রপতির কাছে ১০ জনের তালিকা দেবে। এরপর সেই ১০ জনের নাম আর প্রকাশ করবে না। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি পাঁচজনকে নিয়োগ দেবেন।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে দুই ধাপে মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এর মধ্যে গত অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে গঠন করা হয় নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংস্কারে কমিশন।
চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে এ কমিশনগুলোর প্রতিবেদন দেওয়ার কথা ছিল। তবে কাজ শেষ না হওয়ায় ৩ জানুয়ারি প্রতিবেদন দেওয়ার সময় বাড়ানো হয়। এরমধ্যে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের জন্য ৩১ জানুয়ারি এবং বাকি পাঁচটি কমিশনকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছিল। এরমধ্যে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন দিতে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় চেয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে গঠন করা কমিশনগুলোর প্রতিবেদন আগামী মাসের শেষের দিকে দেওয়ার কথা।
এসএম/এমকেআর/এমএস