বরগুনায় জেলা পরিষদের ইজারা দেওয়া ১৫টি খেয়াঘাট থেকে রাজস্ব আদায় হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। তবে অনেক ঘাটেই নেই যাত্রীদের ওঠানামার জন্য নির্দিষ্টভাবে আলাদা কোনো ঘাটের ব্যবস্থা। যাত্রীদের ওঠানামার জন্য পৃথক ঘাটের ব্যবস্থা না থাকায় প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা। বিভিন্ন ঘাটে নির্মিত যাত্রীছাউনি দখল হয়ে যাওয়াসহ প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাবে সৃষ্টি হয়েছে বেহাল দশার।
Advertisement
বরগুনা জেলা পরিষদ সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর ১৫টি খেয়াঘাট থেকে সরকারি ফি বাদে ইজারাদারদের কাছ থেকে মোট পাঁচ কোটি ২২ লাখ ২০ হাজার ৯৪০ টাকা ইজারা আদায় করা হয়েছে। জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে থাকা এ ঘাটগুলো থেকে প্রতিদিন যাত্রী পারাপারের সংখ্যার ভিত্তিতেই বছর হিসেবে কমবেশি ইজারা নির্ধারণ করা হয়। এ বছর পুরাকাটা-আমতলী খেয়াঘাট থেকে সর্বোচ্চ এক কোটি ৫৩ লাখ টাকা ইজারা আদায় করা হয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বড়ইতলা-বাইনচটকি ঘাট থেকে এক কোটি ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার ইজারা আদায় হয়েছে।
এছাড়া চালিতাতলী-বগী ঘাট থেকে ৮৭ লাখ ৬০ হাজার, ফুলঝুরি-রামনা ঘাটে ৫৬ লাখ ১২ হাজার ২৪০, নিশানবাড়িয়া-পাথরঘাটা ঘাটে ৪৯ লাখ ৮২ হাজার ৫০০, বামনা-বদনিখালী ঘাটে ৩৭ লাখ ৫৫ হাজার, গোলবুনিয়া-পচাঁকোড়ালিয়া ঘাটে ১৪ লাখ ১০ হাজার, লতাকাটা-নকরী ঘাটে ৪ লাখ ৫০ হাজার, পোটকাখালী-ফুলঝুড়ি ঘাটে ৬ লাখ, কাকচিড়া-গুলিশাখালী ঘাটে ২ লাখ ১৪ হাজার, কালমেঘা-বান্দরগাছীয়া ঘাটে ২ লাখ ১০ হাজার, বালিয়াতলী-তালতলী ঘাটে ১ লাখ, পোটকাখালী বাজার-কুমরাখালী ৩১ হাজার, অযোদ্ধা-খোলপটুয়া বাজার দক্ষিন কালিকাবাড়ি ঘাটে ৩০ হাজার এবং আয়লা-গুলিশাখালী ঘাটে ১৬ হাজার ২০০ টাকা ইজারা আদায় করা হয়েছে।
প্রতিবছর সবমিলিয়ে বরগুনায় কয়েক কোটি টাকা ইজারা আদায় হলেও ঘাট ও যাত্রী সেবার মান উন্নয়নে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন ঘাটের ইজারাদার ও যাত্রীরা। সঠিক তদারকির অভাবে বিভিন্ন ঘাটে নির্মিত যাত্রীছাউনি দখল করে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও জানান তারা। যাত্রীছাউনি কারও দখল অথবা ভাড়া নেওয়ার কোনো নিয়ম না থকলেও যাত্রীছাউনিতে সংযুক্ত টি স্টল এবং পাবরিক টয়লেট ভাড়া দেওয়ার নিয়ম আছে বলে জানিয়েছেন জেলা পরিষদের সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ।
Advertisement
সরেজমিন বিভিন্ন খেয়াঘাট ঘুরে দেখা যায়, ইজারা আদায়ের দিক থেকে সর্বোচ্চ রাজস্ব আসে পুরাকাটা-আমতলীর খেয়াঘাট থেকে। তবে এ খেয়াঘাট পারাপারের জন্য আলাদা কোনো ঘাট না থাকায় ফেরির পন্টুন থেকেই ওঠানামা করতে হয় যাত্রীদের। এতে যাত্রীদের মালামাল ও মোটরসাইকেল ওঠাতে-নামাতে গিয়ে প্রায় সময়ই ঘটে দুর্ঘটনা। যাত্রীদের সুবিধার্থে পুরাকাটায় নির্মিত যাত্রীছাউনিটি জেলা পরিষদের তদারকির অভাবে দখল করে তালাবদ্ধ করে বসবাস করছেন স্থানীয় এক মসজিদের মোয়াজ্জিন।
একই চিত্র রাজস্ব আদায়ের দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বড়ইতলা-বাইনচটকি খেয়াঘাটের। ফেরি ঘাটকে খেয়াঘাট হিসেবে ব্যবহার করায় একদিকে ফেরিতে বিভিন্ন গাড়ি ওঠানামা করছে, অন্যদিকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একই পথে খেয়ায় ওঠানামা করছেন যাত্রীরা। বর্ষার সময়ে নদীর পানি বেড়ে গেলে সাঁকো দিয়ে ওঠানামা করতে হয় বড়ইতলায় যাত্রীদের। যাত্রীদের জন্যে নির্মিত যাত্রীছাউনিটি খেয়াঘাট থেকে দূরে অবস্থিত। এজন্য এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। পরে এলাকাবাসীর উদ্যোগে সেটি ব্যবহার হচ্ছে মসজিদ হিসেবে। দীর্ঘদিন ধরে ভেঙে পড়ে আছে যাত্রীদের জন্য নির্মাণ করা টয়লেট।
গুলবুনিয়া-চালিতাতলী নামে আরেকটি খেয়াঘাটেরও বেহাল দশা। গুলবুনিয়ায় নির্মিত যাত্রীছাউনিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে ভাঙা অবস্থায়। ফলে ঘাটে আসা যাত্রীদের খেয়া পারাপারের জন্য অপেক্ষা করতে হয় রাস্তায়, অথবা পাশে থাকা বিভিন্ন চায়ের দোকানে। এতে পুরুষ যাত্রীরা বিভিন্ন জায়গায় বসে সময় পার করলেও বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন নারী এবং শিশু যাত্রীরা।
বড়ইতলা খেয়াঘাট এলাকার বাসিন্দা ফারুক হোসেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘যাত্রীদের জন্য নির্মিত যাত্রীছাউনিটি ঘাট থেকে অনেক দূরে তৈরি করা হয়েছে। এখানে যাত্রীরা বসলে কখন খেয়া ছেড়ে যাবে তা কেউ দেখতে পারে না। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে যাত্রীছাউনিটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে ছিল। পরে যাত্রীছাউনিটি এলাকাবাসী ওয়াল ও টিনের বেড়া দিয়ে নামাজের জন্য মসজিদ তৈরি করেছেন।’
Advertisement
একই ঘাটের ইজারাদারদের পক্ষে ঘাট পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আহমেদ পারভেজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রতিবছরে এ ঘাটটি কোটি টাকায় ইজারা নিতে হয়। তবে খেয়ার জন্য আলাদা কোনো ঘাট নির্মাণ করা হয় না। ফলে ফেরিঘাটের পন্টুনকেই খেয়াঘাট হিসেবে আমাদের ব্যবহার করতে হয়। বিশেষ করে যাত্রীদের সুবিধার্থে বৃষ্টির মৌসুমে আমরা নিজেদের অর্থায়নে অস্থায়ীভাবে খেয়ার জন্য ঘাট তৈরি করে যাত্রীদের পারাপার করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঘাটে আসা নারী-পুরুষ যাত্রীদের জন্য আলাদা কোনো ভালো টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। একটি যাত্রীছাউনি থাকলেও তা ঘাট থেকে অনেক দূরে হওয়ায় যাত্রীদের কোনো উপকার হয় না। আমরা চাই যাত্রীদের সুবিধার্থে নারী-পুরুষদের জন্য আলাদা টয়লেট ব্যবস্থাসহ ঘাটের কাছাকাছি একটি যাত্রীছাউনি নির্মাণ করে দেওয়া হোক।’
আমতলী ও পুরাকাটা খেয়ার নিয়মিত যাত্রী মোহাম্মদ সাঈদ হাওলাদার। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফেরির পন্টুন থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে খেয়ায় উঠতে হয়। অনেক সময় ঘাটে থাকা ফেরির ওপর থেকেও ওঠানামা করতে হয় আমাদের। এতে মোটরসাইকেল স্লিপ করে নদীতে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।’
আমতলী-পুরাকাটা খেয়াঘাট পরিচালনার দায়িত্বে থাকা শফিকুল ইসলাম নবীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের খেয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো ঘাট নেই। সড়ক ও জনপদের যে ফেরির ঘাট আছে, সেখান থেকে যাত্রীরা খেয়ায় ওঠানামা করেন। এ কারণে যখন ফেরিতে গাড়ি ওঠানামা করে, তখন খেয়ার যাত্রীরাও একই পথে চলাচল করায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে।’
কথা হয় গুলবুনিয়া-চালিতাতলী খেয়াঘাটের গুলবুনিয়ার যাত্রীছাউনিটির ইজারাদার আল-আমীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রতিবছর আমরা লাখ লাখ টাকা দিয়ে ঘাটের ইজারা নিলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যাত্রী সেবার মান এবং ঘাট উন্নয়নে তেমন কোনো কাজই করে না। এখানে দীর্ঘদিন ধরেই যাত্রীছাউনিটি ভেঙে পড়ে আছে। খেয়া পার হতে আসা যাত্রীদের বসার জন্য কোনো জায়গা নেই। বিশেষ করে বৃষ্টির সময় যাত্রীদের বসার জায়গা না থাকায় সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়তে হয়।’
এ বিষয়ে বরগুনা জেলা প্রশাসক ও জেলা পরিষদ প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম জাগো নিউজকে বলেন, এরইমধ্যে খেয়াঘাটগুলোর উন্নয়নে কী কী কাজের প্রয়োজন রয়েছে তার একটি তালিকা প্রস্তুত করতে বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পেলে টেন্ডারের মাধ্যমে ঘাট উন্নয়নে আমরা দ্রুত কাজ শুরু করবো। যেসব খেয়াঘাটের যাত্রীছাউনি বেদখল হয়েছে, সেগুলো উদ্ধারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নুরুল আহাদ অনিক/এসআর/এমএস