জাতীয়

প্রধান উপদেষ্টা উদ্যোগ নিলে চালু হতে পারে বাহরাইনের শ্রমবাজার

বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী কর্মীদের জন্য সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশ বাহরাইন। দেশটিতে বর্তমানে দেড় লাখেরও বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত। তবে ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশিদের জন্য শ্রমবাজারটি বন্ধ। ছয় বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে কোনো শ্রমিক নিচ্ছে না দেশটি। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বাহরাইনের রাজ পরিবারের সুসম্পর্ক রয়েছে। তিনি উদ্যোগ নিলে চালু হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ এই শ্রমবাজার।

Advertisement

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৫ আগস্ট বাহরাইনের মোহাররক এলাকায় সিদা মসজিদের বাংলাদেশি মুয়াজ্জিন কামাল উদ্দিন বাহরাইনি ইমাম আবদুল জলিল হামদকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন। এ ঘটনার পর বাংলাদেশের শ্রমবাজার বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় দেশটির সরকার। ফলে এই মুয়াজ্জিনের অপরাধে আর বাহরাইনে যেতে পারছেন না হাজার হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী।

আরও পড়ুন:

এক বাংলাদেশির অপরাধে বন্ধ বাহরাইনের শ্রমবাজারঅবৈধ অভিবাসীদের ধরতে বাহরাইনে ফের অভিযানবাংলাদেশিদের কাছে আকর্ষণীয় হচ্ছে আমিরাতের শ্রমবাজার

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাহরাইন অনেক বড় সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার। রেমিট্যান্স পাঠানোর দিক থেকেও সেরা ১০-এর মধ্যে দেশটি রয়েছে। সিন্ডিকেটহীন এই শ্রমবাজারটি পুনরায় খুললে শ্রমিকদের কর্মসংস্থান ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে বলে মনে করেন তারা।

Advertisement

২০১৮ সালে বাহরাইনের ইমাম আবদুল জলিল হামদকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন বাংলাদেশি মুয়াজ্জিন কামাল উদ্দিন। এ ঘটনার পর বাংলাদেশের শ্রমবাজার বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় দেশটির সরকার।

জনশক্তি কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে বাংলাদেশ থেকে তিন লাখ ১৩ হাজার ৬১০ জন শ্রমিক বাহরাইনে যান। এর মধ্যে নারী শ্রমিক ছিলেন তিন হাজার ১৭২ জন। সর্বশেষ ২০১৮ সালে ৮১১ জন বাংলাদেশি কর্মী দেশটিতে যান। এর আগে ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চার বছরে দেশটিতে কর্মী যাওয়ার সংখ্যা এক লাখ ৩৫ হাজার ৫৮৩ জন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত বাহরাইন থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ৬৩৯ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসেছে ৫৫৪ দশমিক ৯৫ মিলিয়ন ডলার, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসেছে ৫২৮ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলার ও ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫৬৬ দশমিক ৬১ মিলিয়ন ডলার।

আরও পড়ুন:

Advertisement

একজন শিক্ষার্থীর দৃষ্টিতে সম্ভাব্য পররাষ্ট্রনীতি কেমন হতে পারেমধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের জন্য বিমানবন্দরে হবে স্পেশাল লাউঞ্জদ্বিপক্ষীয় চুক্তি না থাকায় শোষণের শিকার প্রবাসী শ্রমিকরা

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে আরও তৎপর হতে হবেবাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাহরাইনের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়াটা সবচেয়ে বেশি জরুরি। কাজ করতে হবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে। আগের সরকার এক রকম ছিল, তাদের সঙ্গে বাহরাইনের সম্পর্কও তাদের পলিসি অনুযায়ী ছিল। তবে অতীতে শ্রমবাজার খোলার বিষয়ে সরকারের কোনো প্রচেষ্টা আমরা দেখিনি। এখন যেহেতু আমাদের নতুন সরকার, সেহেতু এখানে নতুনত্ব আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। শুধু বাহরাইন নয়, আরব আমিরাত ও ওমানের শ্রমবাজারও আমাদের জন্য খোলা খুবই জরুরি।’

বাহরাইন অনেক বড় সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার। রেমিট্যান্স পাঠানোর দিক থেকেও সেরা ১০-এর মধ্যে দেশটি। সিন্ডিকেটহীন এই শ্রমবাজারটি পুনরায় খুললে শ্রমিকদের কর্মসংস্থান ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাহরাইনে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য পুনরায় শ্রমবাজার খোলার জন্য ২০২২ সালে সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বাহরাইন সফর করেন এবং বাহরাইনে অনুষ্ঠিত ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) অনুষ্ঠানে ভিসা খোলার বিষয়ে আলোচনা করেন। এছাড়া ২০২৩ সালের অক্টোবরে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব আহমেদ মুনিরুস সালেহীন বাহরাইনে গিয়ে ভিসা খোলার বিষয়ে বাহরাইনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু এসব বিষয়ে খুব বেশি অগ্রগতি দেখা যায়নি।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় বরাবর চিঠিসম্প্রতি বাহরাইনে বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় বরাবর একটি চিঠি দেওয়া হয়। বাহরাইনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রথম সচিব (শ্রম) মাহফুজুর রহমান স্বাক্ষরিত এ চিঠিতে বলা হয়, ২০১৮ সাল থেকে ভিসা বন্ধ থাকার কারণে বাহরাইনে অবস্থানরত প্রবাসীরা নানান ধরনের সমস্যা ও সংকটের সম্মুখীন হচ্ছেন। বিশেষ করে ওয়ার্ক ভিসা বন্ধ থাকার কারণে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশির ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। আবার কারও কারও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কোম্পানি নতুন করে বাংলাদেশি শ্রমিক না আনতে পারায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। বর্তমানে বাহরাইনে প্রায় ৫০ হাজার বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী হিসেবে নিজ নিজ কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আসছেন। এই প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশি কর্মীর অভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন এবং অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। ফ্যামিলি ভিসা বন্ধ থাকার কারণে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি বাহরাইনে তাদের পরিবার নিতে পারছেন না এবং পারিবারিকভাবে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।

‘আমাদের নতুন সরকার, এখানে নতুনত্ব আসার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। শুধু বাহরাইন নয়, আরব আমিরাত ও ওমানের শ্রমবাজারও আমাদের জন্য খোলা খুবই জরুরি।’- বায়রার যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম

চিঠিতে আরও বলা হয়, বাহরাইনে বাংলাদেশিরা দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রবাসী জনগোষ্ঠী। এখানকার মোট শ্রমশক্তির প্রায় ২৫ শতাংশ বাংলাদেশি। বাহরাইনে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য পুনরায় ভিসা খুললে আগামী বছরগুলোতে বিভিন্ন সেক্টরে প্রায় এক লাখ বাংলাদেশি কর্মীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে। বাহরাইন শ্রমবাজার খুললে আগামী বছর প্রায় ১৫টি পেশায় বাংলাদেশিরা যেতে পারবেন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বাহরাইনসহ সারাবিশ্বে সুখ্যাতি রয়েছে। তিনি এ পর্যন্ত তিনবার বাহরাইনে গুরুত্বপূর্ণ সফরে গেছেন এবং বাহরাইনের রাজ পরিবারের সঙ্গেও তার সুসম্পর্ক রয়েছে। তিনি বাহরাইন সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘দ্য মেডেল অব দ্য ফার্স্ট অর্ডার অব মেরিট’ লাভ করেন। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে ভিসা খোলার বিষয়ে কূটনৈতিকভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে ভিসা খোলার বিষয়টি সুরাহা হবে বলে আশা করা যায়।

আরও পড়ুন:

মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে সব রিক্রুটিং এজেন্সিকে সুযোগ দেওয়ার দাবিজুলাই আন্দোলনে প্রবাসীদের আত্মত্যাগ ভাষায় বোঝানো যাবে না

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন। এ বিষয়ে উপদেষ্টার একান্ত সচিব মো. সারওয়ার আলম জাগো নিউজকে বলেন, বাহরাইন শ্রমবাজারের সমস্যা অনেক পুরোনো এবং জটিল। এক্ষেত্রে ওই দেশে গিয়ে এটার সমাধান করতে হবে। না হলে তাদের আনতে হবে। উপদেষ্টা বলেন, প্রয়োজনে তিনি যাবেন। বন্ধ শ্রমবাজারগুলো সচল করার ক্ষেত্রে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। আমরা টিম করে যাবো। উপদেষ্টার নেতৃত্বে ওই দেশে গিয়ে এ বিষয়ে সমাধানের চেষ্টা করা হবে।

‘অভিবাসন কূটনীতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। কর্মীদের অবশ্যই ওই দেশের আইন মেনে চলার ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনে আমাদের হাইকমিশনে আইন উপদেষ্টা রাখা যেতে পারে।’- অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর

বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য আকর্ষণীয় বাহরাইনের শ্রমবাজারএ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পশ্চিম এশিয়া অণুবিভাগের পরিচালক মোস্তফা জামিল জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাহরাইনের শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশের চেয়ে স্থিতিশীল। বাংলাদেশি কর্মীদের জন্যও অনেক আকর্ষণীয়। তবে ২০১৮ সালে ইমাম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা খুবই হৃদয়বিদারক ছিল। ফলে সে দেশের সরকার কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই বাজারটির বিষয়ে আমরা বহুবার বাহরাইন প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছি। কোনো সুরাহা হয়নি৷ তাছাড়া সেখানে আপাতত হাইকমিশনারও নেই। ফার্স্ট সেক্রেটারি আছেন একজন, তাকে দিয়েই চালানো হচ্ছে। বাহরাইনে আমাদের নতুন হাইকমিশনার যাবেন শিগগির। তিনি শ্রমবাজারটি পুনরায় খোলার ব্যাপারে কাজও করছেন।’

অভিবাসন কূটনীতিকে গুরুত্ব দিতে হবেঅভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর জাগো নিউজকে বলেন, এ বাজারটি খুলতে গেলে অভিবাসন কূটনীতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। উদ্যোগটা সক্রিয় হতে হবে। দুই দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের যোগাযোগ লাগবে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একযোগে কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।

‘বাহরাইনে শ্রমবাজারে খুব বেশি ঝামেলা নেই। মালয়েশিয়া, সৌদি ও দুবাইতে যেমন ক্রাইসিস থাকে এই দেশটিতে তেমনটি খুব বেশি দেখা যায় না। উদ্যোগের ক্ষেত্রে আমি মনে করি বিগত সরকারের গাফিলতি ছিল।’

আসিফ মুনীর বলেন, ‘কর্মীদের অবশ্যই ওই দেশের আইন মেনে চলার ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে হবে। যাতে তাদের কর্মের প্রভাব গোটা শ্রমবাজারে না পড়ে। প্রয়োজনে আমাদের হাইকমিশনে আইন উপদেষ্টা রাখা যেতে পারে।’

আরএএস/এসএনআর/এমএমএআর/জেআইএম