ফিচার

বিমান দুর্ঘটনা কেন ঘটে

বিমান দুর্ঘটনা কেন ঘটে

আধুনিক বিশ্বের দ্রুততম ও সবচেয়ে নিরাপদ ভ্রমণ মাধ্যম হিসেবে পরিচিত বিমান। প্রতিদিন বিশ্বের আকাশপথে হাজার হাজার উড়োজাহাজ চলাচল করে এবং অধিকাংশ যাত্রাই শেষ হয় নিখুঁত নিরাপত্তার সঙ্গে। তবুও মাঝে মাঝে ঘটে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা, যা এক মুহূর্তেই কেড়ে নেয় বহু প্রাণ, স্তব্ধ করে দেয় শত শত পরিবারের স্বপ্ন।

Advertisement

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও যাত্রীবাহী উড়োজাহাজের পাশাপাশি বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এসব দুর্ঘটনার সংখ্যা নির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন হলেও কয়েকটি বড় দুর্ঘটনা এখনো দেশবাসীর হৃদয়ে গভীরভাবে গেঁথে আছে। যা সহজে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।

সবশেষ, ২০২৫ সালের ২১ জুলাই রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমান বাহিনীর একটি বিমান (এফ-৭ বিজিআই) যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিধ্বস্ত হয়। প্রাণ হারান ৩৫ জনের বেশি, আহত হন দেড় শতাধিক। নিহত হন পাইলট তৌকির ইসলাম।

এমন মর্মান্তিক ঘটনার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে-এত উন্নত প্রযুক্তি, দক্ষ পাইলট এবং কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাঝেও কেন ঘটে এমন দুর্ঘটনা?

Advertisement

ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ, দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে পাইলট পেশার সঙ্গে যুক্ত আছেন। বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্সের প্রাক্তন পাইলট, বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক এভিয়েশন ট্রেনিং প্রোগ্রামের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি একটি এয়ারলাইন শুরু করার উদ্যোগও নিয়েছেন অভিজ্ঞ এই পাইলট।

বিমান দুর্ঘটনা কেন ঘটে? এর পেছনের কারণ কি শুধুই যান্ত্রিক ত্রুটি? নাকি রয়েছে আরও জটিল কিছু বিষয়, যেগুলো আমাদের চোখে পড়ে না? দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে এসব বিষয় নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফিচার লেখক মোহাম্মদ সোহেল রানা-

জাগো নিউজ: একটি বিমান কীভাবে আকাশে ওড়ে?ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ: বিমান আকাশে উড়ে প্রধানত এর আকার, পাখার ডিজাইন এবং ডানার ওপর নির্ভর করে। বিমানের ডানাগুলো এমনভাবে তৈরি যে সামনের দিকের বাতাস নিচের চেয়ে ওপরে বেশি গতিতে চলে, ফলে উপরে কম চাপ সৃষ্টি হয়- একে লিফট বলা হয়, যা বিমানকে তোলার জন্য যথেষ্ট শক্তি দেয়। ডানার নিচে উচ্চচাপ নিম্নচাপের দিকে যেতে চায় এবং ডানাকে উপরের দিকে ধাক্কা দেয় ইঞ্জিন থ্রাস্ট জোগায় আর পাইলট তা নিয়ন্ত্রণ করেন।

জাগো নিউজ: বিমান দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলো কী?ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ: বিমান দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে যান্ত্রিক ত্রুটি, মানবিক ভুল, আবহাওয়াগত সমস্যা। এছাড়া ভুল নির্দেশনা, বার্ড স্ট্রাইক, নাশকতামূলক ঘটনা বা অবকাঠামোগত ত্রুটিও দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত বিভিন্ন সংস্থা যেমন আইসিএও, রোয়িং, এয়ারবাস এবং আইএটিএ-এর সেফটি রিপোর্ট অনুযায়ী, বিমান দুর্ঘটনার আনুমানিক কারণগুলোর শতকরা হিসাব চিহ্নিত করা হয়েছে-মানবিক ভুল (পাইলট বা গ্রাউন্ড ক্রু) প্রায় ৬০ শতাংশ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত, যান্ত্রিক ত্রুটি ১৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ, আবহাওয়া ও অন্যান্য বাহ্যিক কারণ হচ্ছে প্রায় ১০ শতাংশ। এছাড়া ভুল নির্দেশনা, বার্ড স্ট্রাইক, নাশকতামূলক ঘটনা বা অবকাঠামোগত ত্রুটিও দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।

Advertisement

যান্ত্রিক ত্রুটিসবচেয়ে সাধারণ যান্ত্রিক ত্রুটিগুলো হয় ইঞ্জিন, হাইড্রোলিক সিস্টেম, ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেম বা ল্যান্ডিং গিয়ারের ক্ষেত্রে। কখনো কখনো সেন্সর বা অটোমেটেড সিস্টেমের ত্রুটিও বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। যদি ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়, ফুয়েল সিস্টেমে লিক হয়, অথবা কোনো গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র কাজ না করে-তখন বড় বিপদ ঘটে যেতে পারে। যদিও আধুনিক বিমানে বিভিন্ন ধরনের ব্যাকআপ সিস্টেম থাকে, তবুও কোনো জটিল যান্ত্রিক ত্রুটি ঘটলে,পাইলটদের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ ধরনের পরিস্থিতিতে পাইলটরা সাধারণত নিকটবর্তী বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করার সিদ্ধান্ত নেন, যাতে যাত্রীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা যায়।

মানবিক ভুলবিমান দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে মানবিক ভুলকে চিহ্নিত করা হয়। এখানে মানবিক ভুল বলতে বোঝায়-পাইলটের ভুল সিদ্ধান্ত, জরুরি পরিস্থিতিতে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে না পারা, অথবা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ইঞ্জিনিয়ারদের অবহেলায় গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা সম্পন্ন না হওয়া। ইতিহাসে বহু দুর্ঘটনা ঘটেছে ককপিট ক্রুদের ভুল বোঝাবুঝি, যোগাযোগের ত্রুটি কিংবা শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তির কারণে।

প্রতিটি পাইলটের জন্য সেকেন্ডের হিসাব খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একটি বিমান ঘণ্টায় ৫০০ থেকে এক হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত গতি চলে। এই দ্রুতগতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেরি মানেই হতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। ১৯৮৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকায় খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে অবতরণের সময় বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফকার এফ২৭-৬০০ প্লেনটি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছাকাছি একটি জলাভূমির মধ্যে ক্র্যাশ করে। এতে ৪ জন ক্রু ও ৪৫ জন যাত্রীসহ সবাই নিহত হন।

টেনেরিফে বিমান বিপর্যয় সংঘটিত হয়েছিল ১৯৭৭ সালের ২৭ মার্চ। স্পেনের টেনেরিফ দ্বীপের লোস রোদেওস বিমানবন্দরে দুটি বোয়িং ৭৪৭ (KLM ও Pan Am) ঘন কুয়াশায় রানওয়েতে মুখোমুখি সংঘর্ষে পড়ে। বোমা হুমকির কারণে অতিরিক্ত বিমান ভিড়, ভুল রেডিও যোগাযোগ ও দৃশ্যমানতার অভাব ছিল মূল কারণ। ৫৮৩ জন নিহত হন, এটি এখনো ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী বিমান দুর্ঘটনা।

২০১৮ সালের ১২ মার্চ নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (টিআইএ) ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের যাত্রীবাহী একটি প্লেন বিধ্বস্ত হয়। ওই দুর্ঘটনায় বিমানে থাকা ৭১ আরোহীর মধ্যে ৫১ জন নিহত হন।

ওপরের তিনটি দুর্ঘটনায় মানবিক ভুলের কারণে ঘটেছে। এক কথায় বেশিরভাগ বিমান দুর্ঘটনায় মানবিক ভুলের কারণেই সংঘটিত হয় থাকে।

আবহাওয়াগত সমস্যাবড় ধরনের ঝড়, বজ্রপাত, তীব্র বৃষ্টি, ঘন কুয়াশা বা বরফ-এসব সবই উড়োজাহাজের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে, আকাশে যদি তীব্র টার্বুলেন্স বা হঠাৎ বজ্রঝড় হয়, তবে পাইলটকে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে যাত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দ্রুত এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

জাগো নিউজ: এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে তথ্যের আদান প্রদান বা ভুল বোঝাবুঝি কতটা ঝুঁকিপূর্ণ?ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ: এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল ভুল নির্দেশনা দিলে বা পাইলট ভুলভাবে বুঝলে আকাশপথে দুই বা ততোধিক বিমানের মধ্যে সংঘর্ষের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। তাই রেডিও কমিউনিকেশন স্পষ্ট ও সঠিক হওয়া অত্যন্ত জরুরি। কোনো নির্দেশ শুনতে ভুল হলে পুনরায় জানতে হবে।

জাগো নিউজ: উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয় কেন?ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ: উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় বিমান মাটির সবচেয়ে কাছাকাছি থাকে, গতি বেশি থাকে, পাইলটের প্রতিটি সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে নিতে হয়। কোনো সমস্যা হলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে সঠিক পদক্ষেপ না নিলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে। উড্ডয়ন এবং অবতরণের সময় বেশিরভাগ ভয়াবহ দুর্ঘটনা হয়।

বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে সাধারণ মানুষের কিছু ভুল ধারণা ও প্রশ্ন তুলে ধরা হলো-

১) বিমান দুর্ঘটনা কেউ বাঁচে না, কথাটি সত্য নয়২) ইঞ্জিন বন্ধ হইলেই বিমার নিচে পড়ে যায়। এটা সত্য নয়। ইঞ্জিন বন্ধ হইলে পুনরায় স্টার্ট করার ব্যবস্থা আছে। উচ্চতা বেশি থাকলে সেটা গ্লাইড করে অনেক দূর যেতে পার৩) টার্বুলেন্স মানেই বিমান বিপদে পড়া। কথাটা সঠিক নয়। বাতাসে টার্বুলেন্স থাকতেই পারে। বিমান তা সহ্য করার ক্ষমতা রাখে। পাইলট এগুলোকে এড়িয়ে চলেন৪) উড়ন্ত অবস্থায় বিমানের দরজা খোলা সম্ভব। এটা সম্ভব নয় কারণ বিমানটিকে অক্সিজেনের জন্য উচ্চ চাপে রাখা হয়।

জাগো নিউজ: আপনার ক্যারিয়ারে কখনো কি কোনো জরুরি পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন?ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ: ২০০৫ সালে আমি তখন এফ২৮ বিমানের ক্যাপ্টেন। সৈয়দপুর থেকে ঢাকা আসতে ছিলাম। মাঝামাঝি রাস্তায় আসার পথে হাইড্রোলিকের প্রেসার কমে যায়। এতে অনেক সময় ল্যান্ডিং গিয়ার নিচে নামলেও তার দরজাগুলা খোলা থাকে। দরজা রানওয়ের ঘর্ষণে আগুন ধরতে পারে আবার লেন্ডিং গিয়ার লক নাও হতে পারে। ঢাকার উত্তরে ৫০ কিলোমিটার দূরত্বে আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করে হাইড্রোলিক সিস্টেমের বিকল্প চালু করার চেষ্টা করি। মে ডে কল বা জরুরি বার্তা টাওয়ারকে দেই।

লেন্ডিং গিয়ার নামানোর পর টাওয়ারের ওপরে দিয়ে একটি চক্কর দেই। টাওয়ার দেখতে পাই লেন্ডিং গিয়ারটি নেমেছে কিন্তু আমি সংকেত পাই লক হয় নাই। টাওয়ার থেকে ফায়ার ব্রিগেড, অ্যাম্বুলেন্সসহ সব কিছু প্রস্তুত রাখা হয়, যাতে কিছু ঘটলে কাজে লাগে। আশপাশের বিমানগুলোকে সরিয়ে নেওয়া হয়। আমি আস্তে আস্তে অবতরণ করি এবং সফল হই। চাকা লক না হলে তা রানওয়ের সঙ্গে ঘর্ষণে আগুন লাগা সম্ভবনা ছিল।

পাইলটদের জন্য এ ধরনের পরিস্থিতি সব-সময়ই চ্যালেঞ্জিং-তবে নিয়মিত অনুশীলনই আমাদের সবচেয়ে বড় ভরসা। জীবনে আরও অনেক বড় বড় বিপদের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছিলাম। আল্লাহ রহমতে সবগুলো থেকে রক্ষা পেয়েছি।

আরও পড়ুন

শরীরের কত শতাংশ পুড়েছে, কীভাবে হিসাব করা হয় বিমানের একটি ইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল কত, নির্ধারণ হয় কীভাবে?

কেএসকে/এমএস